রোহিঙ্গা ইস্যু কি চাপা পড়ে গেছে!

সুভাষ দে »

সাম্প্রতিককালে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিশ্বব্যাপী তেমন কূটনৈতিক তৎপরতা নেই। বিশ্বের কিছু দেশ এবং জাতিসংঘ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশকে প্রশংসাবাণী দিচ্ছে প্রতিনিয়ত কিন্তু সমস্যার প্রকৃত সমাধানটির ব্যাপারে জাতিসংঘ, বিশ্ব সম্প্রদায় অনেকটা নিশ্চুপ এখন। সম্প্রতি ভাসানচর যেখানে কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে সেটি জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কর্মকর্তারা দেখে গেছেন, তারা উন্নত মানের ব্যবস্থা করায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। বেশ কিছুদিন আগে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতগণ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতি ভলকান বজকির কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনকালে বলেন, ‘বিশ্ব এখনো ভোলেনি রোহিঙ্গাদের। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদও মনে রেখেছে রোহিঙ্গাদের’। (সূত্র : সমকালের উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ ৮ জুন)। তাঁর এই আবেগ মানবিক, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতারেসও রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ নানাভাবে জানিয়েছেন।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর এবং তারও আগে থেকে কয়েক দফায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত প্রবল হয়, জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও চীন রাশিয়ার ভূমিকার কারণে নিরাপত্তা পরিষদ কোনরূপ ব্যবস্থা নিতে পারেনি, তবে গাম্বিয়ার আবেদনে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শুনানিতে সম্মতি দেয়, একটি শুনানিতে তৎকালীন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষের পক্ষে সাফাই গান। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচির ভূমিকা বিশ্বে নিন্দিত হয়।
রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন এবং তাদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কয়েক দফা বৈঠকও হয় দুই দেশের প্রতিনিধিদের কিন্তু প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি প্রধানত মিয়ানমারের উদাসীনতা ও ছলচাতুরির কারণে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক অভিযান জোরদার করে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিষয়টি আমলে নেয়ায় কূটনৈতিক প্রচারণা কিছুটা সফলও হয়। বাংলাদেশ চীন ও ভারতের ভূমিকার ওপর জোর দেয়। চীন, বাংলাদেশকে প্রত্যাবাসন ব্যাপারে আশ্বস্ত করে, বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে এ ব্যাপারে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কয়েক দফা বৈঠক হয় কিন্তু মিয়ানমার নানা অজুহাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রাখে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সামরিক কর্তৃপক্ষ ও গণতন্ত্রীপন্থি নেত্রী অং সান সু চি মোটামুটি একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে থাকে। গত দেড় বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিশ্ববাসীর কাছে অনেকটা নিষ্প্রভ হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নানাভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেও চীন, রাশিয়া, ভারত, জাপান প্রভৃতি বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি মিয়ানমারকে সমর্থন অব্যাহত রাখায় সেই সব পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হয়নি। ইতিমধ্যে ২০২০ সালের শেষ দিকে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং অং সান সু চির দল ‘এনএলডি’ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই বিজয় মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ভালভাবে নেয়নি। এ বছর ১ ফেব্রুয়ারি নবÑনির্বাচিত পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরুর দিন মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে। অং সান সু চি সহ এনএলডি’র শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার এ ধরণের নিন্দনীয় কাজ নতুন নয়, এর আগে প্রায় অর্ধশতাব্দী যাবত মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় ছিল। গণতান্ত্রিক প্রথায় ফিরে এলেও পার্লামেন্টে তাদের ২৫ শতাংশ সংরক্ষিত আসন রয়েছে, ৩টি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রিত্ব তাদের অধীন, এছাড়া তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি রাজনৈতিক দলও আছে। সামরিক জান্তা সুচির বিরুদ্ধে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনেছে যা হাস্যকর অথচ সু চির দল প্রায় ৭৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে।
তবে মিয়ানমারের জনগণ সহজে জান্তা সরকারকে ছেড়ে দিচ্ছেনা। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮শ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, শিশুরাও রেহাই পায়নি। জান্তা বিরোধী বিক্ষোভ চলছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ফিরিয়ে আনার কথা বলেছে, কিন্তু তাতে কর্ণপাত করছে না জান্তা সরকার। এ ক্ষেত্রে জান্তা সরকারকে চীনের নিঃশর্ত সমর্থন আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে কেননা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় চীনের একটা ভূমিকা আছে। ভারত গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের কথা বললেও সামরিক সরকারকে সমর্থন না দিয়ে পারছেনা চীনের ভূমিকার কারণে। জনগণের বিক্ষোভের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে মিয়ানমারের বিদ্রোহী সশস্ত্র গ্রুপগুলি। তারা ইতিমধ্যে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। জান্তাবিরোধী ছায়া সরকার গঠন, বিদ্রোহী সশস্ত্র গ্রুপগুলি জান্তাবিরোধী সংগ্রামে শামিল হওয়ায় সে দেশে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
মিয়ানমারের ছায়া সরকার (ঐক্য সরকার) এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা ক্ষমতায় গেলে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও তাদের নাগরিক করে নেবে। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের পক্ষেও তাদের অবস্থানের কথা জানিয়েছে ছায়া সরকার (প্রথম আলো ৫ জুন’ ২০২১)। তারা বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের জান্তাবিরোধী চলমান লড়াইয়ে অংশ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে জান্তাদের হঠাতে এনএলডি’র আইন প্রণেতারা এই জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করেছেন। ছায়া সরকারের বিবৃতিতে রোহিঙ্গা শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। এর আগে সু চির এনএলডি সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ‘রাখাইনে বসবাসকারী মুসলিম’ বলে সম্বোধন করা হতো।
জাতিগত ও ধর্মগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, শতাধিক নৃ- গোষ্ঠী সম্বলিত দেশটিতে গত অর্ধশতাব্দী ধরে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী জাতিগত সংখ্যালঘু ও নৃ- গোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন নির্যাতন চালিয়ে আসছে। দেশটির জাতি ও সম্প্রদায়গত সংকটের সমাধান হয়নি বরং মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী, নির্যাতনে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুরে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গারা প্রধানত রাখাইন রাজ্যে বাস করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, তারা তৎকালীন বার্মার স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারেও যোগ দিয়েছিলো। অথচ সামরিক সরকার বিগত শতকের ষাটের দশক থেকেই রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন চালিয়ে আসছে। ১৯৮২ সালের সংবিধানে তাদের নাগরিকত্বের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। এখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা ‘রাষ্ট্রহীন’ নাগরিক। রাখাইনের বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা তাদের ভিটে, জমি ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এদের সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়েছে।
এখন মিয়ানমারে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এক প্রকার অনিশ্চিত হয়ে গেছে, দেশটিতে জনগণের বিদ্রোহ, প্রতিবাদ চলতে থাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ অজুহাতও পেয়ে গেছে। তদুপরি এখন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক জনমত তেমন সোচ্চার নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় আসছেনা। চীন, ভারত, রাশিয়া এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি প্রতিবাদে মুখর না হলে মিয়ানমার সামরিক জান্তা এই ইস্যুটিকে হিম শীতলতায় নিক্ষেপ করতে চাইবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকার না এলে বিষয়টির রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে এগুনো সম্ভব হবে না। তবে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ, পাশ্চাত্যের দেশগুলি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ কঠোর পদক্ষেপ নিলে ইতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে বাংলাদেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক-পরিবেশগত উন্নয়ন বাধা সম্মুখিন। তাছাড়া এই ইস্যুটির সমাধান না হলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, শান্তি বিঘিœত হবে-এই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। মিয়ানমার সামরিক জান্তার সরকার এই ইস্যুতে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় এখনো পর্যন্ত আগ্রহ দেখায়নি।
আমরা মনে করি রোহিঙ্গা ইসু্যুতে কূটনৈতিক প্রয়াস চাঙ্গা করতে হবে। বৃহৎ শক্তিগুলির সাথে পাশ্চাত্যের দেশগুলির সাথে বিষয়টির গুরুত্ব অব্যাহতভাবে উপলব্ধি করতে হবে। মিয়ানমারের বর্তমান সংকটের আশু সমাধানও কাম্য। জান্তাবিরোধী ছায়া সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছে, এটি একটি পরিবর্তন। মিয়ানমারের রাজনৈতিক-সামাজিক গোষ্ঠীগুলি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংগ্রাম যত দ্রুত এগিয়ে নিতে পারবে তত সে দেশের জাতিগত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ নিরাপদ বোধ করবে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা । মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য ইতিবাচক হবে।
লেখক : সাংবাদিক