মসলার বাজার গরম

দ্বিগুণ আমদানি, তবুও সংকট

রাজিব শর্মা »

দেশে চাহিদার বিপরীতে দ্বিগুণ আমদানির পরও কোরবানির ঈদের আগেই অস্থির হয়ে উঠেছে মসলার বাজার। কৃত্রিম সংকটের দোহাই দিয়ে এক মাসের ব্যবধানে পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে মরিচ, লবঙ্গ, এলাচ, জিরা, গোলমরিচসহ নানা মসলাজাত পণ্যের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত। রোববার ও সোমবার দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জের মসলার মার্কেটে সরেজমিনে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে জিরা, লবঙ্গ, ধনে ও কাঠবাদামের। গতকাল পাইকারি বাজারে জিরা বিক্রি হয়েছে কেজিতে ৭৫০ টাকা থেকে ৭৭০ টাকায়। যা গতবছর এদিনে বিক্রি হয়েছিল ৩৯০ থেকে ৪০০ টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে এ মসলাজাত পণ্যের দাম বেড়েছে প্রায় ৯৬ শতাংশেরও বেশি।

লবঙ্গের দাম বছরের ব্যবধানে কেজি প্রতি বেড়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। পাইকারি বাজারে লবঙ্গ বিক্রি হয়েছে ১৪০০ থেকে ১৪৫০ টাকা। এছাড়া ধনিয়া বিক্রি হয়েছে ১৬০ থেকে ১৭৫ টাকা যা গতবছর এ দিনে বিক্রি হয়েছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। বছরের ব্যবধানে ধনিয়া দাম বেড়েছে ৬৬ শতাংশেরও বেশি। এলাচ বিক্রি হয়েছে ১৬০০ টাকা থেকে ২৪০০ টাকা পর্যন্ত। হলুদ ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়, সকল ধরনের মরিচ ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে কাজুবাদাম ১০০০ টাকা থেকে ১১৫০ টাকা, কাঠবাদাম ৭০০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকা, কিসমিস ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা, সরিষা ১০০ থেকে ১৩০ টাকা, গোলমরিচ ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা, স্টার মসলা ১২০০ টাকা থেকে ১৩০০ টাকা, দারুচিনি ৩১০ টাকা থেকে ৪২০ টাকা, শাহী জিরা ৭৫০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা, এলাচ ১২০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

তাছাড়া ভারতীয় আমদানি পণ্যের সরবরাহ ভালো থাকায় পেঁয়াজের দাম একটু কমতির দিকে হলেও আদা ও রসুনের দাম এখনো বেশ চড়া।

গতকাল খাতুনগঞ্জের বাজারে আমদানি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। আর আদা বিক্রি ১৯০ টাকা থেকে ২০০ টাকা। আমদানির রসুন ১৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলেন, সাধারণভাবে পণ্য দেশে আসার পর বিল পরিশোধ করতে হয়। তবে আমদানি ঋণপত্র খোলার সময় গ্রাহককে ব্যাংকে পণ্য মূল্যের একটি অংশ জমা দিতে হয়, যাকে এলসি মার্জিন বলে। এই মার্জিনের বিষয়টি নির্ধারিত হয় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে। আগে ব্যাংকের সঙ্গে গ্রাহকের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ভালো হলে ন্যূনতম মার্জিনে এলসি খোলা যেত। যা এখন শতভাগ মার্জিনে এলসি খুলতে হচ্ছে। তাও সব আমদানিকারক পারছেন না। এসব জটিলতার কারণে মসলার বাজাওে প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া অনেক মসলার পণ্যে আমদানি খরচ বৃদ্ধির কারণে দামেরও পরিবর্তন হয়েছে।

খাতুনগঞ্জের মসলা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এন আর ট্রেডিং এর ম্যানেজার দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘মসলার সাথে আন্তর্জাতিক বাজারের একটি সম্পর্ক আছে। সকল ধরনের মসলা সাধারণত আমদানি করতে হয়। তার মধ্যে রয়েছে আমদানি সংকট, এলসি জটিলতা। ফলে অন্যান্যবারের তুলনায় এবার মসলার দাম একটু বাড়ছে। তবে যা মসলা আমদানি হওয়ার হয়ে গেছে। বাজারে মসলার ঘাটতি নেই। যা আমদানি হয়েছে তাতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংকট সৃষ্টি হবে না।’

আল মদিনা ট্রেডিং এর স্বত্বাধিকারী এহছান উল্লাহ জাহেদী বলেন, ‘আগে ব্যবসায়ীরা ২৫ শতাংশ মার্জিনে এলসি খুলতে পারতো। এখন শতভাগ মার্জিনে এলসি খুলতে হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আমদানিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। ফলে আমদানির পণ্যগুলোতেও মাঝে-মধ্যে সংকট সৃষ্টি হয়। এর ফলে দাম উঠানামা করে। গতবছরের তুলনায় এবার প্রতিটা মসলা পণ্যের দাম ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগে এক ডলারের জন্য আমদানিকারককে পরিশোধ করতে হতো ৮২ থেকে ৮৪ টাকা। এখন করতে হচ্ছে ১১১ টাকার মতো। এ ছাড়া শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে মোট দামের ওপর। ডলারের দাম বাড়ার কারণে শুল্কও আগের তুলনায় বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও শুল্কের পরিমাণ বেশি আসার কারণে মসলার আমদানি খরচ বেড়েছে। এ কারণে দেশের বাজারে মসলার দাম বাড়ছে।’

এদিকে কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের মে মাসের প্রথম ২০ দিনে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৪১৪.৩৭ টন জিরা আমদানি হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৮০.৯৫ টন। অথচ সংকট দেখিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জিরার দামও বাড়ানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের তথ্য অনুযায়ী, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২০ মে পর্যন্ত ৫ হাজার ৪৩৮ টন দারুচিনি, ৪২৩ টন লবঙ্গ, ৮৫৮ টন এলাচ, ১ হাজার ২৫৩ টন জিরা, ১০৬ টন জয়ত্রী এবং ৪৯৩ টন গোলমরিচ আমদানি হয়েছে। সবমিলিয়ে লবঙ্গ ৩০ শতাংশ, মরিচ ১১ শতাংশ ও রসুনের আমদানি বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।

খাতুনগঞ্জের আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘আগে ব্যবসায়ীরা আমদানি করতে যে সুযোগ পেত, তা এখন পায় না। অনেক ব্যাংকে এলসি জটিলতার মধ্য দিয়ে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ীরা আমদানি বিমুখ হচ্ছেন।’

দ্বিগুণ আমদানি হলেও পণ্যের দাম অস্তিতিশীল সর্ম্পকে এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘গত বছর করোনাকালীন সামাজিক অনুষ্ঠান কম ছিল। এতে মসলার চাহিদাও কম ছিল। তাছাড়া ডলারের দামও কম ছিল। কিন্তু এ বছর মসলার চাহিদা বেড়েছে পাশাপাশি ডলারের দামও বেড়েছে। ফলে মসলার দামও বাড়তি।’