শীতের রাতে পানিতে ভেসে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা

সরকারি বন দখল করে কৃত্রিম লেক

নিজস্ব প্রতিনিধি, সাতকানিয়া »

সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় সরকারি বন দখল করে প্রাকৃতিক হ্রদের ওপর প্রভাবশালীরা বাধ দিয়ে কৃত্রিম লেক নির্মাণ করেন। সরকারি বনভূমি জবর দখল করে অবৈধভাবে নির্মিত লেকে শনিবার (৩ জানুয়ারি) বন বিভাগ অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় বন বিভাগ অবৈধ এ লেকের বাধ কেটে দিয়ে বদ্ধ পানি ছেড়ে দেয়। বিকাল সাড়ে ৩টায় বাঁধ কাটার অভিযান শুরু হয়ে টানা রাত সাড়ে ৯ টা পর্যন্ত চলে।
হঠাৎ করে ঘোষণা ছাড়া ওই বাধ কেটে দেয়ায় শীতের রাতে পানিতে ভেসে গেছে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা, অর্ধশতাধিক মাটির ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। পানির প্রবল তোড়ে উপজেলার সোনাকানিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র মির্জাখীল বাংলাবাজার পুরোটাই পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বাধ কাটা পানির প্রবল স্রোতে ১টি স্লুইসগেট ভেঙে গেছে। এমন আকস্মিক পানির স্রোতে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমির ধানের চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এলাকাবাসী জানায়, রাতে লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়ার পর পশ্চিমের পাহাড় থেকে বাধের পানি পার্শ্ববর্তী সাতকানিয়ার সাইরতলী, তাঁতীপাড়া ডুবে যায়। এরপর একে একে কুতুবপাড়া, মঙ্গলচাঁদ পাড়া পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। এই পানি একসময় এসে পৌঁছায় সোনাকানিয়ার মির্জাখীল গ্রামে। মির্জাখীল বাংলাবাজার ব্যবসায়িদেও প্রচুর মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে বাংলাবাজারের ভাসমান দোকানিদের পণ্যসামগ্রী মুহূর্তেই পানিতে ভেসে যায়।
পানির স্রোতে উপজেলার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাইরতলী পাড়ার ইউসুফ আলী, মোস্তাক, খুলু মিয়া, আহমদ মিয়া, নুর আলম, নুর মোহাম্মদ ছাফর, মোজাফ্ফর আহমদ আবদুল কাদের, আবদুল হামিদ, মো. সমশু, আবদুল আজিজ, মো.মিন্টু, মোছাম্মৎ জামিনা, ওয়াহেদ আলী, মোবারক হোসেন ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়াহাব মিয়া, শফিকুল ইসলাম ও মো.তারেকের ঘরসহ অর্ধশতাধিক কাঁচাঘর সম্পূর্ণ ধসে পড়ে।
ফসলি জমির আলু, মরিচ, শসাক্ষেসহ শীতকালীন সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এলাকার বেশ কিছু পুকুর ডুবে মাছ ভেসে গেছে। রাতে অনেকের হাঁস-মুরগি পানিতে ভেসে গেছে।
জানা যায়, সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার সোনাকানিয়া ও বড়হাতিয়া বনের প্রায় আড়াই হাজার একর বনভূমি জবর দখল করে কৃত্রিম হ্রদ তৈরি করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। অবৈধ এ লেকে মাছ চাষ করা হয়েছিল। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এ লেক নির্মাণ করা হয়। লেকটি তৈরি করা হয়েছে সরকারি বনের ভেতরে সোনাকানিয়া নামের একটি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে। বাঁধের দৈর্ঘ্য ২০০ ফুটের, প্রস্থ ২০ ফুট ও উচ্চতা ১০০ ফুট।
বন বিভাগের দাবি, সরকারি বনভূমি অবৈধভাবে দখল করে লেক নির্মাণের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া মিলে। অতপর জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করলেও পরে তা’ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তিন বছর আগে লেক নির্মাণ করা হলেও তা অপসারণ করার কোনো উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হয়নি। শনিবার এ বাঁধ কেটে দেওয়ার পদক্ষেপ নেন বন বিভাগ।
এ লেকের বাঁধ কাটা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের সদরের সহকারী বন সংরক্ষক মারুফ হোসেন এবং দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক দেলোয়ার হোসেন। এ ছাড়া বন বিভাগের ফরেস্টার ও ফরেস্ট গার্ডসহ প্রায় ৬০ বনকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
সহকারী বন সংরক্ষক মারুফ হোসেন ও দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিভাগীয় বন কর্মকর্তার নির্দেশে বাঁধ অপসারণ শুরু করেছি। এ অবৈধ লেকের বাঁধ পুরোপুরি কেটে দেয়া হবে। এরপর এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পেশ করা হবে। সরকারি বনভূমি অবৈধ দখলের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে বাধ কেটে পানি প্রবাহের পথ তৈরি করে দেয়ায় বাঁধ এলাকায় অবৈধভাবে নির্মিত টিনের ঘর ভেঙে দিয়েছেন এলাকার ক্ষুব্ধ কৃষকেরা।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত কৃষকরা বলেন, শনিবার ছিল তাদের অনেক বড় খুশির দিন। কেননা এই বাঁধের কারণে তাদের কৃষিজমি নষ্ট হয়েছে। পানি না থাকায় চাষাবাদ করতে পারেনি। বনে অবৈধভাবে বাঁধ দেয়ায় তারা দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন বাঁধ কেটে দেয়ায় পূর্বের মতো পানি চলমান থাকবে, চাষাবাদের প্রতিবন্ধকতাও দূবে।
বন বিভাগের দাবি, কৃত্রিম লেক তৈরির কারণে গামারি, সেগুন, চিকরাশি, অর্জুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় প্রায় পাঁচ লাখ গাছ মারা গেছে। লেকে ডুবে যাওয়া জায়গার মধ্যে বন্য হাতির চলাচলের পথ ছিল। খ্যাঁকশিয়াল, শজারু, বন্য শূকর, বনমোরগ, ময়ূর, গুইসাপ, অজগরসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী এবং নানা প্রজাতির প্রাণী বাস করত। অবৈধ কৃত্রিম লেকের কারণে এ জীব বৈচিত্র অনেকটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে।
কৃষকেরা বলছেন, বাঁধ দিয়ে লেক সৃষ্টির কারণে ছড়ার পানি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে লোহাগাড়া ও সাতকানিয়ার ৪ হাজার ২৫৫ একর জমির চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে।
বনের আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা বলেন, লেকে শুষ্ক মৌসুমে পানির গভীরতা থাকে ৪৫ ফুট আর বর্ষায় গভীরতা বেড়ে প্রায় ৬০ ফুট পর্যন্ত হয়। সেখানে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করা হয়। লেকে নিয়মিত বড়শি প্রতিযোগিতার নামে জুয়া চলত।
স্থানীয় সূত্র বলছে, লেক তৈরির সঙ্গে জড়িতরা মূলত সেখানে অবৈধভাবে একটি বড় পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলো।
উপজেলার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো. মহিউদ্দীন, আইয়ুব জমাদার ও সৈয়দ হোসেন জানান, বাঁধের পানির কারণে দেড় কোটি টাকার স্লুইসগেট, কাঁচা বাড়িঘর, ১২ একর ফসলি জমির ক্ষেতসহ পুকুরের মাছ ভেসে গিয়ে অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে।
সোনাকানিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দীন জানান, বিনা নোটিশে বাধের পানির ছেড়ে দেয়ার কারণে ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও সাড়ে ৩ শতাধিক বাড়ি আংশিক ক্ষতি হয়েছে। সবজিক্ষেত, পুকুরের মাছ, রাস্তাঘাট, বাজারসহ ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তবে সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, বাধের পানিতে আনুমানিক ১৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন বিশ্বাস জানান, বাঁধের পানিতে স্লুইসগেট, অর্ধশতাধিক বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, সবজিক্ষেত, মাছ, বোরোক্ষেত, বাজারের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।