সাধের পালংক

অরূপ পালিত »

আরজু অফিস থেকে ফিরে স্ত্রী রাত্রিকে প্রতিনিয়ত গল্প শোনাতে থাকে। এক্সেস রোডে এখন বিশাল বিশাল ফার্নিচারের দোকান হয়েছে। তুমি একদিন চলো না। সন্ধ্যা নামলে রঙিন লাইটের আলোতে ফার্নিচারগুলো কি সুন্দর না লাগে। দেখলে তোমারও মন জুড়িয়ে যাবে।

রাত্রির সুন্দর জবাব। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখ, তাই না ? এইসব দেখলে প্রেসার বেড়ে যাবে।

দেখ, একদিন না একদিন সেখান থেকে একটা খাট কিনে তোমাকে ঘুম পাড়াবো।

স্ত্রী রাত্রি আরজু কথাগুলো তেমন পাত্তা দেয় না। অভাবের সংসারে এইসব কথাগুলো শুনলে রাত্রির গায়ে আরো জ্বালা ধরে যায়। মুখের ভিতরের কথা চিবিয়ে রেখে আরজু কে বলে, মরণের পরে সে খাটে আমাকে কোলে করে শুইয়া দিও। রাত্রি আরজুকে বেশি কিছু বলে না। সোজা-সরল মানুষ। রাত্রি মুখ থেকে যদি একবার বের করেন আমার এই জিনিসটা দরকার। পয়সা না থাকলেও কারো কাছ থেকে ধার করে হলেও রাত্রির জন্য সে জিনিস নিয়ে আসবে। রাত্রিকে আরজু প্রচ- ভালবাসে।

গতবছর বন্ধু সুভাষ বাবু থেকে ঈদের বাজারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা ধার করে নিয়ে এসেছিল। বলেছিল ঈদের বোনাস পেলে দিয়ে দেবে। কিন্তু সে  টাকা দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। শেষমেশ রাত্রির কানের দুল বিক্রি করে সেই টাকা পরিশোধ করতে হয়।

আরজু  প্রতিদিন মনে মনে বলে এইবার চোখ-মুখ গুঁজে একটা খাট  কিনবেন। ফ্লোরে শুয়ে বউ-বাচ্চা দুইজনকে  প্রতিমাসে ঠান্ডার জন্য ডাক্তার দেখাতে হয়।

এইবার খাট কিনতে স্ত্রী রাত্রি নিজের থেকে রাজি হয়েছেন। বাপের বাড়ি থেকে বাবা-ভাইয়া ঈদের কাপড়-চোপড়ের জন্য যে টাকা দিয়েছে সেগুলো দিয়ে খাট কিনবেন।

এক্সেস রোডে বেশ কয়েকটি দোকানে দুজনে মিলে ঘুরে দেখেন। দাম নাগালের বাইরে।

একজন সেলসম্যান এসে বলল, ভাই আপনার যে বাজেট, আপনি ভাটিয়ারী চলে যান। সেখান থেকে কমদামের মধ্যে সুন্দর সুন্দর পুরাতন জাহাজের খাট কিনতে পাওয়া যায়। আর না হলে আসকার দিঘির পাড়েও কম দামে সুন্দর খাট বিক্রি হয়। সেখানে চলে যান। আমাদের গুলো আপনার রেঞ্জের বাইরে।

আসকার দিঘির পাড় থেকে কম দামের ভেতরে একটা সুন্দর খাট পছন্দ হয়। খাট কিনে দুজন বাসায় চলে আসে। বাসায় এক বুড়ো ভ্যানওলা খাটটি নিয়ে আসে। লোকটার কষ্ট দেখে আরজু নিজে সাহায্য করতে যান। বুড়ো লোকটা ভ্যানের একপাশ দিয়ে খাটের সামনের অংশ টান দিতেই খাটের আরেক পাশ ছুটে এসে আরজুর পায়ের মধ্যে পড়ে। আরজুর পায়ের একটা আঙুল দুভাগ হয়ে যায়। সারাজীবনের জন্য ক্ষত হয়ে যায় আরজুর পা। অনেক দিন কষ্ট পায়। ছয়মাস ধরে বসে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে যায়। পাড়ার সবাই বলে আরজুর ওপর জিন না হলে ভূতে আসর করেছে। স্ত্রী রাত্রি পাড়ার ফকির বাবাকে নিয়ে আসে। উনি এসে রাত্রিকে বললেন, তোর স্বামী যে বেঁচে আছেন কিন্তু তোর ভাগ্যের কারণে। তোর ঘরে মরা মানুষের আত্মা এবং জিন একসাথে ভর করেছে। ফকির বাবা বললেন, তোর স্বামীর আরো রক্ত ঝরবে। তুই তোর রুমের ভেতর থেকে খাটটি বাইরে ফেলে দিয়ে আয়। উনি মসজিদের ইমাম সাহেবের দিয়ে শেফা খতমপাঠ, মিলাদ ও দোয়ার ব্যবস্থা করতে বলেন। আরজুকে জিনের আসর থেকে রক্ষার জন্য কয়েকবার ঝাড়ু পেটা দেন। গলায় লাল সুতা দিয়ে তাবিজ ঝোলানো এবং লম্বা বাঁশের খুঁটিতে লালপতাকা ওড়াতে নির্দেশ দেন।

আরজু ফকির-ওঝা কিছুতে বিশ্বাস করে না। দুহাতে ক্র্যাচের ওপর ভর দিয়ে দোকানদারের কাছে যায়। দোকানদারকে পুরো ঘটনা বলতে দোকানদার আরজুকে ধমক দিয়ে বলে, ধুর মিয়া, পাগল নাকি?

অভাবের কারণে আরজু স্ত্রী-সন্তানদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

কোতায়ালি থানার এসআই টুটুল সাহেব আরজুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। উনাকে সব কথা বলার পর আরজু তাকে নতুন কিছু তথ্য দেয়। ঘুমের মধ্যে বেশ কয়েকবার ওই খাটের নিচে টপটপ করে পানি পড়ার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। ওই খাটের আশপাশে হাঁটতে লাগলে মনে হয় কেউ লুঙ্গি টেনে ধরে। বেশ কয়েকবার আরজুর লুঙ্গি আটকা পড়েছে। পা ছিঁড়ে গেছে কয়েকবার।

কিন্তু খাটের নিচে উঁকি মেরে দেখলে রাত্রি আরজু বলে ওঠে, এই খাটে তোমার যখন এতো জ্বালা ঘরের বাইরে ফেলে দিয়ে এসো না। সারাদিন সংসারে এতো খাটাখাটুনির পর একটু শান্তিতে ঘুমাবো সে কপালও নেই আমার। আরজু কাউকে কিছু বলতে ও বোঝাতে পারছে না।

খাটের নিচে একটা স্ক্রুতে আরজু দেখেছেন রক্তমাংসের কণা লেগে আছে। স্ত্রী রাত্রি  ভয় পাবেন বলে তাকে আর বলেননি।

টুটুল সাহেবের মাথার মধ্যে এসব কথা দারুণভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। আরজু মোবাইলে টুটুল সাহেবকে স্ক্রুর ছবিও দেখালেন। টুটুল সাহেব ভাবতে লাগলেন মাংসের কণা কিভাবে এলো। আর যারা এই খাট ফিটিং করেছে তারা একটু হলেও দেখেননি।

আরজু যে দোকান থেকে খাট কিনেছেন সেখানে ওসি টুটুল সাহেব গিয়ে হাজির। দোকানদার ভয় পেয়ে যান। উনি টুটুল সাহেবকে বললেন, স্যার আমি পুরাতন ফার্নিচরের ব্যবসা করি ঠিক। কিন্তু এমন কথা কারো কাছ থেকে তো শুনিনি খাটের মধ্যে কোন অশুভশক্তি থাকতে পারে। এই খাটটি আমি কিনেছিলাম লালখান বাজার এক বিদেশি ভদ্রলোকের কাছ থেকে। উনি সপরিবারে বিদেশে যাওয়ার আগে আমার কাছে খাটসহ অনেক কিছু বিক্রি করে গেছেন। তবে লোকটা তেমন চালাক না স্যার। বেশ কমদামে উনার থেকে এসব জিনিস কিনেছিলাম। দোকানদার থেকে ঠিকানা নিয়ে টুটুল সাহেব সেখানে যান। ভদ্রলোককে সেই বাসায় পাওয়া যায়। উনাকে জিজ্ঞেস করতে বলেন, স্যার বিদেশ থেকে এসে দেখি আমার সবকিছু শেষ। আমার স্ত্রী ছিলেন মানসিক রোগী। আমার মাকে সে সহ্য করতে পারতো না বলে বাসায় আমার মা ওকে একা ফেলে রেখে চলে যায়। কথায় কথায় আমার মার ওপর রেগে যেত। কখন যে আমার সন্তানকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে মেরে ফেলেছে মনে হয়, সে নিজেও বুঝতে পারেনি। ছেলেটাকে জড়িয়ে নিয়ে মনে হয় তিন-চার দিন বসেছিল। তাই ছেলেটার শরীরে পচন ধরে যায়। গন্ধ পেয়ে আশপাশের লোকজন এসে ছেলেটাকে মাটি দেয়।আপনি এই মানসিক রোগীকে একা কেন বাসায় রেখেছিলেন ?

বললাম না স্যার,সে আমার মাকে সহ্য করতো না। আমার মা সেই জন্য ওকে একা রেখে দেশের বাড়িতে চলে যায়।

স্যার সে সব সময় ভালো থাকতো। কখন যে রেগে উঠতো সে নিজেও জানতো না। আশপাশের লোকজনের সাথে কোন সময় খারাপ ব্যবহার করতো না। শুধু আমার মাকে দেখতে পারতো না সে।

আমি এসে ওকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে দিয়ে আসি। মনে করেছিলাম সব বিক্রি করে বিদেশে চলে যাবো। সব বিক্রিও করেছিলাম। কিন্তু যাবার আগের রাতে আমার ছেলেটা দেখি দরজার সামনে এসে আমাকে বলে, আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে যাও না, বাবা। আমি একা একা এখানে থাকতে পারছি না। এইখানে খুব গরম। সেই রাতে আমি আমার ছেলের কবরে গিয়ে দেখলাম, ছেলেটা সেখানে হামাগুড়ি দিচ্ছে। মনে হয় ছেলে আমার কবরের ভেতরে গরম সহ্য করতে পারছে না। সে জন্য আমার ছেলে রাত হলে কাছে চলে আসে। ছেলেকে এই অন্ধকার ঘরে একা রেখে কার জন্য আমি রোজগার করতে যাবো স্যার। তবে স্যার ওই খাটের ওপর আমার ছেলেটা ঘুমাতো। খুব শখ করে এই খাটটি বানিয়েছিলাম স্ত্রী-সন্তানের জন্য। এখন কিন্তু ওই খাটটি আমার কেনার সামর্থ্য নেই স্যার।

টুটুল সাহেব সারারাত ধরে চিন্তা করতে থাকেন। বন্ধুকে কি বলবেন। মাথার মধ্যে দারুণ বুদ্ধি এলো। আরজু কে থানায় এনে একটা ধমক দিয়ে বললেন। শালা, তোর জন্য আমি দোকানদারকে শুধু শুধু অপমান করলাম। আমাকে তোর পা টি দেখাতো।

আরজুকে টুটুল সাহেব বলেন, দেখ দোস্ত তোর পায়ে যখন খাটটি পড়েছিল। তখন তোর পায়ের আঙুলের থেকে মাংস  স্ক্রুতে ছিঁড়ে লেগেছিল। আর সেটাকে দেখার পর থেকে তোর মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। এই সামান্য কিছুকে তোর মনের মধ্যে ভূত-পেতœীর ভয় জেগে আছে। কারণ তোর বউকে ফকিরে বলতে শুনেছিস, তোকে জিনে আসর করেছে। সবকিছু ভুয়া। তোকে একটা ভালো পরামর্শ দিই। একটা সাইকোলজির ডাক্তার দেখা। আর রাতে শোয়ার সময় দোয়া পড়ে ঘুমাবি। এখন বাসায় যা। খাটটি যদি ব্যবহার করতে ইচ্ছে না করে, ভাবি আসার আগে এতিমখানায় দিয়ে আসিস। আরজু বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়েন। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখেন। আরজুর বুকের ওপরে ছোট একটা বাচ্চা ছেলে তপাস তপাস করে খেলছে । আরজু বা বা রে বলে একটা চিৎকার দিয়ে ওঠে। চোখ খুলে নিজেকে দেখেন তিনি হাসপাতালে ভর্তি। কত মানুষ তাকে দেখতে আসছে।