লোকদেখানো কিছু করতে চাই না

কর্পোরেশনের ৬ষ্ঠ নির্বাচিত পরিষদের প্রথম সভায় মেয়র

১০০ দিনের কাজ বাস্তবায়নে তাগিদ দিলেন কাউন্সিলরদের
প্যানেল মেয়র নির্বাচন হয়নি

পরিচ্ছন্ন বিভাগের অনেকেই হাজিরা দেন কিন্তু কাজে নেই
মশার ওষুধ ছিটানোর জন্য নিম্নমানের মেশিন কেনা হয়েছে
সড়কবাতিগুলোর বেশিরভাগই ২/১ মাস পর নষ্ট হয়ে যায়

নিজস্ব প্রতিবেদক :
অনুষ্ঠিত হলো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নব নির্বাচিত পরিষদের প্রথম সভা। সভায় কাউন্সিলরদের ১০০ দিনের বার্তার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলেন নবনির্বাচিত মেয়রর রেজাউল করিম চৌধুরী। এতে অগ্রাধিকারে থাকবে মশক নিধন, পরিচ্ছন্নতা ও সেবা কার্যক্রম। এমনকি মশক নিধনে ওষুধ ব্যবহারে গুণগত মান যাচাইয়েরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। একইসাথে সড়ক বাতির বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলেছেন। গতকাল নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে নির্বাচিত কাউন্সিলর, সিটি কর্পোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বিধি অনুযায়ী এ সভার তারিখ থেকেই আগামীর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তারিখ বিবেচনায় আনা হয়ে থাকে।
মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছেন, কর্পোরেশনের ৬ষ্ঠ নির্বাচিত পরিষদ একটি যৌথ পরিবার। একই ছাতার নিচে আমরা থাকি। একে অপরকে জানতে হবে, বুঝতে হবে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে কাজ ভাগাভাগি করে সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করতে হবে। নগরবাসী আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করে আমাদের নির্বাচিত করেছেন। তাদের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিদান দিতে হবে।
চট্টগ্রামকে পরিকল্পিত অত্যাধুনিক বিশ্বমানের নগরীতে পরিণত করার কথা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, অতীত নিয়ে কিছু বলতে চাই না। এখন যা আছে তা নিয়েই যাত্রা শুরু করে দিয়েছি। প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিক জরুরি কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতিটি ওয়ার্ডে পর পর দু‘দিন মশকনিধন, পরিচ্ছন্নতাসহ জরুরি সেবামূলক কার্যক্রম চলবে। এ কাজে যারা নিয়োজিত তাদের তদারক ও নির্দেশনা দেবেন কাউন্সিলররা। নিয়োজিত জনবলের প্রতিদিনের নির্ধারিত কর্মঘণ্টাকে তারাই কাজে লাগাবেন। কাউন্সিলররা যথাযথ তদারকি করলে ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনার সুফল পাবে নগরবাসী।
সাধারণ সভায় কাউন্সিলরদের উত্থাপিত মতামত,অভিযোগ ও পরামর্শের প্রেক্ষিতে মেয়র বলেন, নীতি ও ন্যায্যতার প্রশ্নে কখনো মাথা নত করবো না। যে সকল অবৈধ দখরদার এবং নালা- নর্দমা-খালের উপর অবৈধ স্থপনা তৈরি করেছে তারা যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন তাদের তিল পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে না।
তিনি নগরীতে হাইরাইজ ভবন নির্মাতাদের পাইলিংয়ের মাটিভরা তরল বর্জ্য নালা-নর্দমা খালে ফেলে পানি প্রবাহের পথ ভরাট করার সমালোচনা করে বলেন, এরা বিবেক বর্জিত দুষ্টু প্রকৃতির অপদার্থ। তাদের কারণেই নালা-নর্দমা-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এদের আইনের আওতায় এনে জরিমানাসহ বিধিবদ্ধ শাস্তিভোগ করতে হবে।
তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, কর্পোরেশনের জায়গায় কেউ হাত দিতে পারবে না। এসব জায়গা রাষ্ট্রীয় সম্পদ। যারা এর কোন অংশ অন্যায়ভাবে হস্তগত করেছেন সেখান থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হবে। তিনি প্রশ্ন করেন, ফুটপাত থেকে বারবার হকারদের উচ্ছেদ করার পর আবার বেদখল হয়ে যায় কেন? ধীরে সুস্থে এই সমস্যার পরিকল্পিত সমাধান নিশ্চিত করতে হবে। আমি তড়িঘড়ি করে লোকদেখানো কিছু করতে চাই না। তিনি জলাবদ্ধতা নিরসনে সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করে বলেন, এই প্রকল্পের ৪০ ভাগের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে চাক্তাই খালসহ বিভিন্ন খালে কিছু স্থানে বাঁধ দেয়ায় পানি চলাচল রুদ্ধ হয়ে গেছে। তাই বর্ষা মৌসুমে ওভার-ফ্লো হতে পারে। এ কারণে এ বছরও জলাবদ্ধতা মুক্ত হওয়া যাবে না। তিনি প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের খালের যে অংশে বাঁধ দেয়া হয়েছে সেখানে পানি চলাচলের জন্য বিকল্প পথ তৈরি করে দেয়ার পরামর্শ দেন। তিনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগ নিয়ে কিছু প্রশ্ন আছে বলে মন্তব্য করে বলেন, পরিচ্ছন্ন বিভাগের অনেকেই আছেন যারা হাজিরা দেন কিন্তু কাজে নেই। কোন স্তরে কত জনবল আছে তা জানতে হবে এবং কারা কি কাজ করছে, কর্মঘণ্টা কতক্ষণ তা যাচাই-বাছাই করে এই বিভাগতে ঢেলে সাজানো হবে। কেননা সিটি কর্পোরেশনের একটি টাকাও অপচয় করা যাবে না।
মশক নিধন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মশক নিধনের যে ওষুধ ছিটানো হয়, তাতে কাজ হচ্ছে না বলে অভিমত রয়েছে। আমি এই ওষুধের কার্যকারিতা মাননির্ণয় ও কেমিক্যাল টেস্ট আছে কিনা তথ্য জানতে বলেছি। তিনি উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মশার ওষুধ ছিটানোর জন্য যে স্প্রে মেশিনগুলো কেনা হয়েছে সেগুলো নিম্নমানের। অনেকগুলো অচল হয়ে গুদামজাত হয়েছে। একইভাবে বিদ্যুৎ বিভাগ যে সড়কবাতিগুলো কিনেছে যেগুলোর বেশিরভাগই ২/১ মাস পর নষ্ট হয়ে যায় । তাই সড়ক আলোকায়ন সুচারুভাবে সম্পাদন হচ্ছে না। ফলে বড় এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকায় নাগরিক অস্বস্তি আছে। তিনি আরো বলেন, নগরীর বেহাল সড়কগুলো মেরামত করতে যে পরিমাণ বিটুমিন দরকার সে পরিমাণ মজুদ নেই। যা আছে তাও নিম্নমানের। তিনি আরো বলেন, ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মান সম্পন্ন সরঞ্জাম, সামগ্রী ক্রয় ও সংগ্রহ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তিনি কাউন্সিলরদের উদ্দেশ্যে বলেন, ঠিকাদাররা ওয়ার্ডে যে কাজগুলো করছে তা তাদের যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। কাজের মান বিচার তারাই করবেন। কাজের মান নিয়ে কাউন্সিলরদের সম্মতি মন্তব্য ছাড়া ঠিকাদাররা বিল পাবেন না। তিনি অবনতিশীল চসিকের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী থাকাকালীন স্বাস্থ্য বিভাগের জৌলুস ছিলো। মেমন হাসপাতালে প্রসূতি ভর্তির জন্য তদবির করতে হয়। এখন এখানে রোগী নেই। স্বাস্থ্যবিভাগে প্রয়োজনীয় জনবল ও সরঞ্জাম নেই। বিভিন্ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভবনগুলো জীর্ণ দশায়। কোন আরবান হেলথ কমপ্লেক্স স্বাস্থ্যের বাইরে অন্য অফিসে চলছে। এই আরবান হেলথ এডিপি প্রকল্পের অধীন এবং তাদের অনুদান নির্ভর। অনুদানের শর্ত অনুযায়ী স্বাস্থ্যের বাইরে আরবান হেলথ কমপ্লেক্সের স্থাপনা ব্যবহৃত হলে অনুদান বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি প্রকৌশল বিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ধীর গতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এতে আমাদের সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে। ঠিকাদাররা চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে চলেছেন। কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
তিনি সকল স্তরের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, সিটি কর্পোরেশনে চলে নগরবাসীর কর দিয়ে। তাই তাদের পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের দায়বদ্ধতা আছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব মফিদুল আলমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সাধারণ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হকের স্বাগত ভাষণের পর বক্তব্য রাখেন কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু, শহিদুল আলম, জহরলাল হাজারী, প্রফেসর নিছার উদ্দীন আহমেদ মঞ্জু, মো. সলিমুল্লাহ, গাজী মো. শফিউল আজিম, গোলাম মোহাম্মদ জোবায়ের, শৈবাল দাশ সুমন, মো. নুরুল আমিন, মো. সাহেদ ইকবাল বাবু, মো. শফিকুল ইসলাম, মো. কাজী নুরুল আমিন, মো. হারুনুর রশিদ, নুরুল হক, হাসান মুরাদ বিপ্লব, পুলক খাস্তগীর, মো. আরশেদুল আলম, গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী, মো. মোবারক আলী, চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, মো. মোর্শেদ আলম, আবদুল সবুর লিটন, গিয়াস উদ্দিন, আবুল হাসনাত মো. বেলাল, নাজমুল হক ডিউক, মো. ইসমাইল, আফরোজা কালাম, নীলু নাগ, জিয়াউল হক সুমন, আঞ্জুমান আরা, রুমকী সেনগুপ্ত, আতাউল্লাহ চৌধুরী, মো. মোরশেদ আলী, মো: এসারুল হক, মো.ওয়াসিম উদ্দীন চৌধুরী, ছালেহ আহামেদ,নজরুল ইসলাম বাহাদুর, শেখ জাফরুল হায়দার চৌধুরী, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারেক। এছাড়া চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো.ফজলুল্লাহ, চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া, মেয়রের একান্ত সচিব মোহাম্মদ আবুল হাসেম, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী, উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) জয়নাল আবেদিন অতিরিক্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোর্শেদুল আলম চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোর্শেদ, বিভিন্ন সরকারি ও সেবা সংস্থার. প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।
সভায় চসিকের পঞ্চম নির্বাচিত পরিষদের কাউন্সিলর মাজহারুল হক চৌধুরী, তারেক সোলায়মান সেলিমসহ করোনাকালে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন ও মুনাজাত করা হয়।
প্যানেল মেয়র নির্বাচন হয়নি
প্রথম সভায় প্যানেল মেয়র নির্বাচন করার কথা থাকলেও গতকাল তা হয়নি। বিধি অনুযায়ী প্রথম সভার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে তা করতে হয়। গত টার্মের প্যানেল মেয়র জোবাইরা নার্গিস করোনা আক্রান্ত থাকায় তিনি এখনো শপথ নেননি। অপরদিকে আলকরণ ওয়ার্ডের নির্বাচন আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি। সেই হিসেবে আগামী সাধারণ সভার আগেই প্যানেল মেয়র নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে জানা যায়।