মুডি’স রেটিংয়ে অবনমনে কী প্রভাব অর্থনীতিতে?

সুপ্রভাত ডেস্ক »

বাংলাদেশের সার্বভৌম রেটিং কমার পর ব্যাংক খাতের শক্তিশালী ছয়টি কোম্পানিরও এক ধাপ অবনমন; সব মিলিয়ে সংকট মোকাবিলার লড়াইয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধাক্কা লাগল কি?
অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা, দেশের রেটিং কমার পর পাহাড়সম খেলাপি ঋণে ধুঁকতে থাকা ব্যাংকে খাতের মধ্যে ছয়টি বেসরকারি ব্যাংকের আন্তর্জাতিক রেটিং কমে যাওয়ার বিষয়টি অর্থনীতিতে তৈরি করবে নতুন চ্যালেঞ্জ।
ব্যাংকারদের ধারণা, এর ফলে বিদেশি ঋণ পেতে আগের চেয়ে বেশি সুদ গুনতে হতে পারে, ক্ষেত্র বিশেষে বিদেশ থেকে ঋণ প্রাপ্তিও অনিশ্চিত হতে পারে।
গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের সার্বভৌম রেটিং কমিয়ে দেয় মুডি’স। ঋণমান সূচক কমানোর ব্যাখ্যায় সংস্থাটি বেশ কিছু কারণ তুলে ধরে। এর মধ্যে আছে ডলারের সংকট অব্যাহত থাকা, বিদেশি মুদ্রার মজুদ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক লেনেদেন চাপ, আমদানি কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি, ইত্যাদি। অবশ্য বাংলাদেশের জন্য পূর্বাভাস স্থিতিশীল রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ রেটিং সংস্থা। খবর বিডিনিউজ।
যে ছয়টি ব্যাংকের রেটিং কমেছে, সেগুলো বেসরকারি খাতের শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিচিত। এগুলোর খেলাপি ঋণও তুলনামূলক কম, করপোরেট সুশাসনের দিক দিয়েও তারা এগিয়ে বলেই ধারণা করা হয়।
বুধবার ব্র্যাক ব্যাংক, দ্য সিটি ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের ‘দীর্ঘমেয়াদী ডিপোজিট’ ও ‘ইস্যুয়ার রেটিং’ কমায় মুডি’স। এই ছয় ব্যাংকের পাশাপাশি প্রথমবারের মত রেটিং দেয় মার্কেন্টাইল ব্যাংকের জন্য, সেটাও ‘নেগেটিভ’।
ব্যাংকে করপোরেট সুশাসন, বার্ষিক রিপোর্টের স্বচ্ছতা, ঋণ বিতরণের প্রক্রিয়া, খেলাপি ঋণ ও পুনঃতফসিলের হার, কর্ম পরিবেশ ও পরিচালনা পর্ষদের আচরণÑইত্যাদি বিষয় পর্যালোচনা করেই ক্রেডিট’ রেটিং দিয়ে থাকে আর্ন্তজাতিক রেটিং কোম্পানিগুলো। এই রেটিংয়ের মান দেখেই বৈদেশিক বাণিজ্য লেনদেনে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
এই রেটিং দেওয়ার এক মাস আগে আর্থিক সূচকের তথ্য নিয়ে মুডি’স এর একটি প্রতিনিধি দল ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে। এরপর নিজেদের মূল্যায়ন জানিয়ে দিল আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থাটি। ব্যাংকগুলোই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রেটিং সংস্থাটির সঙ্গে চুক্তি করেছিল তাদের ঋণমান নির্ধারণের জন্য।
যত আশঙ্কা
মুডি’সের রেটিং কমার কী প্রভাব, সে প্রশ্নে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এর প্রভাব সরাসরি ৪-৫টি খাতে পড়বে। বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার যেখানে হবে- সেখানেই খরচ বেড়ে যাবে ব্যাংকের। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদেরও বিদেশি ঋণ পেতে আগের চেয়ে বেশি সুদ গুনতে হবে।’
কয়েকদিন আগেও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে থাকা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বাংলাদেশের সার্বভৌম রেটিং যেহেতু কমে গেছে, এখন দেশের সবগুলো ব্যাংকের রেটিং স্বয়ংক্রিয়ভাবেই একধাপ কমে যাবে। আর যেসব ব্যাংকের করপোরেট সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, তাদের মান আরো এক ধাপ কমবে।
‘বৈদেশিক বাণিজ্য ও লেনদেন পরিচালনা, যেমন এলসি খোলা, বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা যোগানের যে চুক্তি, করেসপন্ডেন্ট ব্যাংকিং, তৃতীয় ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি দায় পরিশোধ- ইত্যাদি খরচ আগের চেয়ে বেশি হবে। সার্বিক দিক দিয়ে ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের খরচ বেড়ে যাবে।’
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ বা এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে সব ব্যাংকের ‘করেসপন্ডেন্ট চার্জ’ এখন বেড়ে যাবে। তাতে ব্যাংকের ব্যবসা করার খরচ বেড়ে যাবে। বিদেশি ব্যাংক ও এডিবি, বিশ্ব ব্যাংক ও আইডিবি ঋণ দিতে চার্জ বাড়িয়ে দেবে বা ঋণ নাও দিতে পারে।
এবিবির বর্তমান চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘এখন আমাদের এলসি কমিশন কমে যাবে। পণ্য আমদানি খরচ বেড়ে যাবে। বিদেশি ঋণ ও ট্রেডিং লাইনের সীমা কমিয়ে দেবে আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো।’
তবে ছয় মাস পর মুডি’স রেটিং পুনর্মল্যায়ন করবে, তখন পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
মুডি’স এর রেটিং পুনর্মূল্যায়নের প্রভাব নিয়ে দ্যা সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘বৈদেশিক বাণিজ্যে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে আমরা এখন বিশ্লেষণ করছি। আমরা দেখছি বিদেশি ঋণে সুদের হার কতটুকু বেড়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পেতে কোন কোন সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখন আমাদের ভালো দিকগুলো তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে।’ মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউল হাসান বলেন, ‘গত মাসে মুডি’স এর একটি প্রতিনিধি দল মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে ব্যাংকিং কার্যক্রম মূল্যায়ন করেছে। আমরা তাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলাম।’
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ কত
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের বিদেশি ঋণ ছিল ৭ হাজার ১৯৩ কোটি ৬৪ লাখ কোটি ডলার। এরমধ্যে স্বল্পমেয়াদি ২১১ কোটি ২৯ লাখ ডলার, আর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৬ হাজার ৯৮২ কোটি ৩৪ লাখ ডলার।
বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৪৩০ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। যার মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ১ হাজার ৬৪১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। যা মোট ঋণের ৬৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ হচ্ছে ৭৮৯ কোটি ২৪ লাখ ডলার, যা মোট বেসরকারি খাতের মোট ঋণের ৩২ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
সরকরি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট বিদেশি ঋণের দায় গত ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬২৪ কোটি ৫৯ লাখ ডলার।
বেসরকারি খাতে সর্বোচ্চ ঋণ গ্রহীতা খাত হচ্ছে জ্বালানি খাত। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতের বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৫৪ কোটি ৫২ লাখ ডলার। এরপরই উৎপাদন খাতে ২০৯ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, ট্রেডিংয়ে ১৩৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ব্যাংকিংয়ে ১৩০ কোটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ঋণের উৎসে শীর্ষ দেশ চীন থেকে এসেছে ২৩৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এছাড়া হংকং থেকে ১০৬ কোটি ২৩ লাখ ডলার, যুক্তরাজ্য থেকে ৮৫ কোটি ২১ লাখ ডলার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬৯ দশমিক ৯১ কোটি ডলার, নেদারল্যান্ডস থেকে ৬৪ কোটি ৭৭ লাখ ডলার, সিঙ্গাপুর থেকে ৬৪ কোটি ৫৬ লাখ ডলার, জার্মানি থেকে ৩৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার এসেছে।
আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৭ শতাংশ বেড়ে গত ২০২১-২২ অর্থবছের বাংলাদেশে নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৪৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। যার মধ্যে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ নিয়ে শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের নিট বিনিয়োগ ছিল ৬৬ কোটি ১১ লাখ ডলার। এর পরই রয়েছে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ নিয়ে চীনের ৪৬ কোটি ৫১ লাখ ডলার। ১১ দশমিক ২ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে থাকা যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ ৩৮ কোটি ৩৯ লাখ ডলার।