স্মরণ : চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অগ্নিকন্যা বিপ্লবী কল্পনা দত্ত (যোশী)

নিজামুল ইসলাম সরফী »

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘অগ্নিকন্যা’ সেই বিপ্লবী কল্পনা দত্ত (যোশী) ছিলেন চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদারের পাশাপাশি তাঁরও ছিলো সক্রিয় অংশগ্রহণ। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অন্যতম মহান সংগঠক কল্পনা দত্ত।
১৯১৩ সালের ২৭ জুলাই অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রামের বোয়ালখালি উপজেলার শ্রীপুর-গ্রামের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। ১৯২৯ সালে তিনি ডা. খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর কলকাতার বেথুন কলেজে পড়তে গেলে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু এবং বিপ্লবী কানাই লাল দত্তের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। যোগদান করেন বেথুন কলেজে গড়ে ওঠা ছাত্রী সংঘে। পুর্ণেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে তিনি মাস্টার দা সূর্য সেনের সাথে পরিচিত হন এবং মাস্টার দা সূর্যসেন প্রতিষ্ঠিত ই-িয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখায় যোগদান করেন।
১৯৩১ সালে কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতাকে চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমনের দায়িত্ব দেন মাস্টার দা। নির্দিষ্ট দিনের এক সপ্তাহ আগে পুরুষের ছদ্মবেশে একটি সমীক্ষা করতে গিয়ে কল্পনা দত্ত ধরা পড়েন ও গ্রেফতার হন। অপারেশনে প্রীতিলতা অসহসাহসিক বীরত্ব প্রদর্শন করেন, কয়েকজন ইংরেজ হতাহত হয়। এক পর্যায়ে ধরা পড়লে তিনি বিষপান করে আত্মাহুতি দেন। জেলে কল্পনা দত্ত অপারেশন পাহাড়তলি এবং প্রীতিলতার আত্মাহুতির খবর শোনেন।
জামিনে মুক্তি পেয়ে মাস্টারদার নির্দেশে তিনি কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকেন। ১৯৩৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পুলিশ তাদের গোপন ঠিকানায় আক্রমণ চালায়। কল্পনা দত্ত এবং মনিন্দ্র দত্ত পালাতে সক্ষম হলেও মাস্টার দা বন্দি হন। কিছুদিন পর কল্পনা এবং তাঁর কিছু সহযোদ্ধা পুলিশের হাতে ধরা পরেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করা হয়। কল্পনা দত্ত যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত হন।তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অগ্নিকন্যা কল্পনার মুক্তির আবেদন জানিয়ে বাংলার গভর্নরের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
১৯৪০ সালে কল্পনা দত্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যান। ১৯৪৩ সালে সিপিআই নেতা পিসি যোশীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এর পর তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন এবং দলের মহিলা ও কৃষক সংগঠনকে চাঙ্গা করেন। ১৯৪৫ সালে কল্পনা দত্তের লেখা বই ‘চিটাগাং আর্মারি রেইডার্স রেমিনিসেন্স’ প্রকাশিত হয় বোম্বাই থেকে। ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল। ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় সমান দক্ষতা ছিল কল্পনার। চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র ‘পিপলস্ ওয়ার’ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত তৎকালীন সামাজিক বিষয়ের ওপর তাঁর লেখাগুলি গবেষকদের কাছে মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। ১৯৪৬ সালে সিপিআই প্রার্থী হয়ে তিনি চট্টগ্রাম থেকে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু জয়ী হতে পারেন নি। স্বাধীনতার পর তিনি ভারতে বসবাস শুরু করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন সমব্যথী আর তাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় কল্পনা দত্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলেন দু’বার ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে। শেষবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিশেষ আমন্ত্রণে এসেছিলেন। ১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার শেঠ সুখলাল কারনানি মেমোরিয়াল হাসপাতালে কল্পনা দত্ত যোশীর ৮২ বছর বয়সে জীবনাবসান হয়। ২৭ জুলাই ২০২১ তারিখে ১০৮তম জন্মদিনে ব্রিটিশ যুগের স্বদেশ চেতনায় জীবনের ঝুঁকি নেওয়া বিপ্লবী অগ্নিকন্যা সংগ্রামী কল্পনা দত্ত (যোশী)’র স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি, জানাই রক্তিম অভিবাদন ।
(তথ্যসূত্র: অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা- চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা, বিপ্লবীদের কথা, গুণিজন, সাপ্তাহিক দেশ: ২৮ ডিসেম্বর-১৯৯১, দৈনিক গণশক্তিসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা)

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক