রপ্তানিমুখী চামড়া শিল্পকে বাঁচাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

মো. জিল্লুর রহমান »

আমাদের রপ্তানি শিল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্প। পোশাক শিল্পের পরই এ শিল্পের অবস্থান। রপ্তানি আয়ের প্রায় নয় শতাংশ আসে চামড়া শিল্প থেকে। আর প্রতি বছর কোরবানি ঈদের সংগ্রহ এ শিল্পে বয়ে আনে বাড়তি প্রণোদনা। নানাবিধ কারণে দেশের চামড়াশিল্পে দুর্দিন চলছিল বেশ কয়েক বছর থেকেই। এর মধ্যেই শিল্প খাতটিকে আরো দুর্দশায় ফেলেছে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও তা-ব। টানা তিন বছর বিপর্যয়ের পর এবার চামড়ার দাম কিছুটা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রপ্তানি খাতেও গত অর্থবছর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এ খাতের বিশ্লেষকেরা বলেছেন, নানামুখী সঙ্কটে নিমজ্জিত রপ্তানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোরবানির পশুর চামড়ার দাম পুনঃনির্ধারণ করে দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে গতবারের চেয়ে একটু দাম বাড়িয়ে কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। লবণজাত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় ৪০-৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩-৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর ঢাকায় ৩৫-৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ছিল ২৮-৩২ টাকা।
তবে আশার কথা হচ্ছে, গত তিন মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম একটু বাড়তির দিকে এবং এরই মধ্যে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চামড়ার চাহিদা বাড়ছে। ফলে গতবারের চেয়ে এবার চামড়ার দাম বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এজন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া দাম দেখে সতর্ক হয়ে চামড়া সংগ্রহ করছেন। অন্যদিকে সরকারি তথ্য বলছে, চার বছর পর সদ্যসমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছর প্রবৃদ্ধিতে ফিরেছে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি। বাংলাদেশে করোনার প্রভাব থাকলেও এর প্রধান বাজার ইউরোপের দেশগুলোতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এ কারণে রপ্তানি আদেশও বেড়েছে।
ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়; এর অর্ধেকের বেশি সংগ্রহ করা হয় কোরবানি র ঈদের সময়। মোট চামড়ার ৬৪.৮৩ শতাংশ গরুর, ৩১.৮২ শতাংশ ছাগলের, ২.২৫ শতাংশ মহিষের এবং মাত্র ১.২০ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, গত অর্থবছর (২০২০-২১) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয়েছিল ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। ফলে বছরের ব্যবধানে রপ্তানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ। উল্লেখ্য যে, করোনাকালের আগের বছর ২০১৯ সালে দেশে কোরবানি পশুর চামড়া নিয়ে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। দাম না পেয়ে ১০-১৫ শতাংশ গরুর চামড়া সড়কে ফেলে এবং মাটিতে পুঁতে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। আবার সময়মত লবণ না দেওয়া, বৃষ্টি ও গরমের কারণেও ২০ শতাংশ গরুর চামড়া নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
যারা কোরবানি করেন তারা ধর্মীয় বিধি মেনে সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কেনেন এবং কোরবানি করেন। পশুর চামড়া বিক্রি করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা তা গরিব মিসকিন, অসহায় নারী পুরুষ, অভাবী লোকজন, পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে অর্থ বিতরণ করেন। তবে উল্লেখযোগ্য অংশের পশু চামড়া সাধারণত বিভিন্ন এতিম খানা, মসজিদ, মাদ্রাসায় দান করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান সংগৃহীত চামড়া বিক্রি করে লব্ধ অর্থ প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ছাত্র-ছাত্রী এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যয় করেন। পশু চামড়ার ক্রেতা বা চাহিদার দিকটি সুবিস্তৃত। এখানে পশু চামড়া অনেক শিল্পপণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অতি প্রয়োজনীয় জুতা থেকে শুরু করে বিলাসী জুতা, জ্যাকেট, ব্যাগ ও অন্যান্য দ্রব্য দেশ বিদেশের বাজারে খুবই আকর্ষণীয়। অনেক চামড়াজাত পণ্য অতি প্রয়োজনীয় বিধায় এগুলোর চাহিদা তেমন কমে না বরং বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা বাড়লে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়লে ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ে।
দেশে চামড়া শিল্পের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৫১ সালে ৩ অক্টোবর। নারায়ণগঞ্জ থেকে সরকার চামড়া শিল্পকে ঢাকার হাজারীবাগে নিয়ে আসে। কিন্তু এখানে বর্জ্য শোধনের কোন ব্যবস্থা ছিল না। ট্যানারিগুলো প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিত। ফলে বছরের পর বছর বুড়িগঙ্গার পানি দূষিত হয়েছে।পরিবেশ দূষণ রোধ করার জন্য সরকার ২০০৩ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে সাভারে বিসিকের তত্ত্বাবধানে চামড়া শিল্পনগরী স্থাপন করে। এতে করে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর এ শিল্পের দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।
কিন্তু শুধু চামড়াশিল্পে নয়, করোনার কারণে অনেক ব্যবসায় এখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ চলছে। চামড়া শিল্প ২০১৫ সাল থেকেই সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোন মতেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। বিসিকের কিছু সিদ্ধান্তহীনতা, সময় মতো সরকারের প্রণোদনা এবং নীতিগত সহযোগিতা না পাওয়ায় ইউরোপ আমেরিকার বাজার ধরতে পারছিল না। তার ওপর দুই বছর করোনার প্রভাবে ব্যবসাই বন্ধ হবার উপক্রম।
মন্ত্রণালয় এবারও কোরবানির চামড়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে। কমিটিগুলোর কাজ হচ্ছে, কোরবানির চামড়া যথাযথভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, ক্রেতা-বিক্রেতা পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি, সংশ্লিষ্ট স্থানে সংরক্ষিত চামড়ায় যথাসময়ে প্রয়োজনীয় লবণ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ের চামড়া সংগ্রহকারীরা বলছেন, এ কমিটি অনেকটা লোকদেখানো, তারা এ বছরও ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। তাই এই কমিটি কতটা দায়িত্ব পালন করেছে, সেটা এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
তবে, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা বেড়েছে কিন্তু সাভারে চামড়া শিল্পপল্লী স্থাপিত হলেও নানা সমস্যার কারণে ব্যবসায়ীরা সেখানে পুরোপুরি কাজ করতে পারছে না। যেকোন মূল্যে আমাদের সম্ভাবনাময় রপ্তানিমুখি চামড়া শিল্পকে বাঁচাতে হবে। এ শিল্পের সাথে হাজারও মানুষের আশা আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ জড়িত। সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হবে। সরকারের সম্ভাবনাময় এ খাতে সুনজর দেওয়া খুবই জরুরি এবং দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে রপ্তানিমুখি এ শিল্পকে যেকোন মূল্যে বাঁচাতে হবে।
লেখক : ব্যাংকার, প্রাবন্ধিক