স্বপ্নবাগিচা’র স্বপ্ন বাস্তবায়নযাত্রা

সুন্দর সমাজ গড়ার তাড়না ও প্রেরণা

নিজস্ব প্রতিবেদক

সুন্দর স্বপ্নগুলোকে নিদ্রার বাইরে দেখার উপায় হলো মনের মতো যদি সেগুলোকে বাস্তবে সাজানো যায়। কল্পনার সবচেয়ে সুন্দর রঙের প্রলেপ এঁটে দেওয়া যায় তাতে। আর জাগরিত অবস্থার স্বপ্নগুলোরই থাকে বাস্তবায়নের তাড়না ও প্রেরণা। তাই গুণিজনদের মতে, সেসবই উৎকৃষ্ট স্বপ্ন যা মানুষকে ঘুমুতে দেয় না। এ রকমই এক স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বপ্নবাগিচা বিদ্যানিকেতনের সারথিরা ।

শুরুটা হয়েছিলো ২০১৫ সালের শেষ দিকে। জাহেদুল আলমসহ তার কয়েকজন বন্ধু, তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যা জর্জরিত জীবনে হতাশায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ব্যতিব্যস্ত হয়ে খুঁজছিলেন মুক্তির পথ। এক সময় বইপড়া ও পড়ানোর আইডিয়া খেলে গেল মাথায়। যেই ভাবা সেই কাজ। ৫ হাজার ৫০০ টাকা সহায় করে কিনে ফেললেন ৫০টি বই। ডিসি হিল, সিআরবি, স্টেডিয়ামের মতো জায়গায় শুরু হলো পাঠআড্ডা। ২০১৭ সালের একুশে ফেব্রয়ারি ভবঘুরে পাঠ আড্ডা পেল পাঠাগারের আশ্রয়। দ্রোহ ও ভালোবাসার দ্বৈত মিশ্রণে যার নামকরণ হলো ‘অগ্নিবীণা পাঠাগার’। পাঠাগারটি বইপড়া, বিভিন্ন স্থানে বই বিতরণ ছাড়াও সোচ্চার হলো বৈশ্বিক, রাষ্ট্রিক ও সামাজিক আন্দোলনগুলোতে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মতো গুরুতর বিপর্যয় মাথায় রেখে নগরে অগ্নিবীণার পড়ুয়ারা রোপণ করল ৫০০ গাছ। ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হলেন তারা। দিনাজপুরের বন্যার্তদের জন্য তৎক্ষণাৎ চাঁদা তুলে পাঠালেন দেড় লক্ষ টাকা। মাঝে ‘অগ্নিবীণা পাঠাগার’ বাংলাদেশ সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধিত পাঠাগারের স¦ীকৃতিও পেল। কিন্তু পড়ুয়ারা দিনে দিনে বুঝতে পারলেন, এসব তবুও যেন যথেষ্ট নয়। আরও গভীরে, আরও গোড়ায় গড়াতে হবে জল। সমাজে পরিবর্তন আনতে হলে, মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হলে গড়ে তুলতে হবে মননশীল মানুষ। এক্ষেত্রে যথাযথ শিক্ষার নেই বিকল্প।

২০১৯ সালের ফেব্রয়ারি মাসে গড়ে উঠলো স্বপ্নসারথিদের ‘স্বপ্নবাগিচা বিদ্যানিকেতন’। যার স্লোগান হলো, ‘রেললাইনের পাশে নয়, অন্ধকার সিঁড়িতে নয়, প্রতিটি শিশু মানুষ হোক আলোর ঝরনাধারায়।’ চট্টগ্রাম নগরীর টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনিতে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির ৩০ জন ছিন্নমূল শিশুকে নিয়ে শুরু হলো স্বপ্নবাগিচার পথচলা। বর্তমানে স্বপ্নবাগিচার আছে প্রাক প্রাথমিক থেকে ৫টি শ্রেণি। যেখানে পড়াশোনা করছে প্রায় ১৫০ জন শিশু। যাদের নিয়মিত পাঠদানসহ শিক্ষাসহায়ক সকল উপকরণ সরবরাহ করছে স্বপ্নবাগিচা। স্বপ্নবাগিচার রয়েছে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি। ক্লাসের ফাঁকে টিফিনেরও নিয়মিত ব্যবস্থা রেখেছেন তারা। শিশুদের শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে স্বপ্নবাগিচা গড়ে তুলেছে ‘আরোগ্যনিকেতন’। মেডিকেল পড়ুয়া বন্ধুদের সহযোগিতায় আরোগ্যনিকেতন হতে প্রতি সপ্তাহে মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজন করা হয়। যেখানে শিশুরা ছাড়াও আশপাশের এলাকার মানুষেরাও বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন। প্রতিটি শিশুর যেকোনো ধরনের অসুস্থতার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত থাকে আরোগ্যনিকেতন। এছাড়া স্বপ্নবাগিচা গড়ে তুলেছে ‘হলি ডে স্কুল’। যেখানে টেম্পু হেলপারের মতো বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ও বয়সের নিরক্ষর মানুষ শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে।
স্বপ্নবাগিচা হতে জানা গেল, এত সব আয়োজনের আর্থিক যোগানে তাদের প্রাথমিকভাবে সাহায্য করেছে আত্মীয়পরিজন ও বন্ধুবান্ধব। কিন্তু স্বপ্নবাগিচার কথা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তাদের দাতার সংখ্যাও বাড়তে থাকে।

প্রতিবছর নতুন ভর্তি হওয়া ৩০ জন শিশুর জন্য স্বপ্নবাগিচা নিশ্চিত করে ৩০ জন ‘একাডেমিক প্যারেন্ট’। যারা প্রতি মাসে খাওয়াদাওয়া ও পড়ালেখার জন্য শিশু প্রতি ২২ শ টাকা চাঁদা প্রদান করেন। এরপর আছে ‘হ্যালো প্যারেন্ট’। যারা মাসে ১২শ টাকা চাঁদা প্রদান করে শিক্ষার খরচ বহন করেন। আছেন ‘মেডিক ফ্রেন্ড’। যারা মাসিক ৩শ টাকা প্রদান করে শিশুদের চিকিৎসাসেবায় সাহায্য করেন। এছাড়া শিশুদের আনন্দ বিনোদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ‘হ্যান্ড অব কেয়ার’ ও ‘ইচ্ছেবন্ধু’ নামক দুধরনের দাতাবন্ধুরা রয়েছেন।

স্বপ্নবাগিচা বিদ্যানিকেতনের সদস্য কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আজকাল দেখা যায়, স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ভালো রেজাল্ট করা, জিপিএ ৫ পাওয়ার জন্য শিশুদের তাড়িত করা হয়। যার ফলে শিক্ষার যে প্রকৃত উদ্দেশ্য কিছু শেখা, জানা, বোঝা সেটি থেকে শিশুরা ছিটকে পড়ছে। তাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ঠিক রেখে শিক্ষাপ্রদান করা জরুরি। আমাদের শিক্ষা যদি আমাদের স্বরূপ চিনতে সাহায্য না করে তাহলে আমরা আর যাই হই না কেন মানুষ হয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। মূলত সেই চিন্তা থেকেই স্বপ্নবাগিচা গড়ে তোলার উদ্যোগটা নেওয়া হয়। আগামীতে স্বপ্নবাগিচাকে আমরা যে অবস্থানে দেখতে চাই, তারও পরিকল্পনা ইতোমধ্যে আমরা হাতে নিয়েছি। সম্প্রতি চট্টগ্রামের ছিন্নমূল শিশুদের জন্য পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোকে সাথে নিয়ে স্বপ্নবাগিচা আয়োজন করেছে ‘স্বপ্নবাগিচা স্কুল উৎসব ২০২৩’।

এ সম্পর্কে কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে করোনা-পরবর্তী সময়ে আমাদের মতো সামাজিক স্বেচ্ছাসেবীদের প্রতিষ্ঠানগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। চাঁদা উত্তোলনসহ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়ে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বিলুপ্তও হয়ে যায়। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমাদের মনে হলো যে, আমরা যদি একত্রিত থাকি, তাহলে আমরা শক্তিশালী থাকবো এবং এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা আমাদের জন্য তুলনামূলকভাবে সহজ হবে। আমরা একে অপরের আইডিয়া, কর্মকাণ্ড এডাপ্ট করে, একে অপরকে সহযোগিতা করে সমৃদ্ধ হতে পারবো এবং এতে একটি সুন্দর সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া আরও বেগবান হবে।’