মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যে নারী

ড. আনোয়ারা আলম »

‘বন্ধু রাজ-তোমাকে আমি হলফ করে বলতে পারি, আমি দেখা দেবো একটা বিশাল ধূমকেতুর মতো-এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।’ নিজের সম্পর্কে রাজনারায়ণ বসুকে মাইকেল যা লিখেছিলেন তার মধ্যে সন্দেহের সত্যি কোন কারণ ছিলো না-ধূমকেতুর মতোই নাটকে কাব্যে যুগান্তর ঘটিয়ে সবাইকে চমক লাগালেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩) সবকিছুতেই তিনি ছিলেন একেবারে আলাদা আচার-আচরণে ঔদ্ধত্যর-সনাতন মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা জীবন ও সাহিত্যের প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি বিদ্রোহ পোশাক আশাকে যেমন, তেমনি স্বাধীন হয়েছেন বাড়ি থেকে পালিয়ে সে যুগে দু’দুটি শ্বেতাঙ্গিনীর সাথে ঘর করা সব কিছু মিলিয়ে প্রশ্ন জাগে সাধারণ গ্রামের প্রথাবদ্ধ নব্যধনী পরিবারে যার জন্ম-স্বশিক্ষিত মা জাহ্নবী দেবীর কাছে যিনি পৌরাণিক কাহিনী শুনে বড় হয়েছেন- তাঁর চরিত্রে এসব অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য এলো কোত্থেকে!
বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার প্রাণপুরুষ প্রথম মহাকাব্য রচয়িতা বহু জন্মাবিদ তিনি ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী তাঁর মেঘনাদ বধ কাব্যের মাধ্যমে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার রেনেসাঁ নবজাগৃতিক কবিতার আধারে এক অপরিমেয় নির্যাসে পরিণত করেছিলেন রেনেসাঁসী নারী জাগরণের আভাসও এ গ্রন্থে মেঘনাদের স্ত্রী প্রমীলা বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিকা নারী তেজস্বিনী স্বাধিকারচেতনা ব্যক্তিত্বশীলা। ইতালির সম্রাট, মাইকেলের কবিতা সম্পর্কে একটি বাণী পাঠিয়েছিলেন। মাত্র একটি কবিতা পড়ে, তার আগেই মাইকেলের হাতে প্রাচী প্রতীচীর বন্ধন রচিত হয়ে গিয়েছিল। কয়েকশো বছর বাহিত কাহিনী কাব্যের ধারাতেই মাইকেল এক নতুন ধারা তৈরি করলেন-রচিত হলো প্রথম মহাকাব্য, প্রণীত হলো প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ।
মধুসূদন তাঁর সাহিত্যে নারীর মর্যাদা দিয়েছেন বিশেষভাবে মেঘনাদবধ কাব্যে মেঘনাদের স্ত্রী প্রমীলার সাহস ও বীরত্ব যেন এক পরম বিস্ময়-যদিও শেষ পর্যন্ত প্রমীলাকে কবি সহমরণে পাঠালেন-মূল রামায়ণে সহমরণ নেই-রাক্ষস সমাজের রীতিও তা নয়-চিতা জ্বলছে-প্রমীলা ‘চির সুখ হাসি রাশি’। রাজা রামমোহনের পরে এসে আধুনিক হয়েও কেন সহমরণ! একটা সংশয় জাগে পাঠক মনে-তবে কি তিনি পিতৃতান্ত্রিকতার বলয় থেকে মুক্ত হতে পারেননি অথবা তিনি কি উপলব্ধি করেছেন সে সময়ের প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় নারীদের তুলনায় ভারতবর্ষীয় নারীদের পার্থক্য অনেকই ‘আমার চারিপাশে একটা গণ্ডী রয়েছে। তার বাইরে পা বাড়ানোর জো নেই।’ যদিও হিন্দু কলেজে অধ্যয়নকালীন সপ্তম শ্রেণিতে যখন তখন ‘নারী অধিকার’ কিংবা কোথাও লেখা ‘স্ত্রী শিক্ষা’ বিষয়ে রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে পেলেন সোনার পদক। ১৮৫৫ সালে মাদ্রাজে প্রথম দৈনিক পত্রিকা-‘মাদ্রাজ স্পেক্টটার’ এর সম্পাদকীয়তে বিধবা বিবাহের পক্ষে লেখনীতে তিনি সোচ্চার।
এর আগে ১৮৪৯ সালে মাদ্রাজে আরেকটি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে যখন তখন সম্রাজ্ঞী রিজিয়া তথা রিজিয়া ইমপ্রেস অফ ইন্ডিয়া’ নামে কাব্য নাটক প্রকাশ করা ছিল এক বৈপ্লবিক বা দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ-কারণ তখন বাঙালি সাহিত্যিকরা মুসলিমদের নিয়ে লেখার তেমন সাহস বা ইচ্ছে প্রকাশ করতেন না- এ নাটক রচনাতেও তিনি ব্যতিক্রমী ভাবনায় সম্রাজ্ঞীর প্রশস্তি নয় বরং ইতিহাসের মধ্য থেকে মানবিক আগ্রহের কাহিনী বেছে নিলেন-ক্যাপটিভ লেডিতে যে মানসিকতায় এঁকেছেন প্রণয় কাহিনী রিজিয়া কাব্য নাটকেও তাই আর বিদ্রোহের মুখোমুখি সময়ে তিনি সম্রাজ্ঞীর মতোই রিজিয়ার সাহস বীরত্ব ও দৃঢ়তার বহিপ্রকাশ ঘটান অসাধারণ দক্ষতায়-যদিও এ কাব্য নাটক তিনি শেষ করতে পারেননি। পরবর্তীতে ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ এবং ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’ বিদ্রোহী নারীদের যে চরিত্র সৃষ্টি-তাদের আভাস এ কাব্য নাটকে লক্ষ করা যায়।
মধুসূদনের সাহিত্যে পর্যালোচনায় চারটি বৈশিষ্ট্য মানবতাবাদ-ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ-স্বদেশপ্রেম ও নারীবাদী চেতনা। নারী স্বাধীনতার প্রতিফলন প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ক্যাপটিড লেডিতে’-যেখানে শাসন শোষণে নিষ্পেষিত ও আজন্ম শৃঙ্খলিত নারীর মুক্তির ইংগিত তিনি দিয়েছেন। সাহিত্য সমালোচকদের মতে এ কাব্যগুণ যাই হোক নারী স্বাধীনতারও পক্ষে তার বৈপ্লবিক ভাবনাকে ধারণ করেছে। এ কাব্যগ্রন্থ মধুসূদনের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের নামকরণও নারীর নামের বীরাঙ্গনা (১৮৬২)-ব্রজাঙ্গনা (১৮৬১) নাট্য সাহিত্যের নামকরণেও কৃষ্ণকুমারী-শর্মিষ্ঠা পদ্মাবতী-যেসব নাটকের নায়িকারা ত্যাগে ও মর্যাদাবোধে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী। যা সে যুগে ভাবাটা ছিল কঠিন। ভারতীয় পৌরাণিক ঘটনা অবলম্বনে রচিত ‘শমিষ্ঠা’ নাটকের নায়িকা শমিষ্ঠা ও প্রতি নায়িকা দেবযানীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কবি এতটা নিপুণভাবে এঁকেছেন যে কারণে পাঠকের মনে অনুরাগ ও সমবেদনাই জাগে-‘পদ্মাবতী’ চরিত্রের কোমলতা ও করুণা যেমন-কৃষ্ণকুমারী নাটকে ও কুমারী কৃষ্ণার মনোহর চিত্রের বিপরীতে পিতার সামান্যতায় তার আত্মহত্যা-সব কিছু মিলিয়ে এসব চরিত্রে শাশ্বত বাঙালি নারী যারা সহজে প্রতিবাদী হতে পারে না- বিদ্রোহ করার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা।
কিন্তু পরবর্তীতে সময়ের প্রবাহে কবি মধুসূদন বাংলার নারীর মনে আত্ম ভাবনা ত অহংবোধ জাগানোর লক্ষ্যে দৃঢ় চিত্তে লেখনীকে ধারণ করেন-সেক্ষেত্রে প্রেরণা ছিল একদিকে পাশ্চাত্যের কবি অন্যদিকে প্রাচীন ভারতীয় শৌর্য ও বীরত্বে নারী চরিত্র।
‘বীরাঙ্গনা’ তাঁর বিদ্রোহী অন্তরের ফসল। নারী প্রধান এ কাব্য পাশ্চাত্য কবি ও ভারতীয় The Heroines: or Epistle of the Hearoines কাব্যের অনুসরণে একুশটি পত্রে লিখতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত এগারটি পত্র কাব্যের সমন্বয়ে এ সব নারী আভিধানিক অর্থে বীরাঙ্গনা না হলেও উনিশ শতকের নব জাগরণের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এরা প্রত্যেকেই আধুনিক এবং বিদ্রোহী সত্তার-পুরানের বিভিন্ন চরিত্র তথা শকুন্তলা, তারা, রু´িনী কৈকেয়ী, ভানুমতি, দ্রৌপদী, দুঃশলা, জাহ্নবী, উর্বশী, জনা, রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’ রচিত হওয়ার প্রায় অর্ধশতক আগে এস্পত্র কাব্যে নারী প্রকাশ করেন তার প্রেম, ক্ষোভ, দুঃখ, তিরস্কার, বেদনা, শোক-উপহাস-সতেজ কামনা দৃপ্ত আত্ম ঘোষণা ও যন্ত্রণা সব ভাসিয়ে নেওয়া উচ্ছ্বাস কখনো দায়িত্বের কাছে কখনো স্বামীর কাছে বিবাহিতা রমণীর বিয়ে বহির্ভূত প্রেমের পত্রও রচিত হয়েছে এ কাব্যে আবার জনা পুত্রের জন্য কাতর কিন্তু তার চাইতেও কাতর স্বামী রাজা নীলধ্বজের আচরণে যে সন্ধি করেছে পুত্র জনার সাথে তাইতো তার রাজপুরী ত্যাগ করে চলে যাবার যে ইচ্ছে এবং দৃঢ়তা এখানেই মধুসূদনের কৃতিত্ব।
শুরুতে মেঘনাদ বধ কাব্যের প্রমীলার সহমরণের বিষয়টি এলেও স্বীকার করতেই হয় এ কাব্যে কবি নারীদের তেজস্বিতা নির্ভীকতা নতুনভাবে প্রতিভাত মাইকেলের রচনায়-এ কাব্যের মধ্য দিয়ে সীতার প্রতি সহমর্মিতা ও সমবেদনার পাবল্যও যেমন শুরু হয় নতুনভাবে তেমনি উর্মিলা যে ভাষায় রামের সম্বন্ধে কথা বলেন-যা একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ও দৃঢ়চেতা নারীর পক্ষেই সম্ভব।
আর প্রমীলা ?-

“কি কহিলি বাসন্তী, পর্বত গৃহ
ছাড়ি বাহিরায় যাবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশ্যে
কার যেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
দানব নন্দিনী আমি, রক্ষঃ কুল বধূ
রাবন শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী
আমি কি ডরাই, সখি, ভিখারী রাঘবে?”
এ উক্তি বাংলা সাহিত্যে তো ইতিহাস হয়ে আছে।
কাব্য সূত্র:-
১। মধুসূদনের বীরাঙ্গনা- ড. গুলশান আরা
২. উইকি সংকলন-তারা পত্রিকা
৩. আশার ছলনে ভুলি-গোলাম মুরশিদ।
(সংগৃহীত)