যা দেখেনি আর কোন চোখ

হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »

আল্লাহ্ তাআলাই সমস্ত প্রশংসা, স্তুতি ও গুণগানের মালিক, যিনি আমাদের চারপাশে নিজ কুদরতের অসংখ্য নিদর্শনাদি ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর পবিত্রতা, যিনি নিজ ইচ্ছা বাস্তবায়নে অপারগতা হতে মুক্ত। সেই প্রভুর কৃতজ্ঞতা, যিনি আমাদেরকে সেই নবীর উম্মত বানিয়েছেন, যাঁকে তিনি নিজ সান্নিধ্য ও দর্শনদানে ধন্য করেছেন।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নাই। তাঁর কোন শরীক নাই। তাঁর প্রভুত্বে কারো অংশীদারিত্ব নেই। আমাদেরকে আল্লাহ্র পথে আহ্বানকারী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র নিকটতম বান্দা ও তাঁর শ্রেষ্ঠতম রাসূল।
আমাদের সৌভাগ্য ঈর্ষণীয় বটে। কারণ, আমরা অযাচিতভাবে আল্লাহ্র সেই হাবীবের উম্মত হতে পেরেছি, যাঁর উম্মত হওয়া নবী রাসূলের কাছে কাক্সিক্ষত। কুদরতের দুয়ারে তাই অসংখ্য, অসংখ্যবার শোক্র, আল্হামদুলিল্লাহ্।
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় মে’রাজে মুস্তফার প্রতি আপত্তি, সংশয়ী ক্রমশ দূর হয়ে যাচ্ছে। সীমিত শক্তির উত্তরণ যদি এতটাই হয়, তবে অসীম, অপার কুদরতের শক্তির অন্ত কী করে নিরূপন করা? অসীম কুদরতের অপার ক্ষমতার মালিক আল্লাহ্ যখন কোন প্রসঙ্গ নিজের প্রতি সম্পর্কিত করেই উত্থাপন করেন, তখন তা উপেক্ষা করার অবকাশ থাকে না। মে’রাজ শরীফ এমনই একটি ঘটনা। একে প্রশ্নাসু দৃষ্টিতে দেখা খোদার কুদরতকে অবজ্ঞা করা, নাউযুবিল্লাহ্। এ কারণে, প্রসঙ্গ অবতারণার পূর্বে তিনি ‘সুবাহানা’ শব্দ উল্লেখ করেন। বর্ণিতব্য বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই, কেননা তিনি অক্ষমতা হতে, অপারগতা হতে পবিত্র, নিজ ইচ্ছা পূরণে তিনি পূর্ণ ক্ষমতাবান।
পবিত্র কুরআনের তিন জায়গায় মে’রাজের প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়। এক. সুরা বনী ইসরাঈলে বা সুরা ইসরা’র ১ম আয়াত, দুই. সে একই সুরার ৬০ নম্বর আয়াত এবং তিন. সুরা নাজম’র প্রথম ১৮ আয়াত। এগুলোতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হওয়া বিষয় অস্বীকার সরাসরি কুরআন’র বাণীকে প্রত্যাখ্যান করার নামান্তর। বিশেষত মসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদে আকসা পর্যন্ত এ সফর’র বর্ণনা অকাট্য। তাই এর অস্বীকারকারী কাফির। বাকী আসমানী জগৎ’র ভ্রমণ এবং মকামে র্কুব বা নৈকট্যের বিশেষ স্তরে উপনীত হওয়ার বর্ণনাদি নির্ভরযোগ্য, প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধতম হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, যা হাদীস বিশারদদের কাছে মুতাওয়াতির’র প্রায় নিকটতম পর্যায়ের। এগুলোর অস্বীকারকারী গোমরাহ্ বা পথভ্রষ্ট। এ কথাটি জোরের সাথে বলা যায় যে, মে’রাজ নিয়ে তুলকালাম বিত-া প্রথম যুগে এর চেয়ে অনেক বেশি ছিল। অবিশ্বাসীরা এর তথ্যকেই চ্যালেঞ্জ করে চেয়েছিল রাসূলে খোদার নবুওয়তী মিশনকে এ ইস্যুতেই শেষ করে দিতে। তাতে বরং লাভ বিশ্বাসীদেরই হয়েছিল। বিশ্ববরেণ্য তাফসীর ও হাদীসবেত্তাগণ এটাকে ব্যাপকভাবে হাইলাইট করে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এর সত্যতা শুধু প্রতিষ্ঠাই করেননি; বরং বিতর্কের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিয়েছেন। সন্দেহের শব আজ গোরেই নীরব।
নবুওয়াত প্রকাশের দ্বাদশ বর্ষের মাহে রজব’র সাতাশতম সোমবারের রাত’র শেষভাগে মে’রাজ শরীফ সংঘটিত হয়। অতি সংক্ষেপে এর কিছু বর্ণনার নির্যাস এ পরিসরে উল্লেখ করার প্রয়াস দুঃসাধ্য। তবে চেষ্টা করাও পুণ্য থেকে শূন্য নয়। হুযূর সায়্যিদে আলম (দ.)র দুধবোন হযরত উম্মে হানি বিনতে আবু তালেব’র বাড়িতে বিশ্রামরত ছিলেন। আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আ.) বুরাক নিয়ে হাজির হন। হযরতের (দ.) পবিত্র চরণ তালুতে পাখার পরশ দিয়ে তাঁকে জাগালেন। আল্লাহ্র আমন্ত্রণ জানালেন। এখানে তাঁর বক্ষদেশ হতে কলব মুবারক বের করলেন। যমযমের পানিতে ধৌত করে বক্ষদেশ নূর ও হেকমতে পূর্ণ করত কাউসার’র পানি দিয়ে গোসল দেয়া হল। বেহেশতী পোশাকে আল্লাহ্র হাবীব (দ.) কে দুল্হার সাজে সাজানো হল। নবীজি বুরাকে আরোহণ করলেন। জিবরাঈল আমীন লাগাম ধরলেন। ইসরাফীল (আ.) পেছনে বসলেন। সুসজ্জিত নুরানী বহর নিয়ে ঊর্ধ্বপানে রওয়ানা হলেন মে’রাজের দুলহা। পলকেই এ বহর এসে পৌঁছালো ১ম মনযিল মসজিদে আকসা বাইতুল মুকাদ্দাসে।
বাইতুল মুকাদ্দাসে আল্লাহ্র হাবীবকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত সকল নবীÑরাসূল এবং দায়িত্ববান ফেরেশতাকুল। নামাযের আনুষ্ঠানিকতায় বরণপর্ব। জামা’ত সহকারে নামায আদায় করা হয়। তাঁদের সকলেরই বরেণ্য অতিথি (দ.) ইমাম হলেন। এটি শোকরানার নফল নামায। কেমন দৃশ্য সে নামাযের। আম্বিয়া মুক্তাদী, মুকাব্বির ফেরেশতাকুল স¤্রাট। ইমামুল আম্বিয়া সায়্যিদুল মুরসালীন স্বয়ং যে নামাযের ইমাম। ফরশের এ আনুষ্ঠানিকতা শেষে এবার ঊর্ধ্বলোকের মহান অতিথির আসমানী যাত্রা। আল্লাহ্তাআলা মে’রাজের এ আয়োজনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন এভাবে, ‘লিনুরিয়াহু মিন আ-য়া-তিনা’-অর্থাৎ তাঁকে আমি আমার একান্ত নিদর্শনাদি পরিদর্শন করাবো।
এবার আসমানী সফর শুরু হল। সেই বুরাক, সেই বরাত, নুরানী অভিযাত্রার মধ্যমণি, আমেনার নয়নমণি। মেহমানে লা-মকান, সরকারে দোজাহান, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। খোদায়ী অভ্যর্থনার কী শান। আসমানের প্রতিটি দরোজায় অপেক্ষায় থাকবেন একেকজন উলুল আযম নবী-রাসূল। আকাশে দরজা হওয়া আল্লাহ্র কুদরতের কাছে অসম্ভব তো নয়। কিয়ামতের প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনেই আছে ‘সেদিন আসমানগুলো খুলে দেওয়া হবে, আর অনেক দরজা সম্পন্ন করা হবে। মাহে রমযানের সম্মানেও আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়ার কথা হাদীসে আছে। (কিতাবুসসওম) নবীজির সম্মানে সাদর সম্ভাষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন, ১ম সোপানে হযরত আদম (আ.) ২য় আসমানে ঈসা ও ইয়াহ্ইয়া (আ.), ৩য় আকাশে ইউসুফ (আ.), ৪র্থ আকাশে ইদরীস (আ.), ৫ম আসমানে হারুন (আ.), ৬ষ্ঠ সোপানে মুসা (আ.) এবং ৭ম আসমানে হযরত ইবরাহীম (আ.)। হযরত আদম ও হযরত ইবরাহীম (আ.) উভয়ে তাঁকে ‘মারহাবা, হে সৌভাগ্যবান নবী ও প্রিয়পুত্র’ বলে অভ্যর্থনা দেবেন, বাকি নবীগণ ‘প্রিয়ভাই ও নবী’ সম্ভাষণে তাঁকে বরণ করবেন। এ সিদ্ধান্ত আগের।
এরপর জিবরাঈল সমভিব্যহারে লাÑমকানের মেহমান ঊর্ধ্বলোকের সম্মুখপানে যাত্রা অব্যাহত রাখবেন। এভাবে পরবর্তী বিরতি সিদরায়ে মুন্তাহায়। আসমান থেকে যে যাত্রা শুরু হয়, তাহলো নুরানী জগতের সফর। মে’রাজ অস্বীকারকারী, এতে সংশয় ও আপত্তিকারী সকলে ঊর্ধ্বজগতের কথায় চোখ কপালে উঠাবে, তাÑই স্বাভাবিক। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত যাত্রার কথা কুরআনে যা স্পষ্টত বর্ণিত, তাও কী কম বিস্ময়ের? জাগতিক যাত্রায় তাও অসম্ভব। ঊর্ধ্বজগৎ সম্পর্কে সন্দেহকারীদের জানা নেই; কিন্তু বাইতুল মুকাদ্দাস যেহেতু তারা চেনে ও জানে, তাই তারা এ নিয়ে নবীজিকে প্রশ্ন করেছিল। তিনি জবাব দিয়ে তাদেরকে হতবাক করে দেন। কারণ, তারা জানতো যে, নবীজি কখনো বাইতুল মুকাদ্দাস যাননি। তাই, এটা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলতে পারবেন না। কিন্তু এ প্রশ্নের সাথে যুক্ত করা আরো প্রশ্নেরও যখন তিনি জবাব দিলেন, আর উত্তরগুলোর সত্যতা যখন অস্বীকার করতে পারল না, তখন হতভাগারা ঈমান তো আনা দূরে; বরং তাঁকে ‘যাদুকর’ বলে উড়িয়ে দিল। বস্তুত আল্লাহ্ তাআলা এজন্য মি’রাজের বিষয়কে পবিত্র কুরআনে ‘পরীক্ষা’ বলে উল্লেখ করেছেন। (১৭:৬০) এ ইস্যুতে দেখা গেছে, অনেকে আবার ‘মুরতাদ’ (স্বধর্মত্যাগী) হয়ে গেছে।
আসমানী জগৎ পরিভ্রমণে তিনি বেহেশত, দোযখ, এমনকি আরশে মুআল্লা পর্যন্ত পরিদর্শন করেন। বেহেশতের বর্ণনায় আছে, ‘এক পর্যায়ে আমি বেহেশতে প্রবেশ করি। চকিতে আমার দৃষ্টিতে এল, তাতে এমন সব নেয়ামত রাজি রয়েছে, না তা (পৃথিবীর) কোন চোখ দেখেছে, না কোন কান শুনেছে’। (ইবনে জারীর) অভিন্ন গ্রন্থে এমনও রয়েছে, ‘আল্লাহ্র শপথ, তিনি (দ.) বেহেশত, দোযখ্ এবং পরকালে (সংঘটিতব্য) যা কিছু আল্লাহ্ প্রস্তুত রেখেছেন, তা সব কিছু না দেখে বুরাক থেকে অবতরণ করেননি’। বিশেষত দোযখ পরিদর্শনের বিশদ বর্ণনা ইবনে নাবাতা তাঁর প্রণীত খুৎবায় দিয়েছেন। আর ‘দানা ফাতাদাল্লা’ও ক্বা-বা কাওসাইনিআও আদনা’ ব্যাখ্যায় বিশ্ববরেণ্য মুফাসসিরগণ আল্লাহ্ তাআলার রূপ দর্শনের সমর্থনে জোরালো মত প্রকাশ করেন। (তাফ্. রূহুল মাআনী দ্র.)

লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।