মুক্তিযোদ্ধা মুনির মিয়া এবং ইবু আর ইদু

শরিফুল ইসলাম :

ইদু আর ইবু মেঘাখালি থেকে মাথায় করে পঁচিশ কেজি ওজনের একেকটি সরিষাতেলের টিন বহরমপুর বংশাই নদীর ঘাটে এনে নামাচ্ছে। মাঝখানে পুরো নয় কিলোমিটার রাস্তা। তিনটি খালে হাঁটুসমান পানি। খালে যে-বাঁধ ছিল সেই বাঁধগুলোও ভেঙে দিচ্ছে মুক্তিবাহিনী। এখন কাদামাটিতে একেবারে একাকার খালের পাড় গুলো। উঠতে-নামতেও ভয় করে। খালের বাঁধগুলো ভাঙার কারণে ভিতর গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারিদের টহল কিছুটা কমেছে।

একেকটা তেলের টিন মাথায় করে পায়ে হেঁটে তিনটা খালের কাদামাটি আর নয় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মেঘাখালি থেকে বংশাইয়ের ঘাটে নামিয়ে দিলে মহাজন যা দেয়, তাতেই খুশি ইবু আর ইদু। ওই টাকায় পুরো ভরপেট খাওয়া যায় একবেলা।

দেশে যুদ্ধ চলছে প্রায় নয় মাস যাবত। না খেয়ে মারা গেছে অনেকেই। যুবক-যুবতীদের ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানি আর বিহারিরা। কদিন পরে তাদের লাশগুলোর দেখা মিলছে  মেঘাখালি ভাঙা ব্রিজের পাশে। দিন দিন নদীর পানিও পচে যাচ্ছে।

ইবুর বয়স ষোল আর ইদুর বয়স পনেরো। ইদু ইবুর থেকে বেশ হৃষ্টপুষ্ট, বলবান ও চঞ্চল। ইবু আর ইদু দুই ভাই। বাবা এই সংগ্রামের মাঝে হারিয়ে গেছে। মাও নেই। মার কি যেন এক পচাধরা রোগ হয়েছিল। মারা  গেছে দুমাস আগে। চাচা-জেঠারা সবাই এখন পলাতক। পনেরো-ষোল বছরের দুটি বালক শুধু আধপোড়া বাড়ির এক  কোণে রাত্রিযাপন করে। কয়েকদিন আগে গ্রামের তুলা রাজাকাররা পাকিস্তানি হানাদারদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে ইবু-ইদুদের বাড়ি।

ইবুর চাচা মুনির মিয়া বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, এ খবর কেমন করে জানি তুলা মিয়ার কানে যায়। তারপর  থেকেই রাজাকার তুলা মিয়া ইবু-ইদুদের বাড়িতে ঘুরঘুর শুরু করে এবং একদিন রাতের আঁধারে এসে কেরোসিন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ইবু-ইদুদের বাড়ি। ভাগ্যিস ইবু-ইদুদের বাড়ির সবাই আগের দিন পালিয়েছিলেন। না পালালে কি কা-টাই না হতো!

এখন বাড়িতে শুধু ইবু আর ইদু। বাড়ির সবাই পলাতক। তারা  কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে,  কেউ জানে না। আদৌ কি আশ্রয়  পেয়েছে নাকি মিলিটারিদের হাতে ধরা পড়েছে, কে জানে! ইবু-ইদুর বড় জেঠা ওদের খুব  জোরাজুরি করছে, তাদের সাথে  যেতে কিন্তু কোনো কাজ হয় নি। এও বলেছে, তোরা যদি আমাদের সাথে না যাস তাহলে  তোদের বাবা যদি ফিরে এসে  দেখে তোর মা মারা গেছে আর এর সাথে তোদেরও কিছু হয়ে  গেছে, তখন আমরা কি জবাব দেবো তোদের বাবার কাছে?

এ প্রশ্নের জবাবে ইবু আর ইদু চুপচাপ শুধু দাঁড়িয়ে ছিল।  কোনো উত্তর দেয়নি। তাই তো বাধ্য হয়ে ইবু আর ইদুকে  রেখেই চলে যায় সবাই।

যাওয়ার সময় কিছু শুকনা খাবার রেখে যায় ইবু আর ইদুর জন্য। কিন্তু রাজাকার তুলা মিয়ার কারণে সেই খাবারগুলোও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ঘরবাড়ির সাথে।

আচ্ছা ইবু আর ইদু তাদের  জেঠার সাথে গেলো না কেন? তাদের কি এমন কাজ? তারা দুজন পনেরো-ষোল বছরের বালক ওদের কি কাজ থাকতে পারে?

ওদের বাবা হারিয়ে গেছে এই  ঘোর যুদ্ধের সময়। তার কিছুদিন পর ওদের চাচা টগবগে যুবক মুনির মিয়া বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। যদিও ইবু আর ইদু ছাড়া বাড়ির আর কেউ জানতো না তা।

রাতের আঁধারে ইবু-ইদুর চাচা মুনির মিয়া ওদের সাথে দেখা করতে আসে কদিন পর। সে খবর নিয়ে যায় এলাকার কি অবস্থা, হানাদারদের গতিবিধি  কেমন।

মেঘাখালি থেকে বহরমপুর বংশাই নদীর ঘাট পর্যন্ত ইবু-ইদুর চলাচলের কারণে খুব সহজে সমস্ত খবর নিতে পারে মুক্তিযোদ্ধা মুনির মিয়া।

একদিন ভোরে মাথায় সরিষাতেলের টিন নিয়ে ইবু আর ইদু ধীরে ধীরে এগুচ্ছে বহরমপুরের দিকে। হঠাৎ একদল মানুষের চিৎকারে ক্ষণিকের জন্য ভয়ে পেয়ে যায় ওরা।

পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখে ওদের চাচা মুনির মিয়াকে কাঁধে করে বিজয় সেøাগান দিতে-দিতে এগিয়ে আসছে একদল  লোক।

সবার হাতে রাইফেল। আর ওদের চাচা মুনির মিয়ার হাতে লাল-সবুজের একটি নিশান। তবে কি যুদ্ধ শেষ?