ম্যাংগো

মইনুল আবেদীন »

ম্যাংগো প্রতিদিন স্বপ্নে দেখে নীলাকাশ, পেঁজাতুলো মেঘ, সবুজ বনানী আর মাইল-মাইল বনভূমি। যদিও আকাশ আর মেঘ তার খুব কাছাকাছিই আছে, আশপাশের দু’চারটি বিক্ষিপ্ত গাছের সবুজও বনভূমির ঈষৎ ইশারা নিয়ে খুব দূরে নয়, তবু সে যেখানে অনেকদিন একাকী বন্দি, ঘরের বড় সাবধানে বোনা শিক আর কাঁটাতারের বাঁধায়। ওসব স্বপ্নের মতোই সুদূরে।
তুমি তো আমাদের টিয়া, পুষ্পর দাদুমনি আদর করে ডাকে তোতা, কিন্তু তোমার নাম ম্যাংগো কেন? তোমার গায়ের রঙ কাঁচা আমের মতো মিষ্টি সবুজ তাই? তুমি আমের মতো গাছের ডালপালায় মিশে থাকতে ভালবাসো তাই? গাছ তোমার প্রিয় মাতৃভূমি তাই? নাকি ঝড়ে উড়ে যাওয়া আমের মতোই তোমার বড় বুনোস্বভাব তাই?
মালিহার বাবা ওকে কিনে এনেছিল সেই সুদূর পাহাড়ের দেশ থেকে। তখন ছিল আমের ভরা মৌসুম। একদিন কয়েক ঝুড়ি আম আর খাঁচায় ভরা টিয়া-তোতা নিয়ে ওর বাবা ঘরে এল। গোটা ঘরে কাঁচা-পাকা আমের মৌ মৌ গন্ধ। আমের ঝুড়িগুলোর পাশে খাঁচায় রাখা টিয়াটাকে দেখে মালিহা মহাখুশিতে হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, ম্যাংগো! ম্যাংগো! সেই থেকে ওর নাম হয়ে গেল ম্যাংগো।
মালিহার বাবা রুমালে মাথার বিশাল টাক আর ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে বললো, অনেক দরাদরির পর দুই হাজার টাকায় রফা হয়েছে। পাখিওয়ালাটাও কম ত্যাঁদড় না।
মালিহার মা তোয়ালে এগিয়ে দিতে দিতে চোখ কপালে তোলে, কী দরকার ছিল খামাখা? তবে টিয়াটাকে দেখে বেশ মায়া লাগছে।
মালিহাদের বাড়ির ছাদে আরো অনেক পাখি। ম্যাংগোর জায়গা হলো পায়রার খোপগুলোর পাশে বাজরিগার দুটোর খাঁচার পাশে। পাশের খাঁচায় আবার দুটো কোয়েল পাখি। কিন্ত অন্য পাখিগুলোর চেয়ে ম্যাংগো অনেক আলাদা। পাশের ফ্ল্যাটের পুষ্প রোজ মালিহার সাথে খেলতে আসে। ওই প্রথম আবিষ্কার করলো, ম্যাংগোর মনে কোনও হাসি নেই, খুশি নেই, আশপাশের মুক্ত পায়রাগুলো যখন অবিরত আপনমনে বাক্‌-বাকুম বাক্‌-বাকুম করছে, কোয়েল আর বাজরিগারগুলো সারাক্ষণ দানা খুঁটে খাচ্ছে, ও তখন খাঁচার এককোণে ঝিম মেরে বসে আছে তো আছেই, আর হঠাৎ হঠাৎ তীব্র কিক্‌ কিক্‌ শব্দে যেন দুনিয়াকে জানান দিচ্ছেÑ আমি বন্দি! আমি বন্দি!
পুষ্প ওর দাদুমনির বিছানার পাশে বসে গল্প করে, জানো দাদু, ম্যাংগো কিছু খাচ্ছে না।
বিছানায় আধশোয়া হয়ে দাদুমনি ওর হাতটা নিয়ে বুকের ওপর রাখে।
মন খারাপ করেছে তোতাটা, খাঁচা ওর ভাল লাগে না। ওর ঘর-বাড়ি তো আকাশে।
দাদুমনি আর হাঁটতে পারে না, সারাক্ষণ শুয়ে থাকে আর মাঝেসাঝে হুইলচেয়ারে করে এঘর-ওঘর যায়। পুষ্প বোঝে দাদুমনির অনেক কষ্ট।
পুষ্প দাদুমনির বুকটা হাত দিয়ে ডলে দেয়। দাদুমনির যখন শ্বাসকষ্ট হয় তখন বুক দিয়ে কেমন ঘড়ঘড় শব্দ হয়, সবাই মিলে ছুটাছুটি করে নাকে অক্সিজেনের নল ঢুকিয়ে দেয়, দাদুমনি কেমন যেন করে, দেখতে পুষ্পর খারাপ লাগে।
পুষ্প বলে, ম্যাংগোর অনেক কষ্ট, তাই না দাদুমনি?
দাদুমনি বড় করে একটা নিশ্বাস ফেলে।
আমারো অনেক কষ্ট দাদু, ওই তোতাটার মতোই!
ঠিকই তো ম্যাংগো আর দাদুমনি দুজনেরই বন্দিদশা, কেউ ইচ্ছে করলেই বাইরে যেতে পারে না। পুষ্প কপাল কুঁচকে ভাবলো কি করে দুজনকে মুক্ত করা যায়।
মালিহা আর পুষ্প দুজনই ম্যাংগোর ছবি আঁকলো ড্রইং ক্লাসে বসে। মালিহার ছবিতে খাঁচার ভেতর ম্যাংগো, পুষ্প আঁকলো ম্যাংগো ডানা মেলে উড়ছে, মাথার ওপর আবছা নীল আকাশ।
মালিহা চেঁচিয়ে উঠলো, এই পুষ্প, ম্যাংগো পালিয়ে গেল যে!
পুষ্প মুচকি হেসে বললো, নাহ্‌, কই ওতো পালাচ্ছে না, ও নিজের জায়গাতেই আছে।
মালিহা এদিক-ওদিক তাকিয়ে যেন আর কেউ শুনতে না পায় এভাবে পুষ্পর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, জানো কাল রাতে মা আর বাবা ঝগড়া করেছে। মা বলেছে মা’র জীবনে আর সুখ নাই।
পুষ্প একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, লুকিয়ে বড়দের কথা শোনা ভাল না।
পুষ্প চাপাস্বভাবের, না হলে গতকাল দাদুমনিকে নিয়ে মা-বাবার কথা কাটাকাটির কথা মালিহাকে বলতে পারতো। মা নিচুস্বরে ফুঁসছিল, এই ঝামেলা আর ভালো লাগছে না। রোগীর সেবা করতে-করতে কোন্ দিন নিজেই রোগী হয়ে যাব।
বাবা রেগে গেলে কেমন যেন তোতলায়, মা’টা আমার আর কতদিন বাঁচবে? একটু ধৈর্য ধরা যায় না?
আর ধৈর্য নাইÑ বলে মা ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দেয়।
দাদুমনির জন্য পুষ্প’র খারাপ লাগে।
ম্যাংগোর জন্য পুষ্প’র খারাপ লাগে।
ওরা বাইরে বেরোতে পারে না।
মা’র জন্য পুষ্প’র খারাপ লাগে।
বাবার জন্য পুষ্প’র খারাপ লাগে।
কেন খারাপ লাগে, পুষ্প জানে না।
দারোয়ান চাচার পিছু-পিছু ওরা দুজন লেকের পাড় ঘেঁষে ড্রইং ক্লাস শেষে বাসায় ফিরতে থাকে। দারোয়ান চাচা অনেক লম্বা আর ফরসা, শরতের মেঘের মতো ধবধবে সাদা চুল-দাড়ির ওপর একটি কালো ফেজ টুপিপরা দারোয়ান চাচাকে অবিকল রবীন্দ্রনাথের মতো লাগে।
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে- এ কবিতাটা কি দারোয়ান চাচা লিখেছে? পুষ্প মালিহাকে চুপিচুপি এ কথা বলে আর দুজনে হেসে কুটিকুটি হয়। লেকের পাড়ের সবচেয়ে বড় গাছটার নিচে আসতেই মাথার ওপর দিয়ে একঝাঁক টিয়া তীব্র আওয়াজ তুলে নিমেষে কোনদিকে উড়ে গেল। পুষ্প মনে-মনে ভাবলো, ম্যাংগোকে একদিন লুকিয়ে নিয়ে এসে এ গাছটার কাছে ছেড়ে দেবে। কিন্তু লুকিয়ে কোনো কাজ করা নাকি ভাল না, মা বলেছে। ভাবতে-ভাবতে মালিহার সাথে দারোয়ান চাচার পিছু-পিছু ও বাসায় ফিরে আসে।
দারোয়ান চাচার ঘরটা পায়রাগুলির খুপরির মতো ছোট। পুষ্প একদিন দেখলো, মালিহার বাবা খুব বকাঝকা করছে দারোয়ান চাচাকে। দারোয়ান চাচা নাকি কানে শোনে না, চোখে দেখে না, সিঁড়ি ঝাড়ু দেয় না, ঠিকমতো পাখিগুলোর দেখাশোনা করে না, আরো কত কি! ওর সামনেই একদিন দারোয়ান চাচাকে ধমকালো মালিহাও।
চাচা তুমি ম্যাংগোকে খাবার দাওনি কেন কাল? ওর বুঝি ক্ষিধে লাগে না?
পুষ্পর খুব মন খারাপ লাগে। মালিহা নিজেই তো ম্যাংগোকে খাবার দিতে পারে, ওর এত হুকুম করার স্বভাব কেন?
বেশ কয়েকদিন থেকে দাদুমনির শরীরটা বিশেষ ভালো নেই। শ্বাসকষ্টটা অনেক বেড়ে গেছে। বুক থেকে অবিরাম ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে, সারাক্ষণ অক্সিজেনের নল নাকে লাগিয়ে রাখতে হচ্ছে। হুইলচেয়ারে চড়ে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি বন্ধ, শুধু বিছানায় একটানা শুয়ে থাকা। পুষ্প দাদুমনির কাছে-পিঠে ঘুরঘুর করে। একদিন দাদুমনি পুষ্পকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলো, ওর হাতটা বুকের ওপর নিয়ে কাঁপা-কাঁপা গলায় বললো, তোমার তোতাটাকে আমায় একবার দেখিয়ে নিয়ে যাবে দাদু?
পুষ্প মালিহাকে সাথে করে ম্যাংগোকে নিয়ে দাদুমনির ঘরে আসে। ম্যাংগো খাঁচার ভেতর ঝুলে থেকে কেমন করুণ চাহনিতে দাদুমনিকে পরখ করে। দাদুমনি মনে হয় যেন ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় করছে, কি কষ্ট, কি কষ্ট, কখন মুক্তি পাবে পাখিটা?
শেষমেশ সবাই মিলে দাদুমনিকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। পরদিন বিকেলে খবর এল দাদুমনি আল্লাহ্‌’র কাছে চলে গেছে। মা-বাবা গোছগাছ করছে, সবাই গ্রামের বাড়ি যাবে। পুষ্পর ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে গেল। সবার অলক্ষে ও ছাদের দিকে দৌড়ে গেল লুকিয়ে কাঁদবে বলে। মা বলেছেন লুকিয়ে কোনো কিছু করা ভালো না, কিন্তু ওর যে চাপাস্বভাব, সবার সামনে কাঁদতে পারবে না, ও কি করবে?
দারোয়ান চাচাকে ছাদ থেকে নিচে নামতে দেখে পুষ্প মুখ ঘুরিয়ে নিল। ছাদে উঠে ও বিস্ময়ে হতবাক। ম্যাংগোর খাঁচার দরজাটা হাট করে খোলা, ভেতরটায় খাঁ খাঁ শূন্যতা, ম্যাংগো নেই। তবে কি দারোয়ান চাচা ভুল করেৃ? পুষ্প ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। ম্যাংগোটা কি অবশেষে মুক্তি পেল?