লাখো মুসলমানের ‘লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখর আরাফাত

হজের খুতবায় আল্লাহভীতি অর্জনের আহ্বান

সুপ্রভাত ডেস্ক »

নামাজ, দোয়া ও অন্যান্য ইবাদতে নিমগ্ন থাকার মধ্য দিয়ে আরাফাতের ময়দানে সারাদিন কাটিয়েছেন লাখ লাখ মুসলমান। গতকাল ২৫ লক্ষাধিক হাজির লব্বাইক ধ্বনিতে মুখর ছিল এ ময়দান। করোনাকালের দীর্ঘ তিন বছরের বিধি-নিষেধের পর ১৬০টি দেশ থেকে ২৫ লাখের বেশি মুসলিম এবারের হজে অংশ নেন। তাদের সবার মুখে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।

‘অর্থাৎ আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো অংশীদার নেই। আমি হাজির। সব প্রশংসা ও অনুগ্রহ শুধুই তোমার। সব রাজত্ব তোমার।

গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মসজিদে নামিরা থেকে খুতবা দিয়েছেন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য শায়খ ইউসুফ বিন মুহাম্মদ।

এবার বাংলাসহ বিশ্বের ২০টি ভাষায় এ খুতবার অনুবাদ সম্প্রচারিত হয়েছে। বাংলা অনুবাদ কার্যক্রমে ছিলেন মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ড. খলীলুর রহমান, আ ফ ম ওয়াহিদুর রহমান, মুবিনুর রহমান ফারুক ও নাজমুস সাকিব।

খুতবায় শায়খ ইউসুফ সমবেত মুসলিমদের তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি অর্জনের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্য অর্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

বিদায় হজে মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রদত্ত বক্তব্য অনুকরণ করে তিনি বলেছেন, ‘হে মানুষ, তোমাদের রব একজন। তোমাদের পিতা একজন। অনারবের ওপর কোনো আরবের বিশেষ মর্যাদা নেই। কোনো আরবের ওপর অনারবের বিশেষ কোনো মর্যাদা নেই। তাকওয়া ছাড়া কালো বর্ণের ওপর লাল বর্ণের বিশেষ মর্যাদা নেই।

আল্লাহ তোমাদের ওপর পারষ্পরিক রক্তপাত, ধনসম্পদ লুট ও সম্মানহানিকে নিষিদ্ধ করেছেন। যেমন তিনি তোমাদের এই দিবসকে এই শহরকে এই মাসকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন।’

এ সময় তিনি মুসলিম উম্মাহকে সব ধরনের মতপার্থক্য ছেড়ে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। জীবনের সবক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ অনুসারে জীবন পরিচালনার নির্দেশনা হয় খুতবায়। একই সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়েছে। মুসলিমদের জন্য করণীয় বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয় হজের খুতবায়।

এ বছর হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে রোববার। পবিত্র নগরী মক্কায় কাবা শরিফ তাওয়াফ করে রাতে এশার নামাজের পর সবাই জড়ো হতে শুরু করেন ১০ কিলোমিটার দূরে তাঁবুনগরী মিনায়।

সোমবার সারা দিন ও রাত তারা সেখানে কাটান ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে। আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় তারা জিকির করেন, নামাজ পড়েন জামাতে।
হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার জন্য মঙ্গলবার ভোরের আগেই তারা সমবেত হতে থাকেন আরাফাতের ময়দানে।

ইসলামী রীতি অনুযায়ী, জিলহজ মাসের নবম দিনটি আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে ইবাদতে কাটানোই হল হজ।

সেলাইবিহীন শুভ্র এক কাপড়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তারা আরাফাতের ময়দানেই থাকেন। যার যার মত সুবিধাজনক জায়গা বেছে নিয়ে ইবাদত করেন; হজের খুতবা শুনেন।

চার বর্গমাইল আয়তনের এই বিশাল সমতল মাঠের দক্ষিণ দিকে মক্কা হাদা তায়েফ রিং রোড, উত্তরে সাদ পাহাড়। সেখান থেকে আরাফাত সীমান্ত পশ্চিমে আরও প্রায় পৌনে এক মাইল বিস্তৃত।

মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, আদি পিতা আদম ও আদি মাতা হাওয়া পৃথিবীতে পুনর্মিলনের পর এই আরাফাতের ময়দানে এসে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। ১৪০০ বছরের বেশি সময় আগে এখানেই ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) দিয়েছিলেন তার বিদায় হজের ভাষণ।

এই আরাফাতে উপস্থিত না হলে হজের আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণাঙ্গ হয় না। তাই হজে এসে যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাদেরও অ্যাম্বুলেন্সে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হয় স্বল্প সময়ের জন্য।

প্রতিবছরের মতো এবারও হজের দিন ভোরে কাবা আচ্ছাদিত করা হয় নতুন গিলাফে। মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর সভাপতির তত্ত্বাবধানে ফজরের নামাজের পর নতুন গিলাফ পরানো হয়।

আরাফাতের ময়দানের আনুষ্ঠানিকতা সেরে আবারও মিনায় ফেরার পথে সন্ধ্যায় মুযদালিফায় মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করেন মুসলমানরা। মুজদালিফায় রাতে থাকার সময় তারা পাথর সংগ্রহ করবেন, যা মিনার জামারায় শয়তানের উদ্দেশ্যে ছোঁড়া হবে।

বুধবার সকালে মিনায় ফিরে সেই পাথর তারা প্রতীকী শয়তানকে লক্ষ্য করে ছুঁড়বেন। এরপর কোরবানি দিয়ে ইহরাম ত্যাগ করবেন এবং সবশেষে কাবা শরিফকে বিদায়ী তাওয়াফের মধ্যে দিয়ে শেষ হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ বুলেটিন সূত্রে জানা যায়, এ বছর বাংলাদেশ থেকে হজব্রত পালন করতে এক লাখ ২২ হাজার ৮৮৪ জন সৌদি আরব গেছেন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ২৬ হজযাত্রী মক্কা ও মদিনায় মারা গেছেন। বাংলাদেশি হজযাত্রীদের ফিরতি ফ্লাইট আগামী ২ জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২ আগস্ট পর্যন্ত চলবে। করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালে কঠোর বিধি-নিষেধের মধ্যে সৌদিতে অবস্থানরত ১০ হাজার ও ২০২১ সালে ৬০ হাজার মুসলমান হজ পালন করেন। ২০২২ সালে করোনা বিধি মেনে বিশ্বের প্রায় ১০ লাখ মুসলমান হজ পালন করেন। করোনার আগের বছর ২০১৯ সালে প্রায় ২৫ লাখ মুসলমান হজ করেন।