ভ্রান্ত দ্বৈত দ্বন্দ্বের বেড়াজালে আটকেপড়া অর্থনীতির পুনরুদ্ধার

ববি বড়ুয়া »

বিশ্বব্যাপী ধ্রুপদী সমস্যা তৈরি হয়েছে। জীবন-জীবিকার ভ্রান্ত দ্বৈত দ্বন্দ্বের বেড়াজালে আটকা পড়েছে অর্থনীতি। জীবন বাঁচাতে জীবিকার প্রয়োজন। আবার জীবিকাহীন জীবন বিপন্ন।
কোভিড ১৯ এর প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি অবরুদ্ধ। এই অবস্থা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে। বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো যেখানে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অবস্থা আরো করুণ। যতোটা কোভিড ১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে ততোটাই জীবনকে ধারণ করার জন্য যা যা প্রয়োজনÑশিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, খাদ্য ও কর্মসংস্থান নিয়ে।
বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ নির্ভর করে রপ্তানি আয় এর ওপর। আর রপ্তানি আয়ের ৮৪% নির্ভর করে পোশাক শিল্পের ওপর। অথচ কোভিড ১৯ এ লকডাউন এর কারণে ইউরোপ, আমেরিকার মতো রপ্তানিমুখি দেশগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত বন্ধ। ফলে ফ্যাশন ব্রান্ডগুলো বাংলাদেশ হতে আমদানি প্রায় বন্ধ করেছে এবং প্রায় কয়েক শ’ কোটি ডলারের কার্যাদেশ বাতিল করেছে।
এর ফলে গত অর্থবছরেই বাংলাদেশে আমদানি রপ্তানি অর্থাৎ বাণিজ্য ঘাটতি দাঁডিয়েছে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা। আমদানি রপ্তানির মতো গুরুত্বপূর্ণ উৎস প্রবাসী-আয় সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তবে অর্থনীতি বাঁচাতে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারও বৃহৎ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসহ কৃষিখাতে বড় অংকের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে বেশ শুরুতেই।। বিচক্ষণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের দ্রুত বাস্তবায়নের ফলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। একই সাথে কার্যকর উৎপাদন এবং সঠিক সময়ে শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লকডাউন শিথিল করা এবং সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের দ্রুত বাস্তবায়নের ফলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে এগুচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুবিন্যস্ত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনীতির উপর নজর দিয়েছেন শুরু থেকেই।। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা আমদানি ব্যয় হয়। ফলে দেশের ৫০ কোটি ৪৮ লক্ষ ৪৬ হাজার একর জমি ও ৫ কোটি ৬৪ লাখ ৮১ হাজার একর পুকুরকে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে।
চলতি বছরে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮.২ %। কিন্তু এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো মহামারির এই দুঃসময়ে সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেনÑ‘সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় করোনাকালে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নতুন মুদ্রানীতি ও কর্মসংস্থান বাড়ানোয় জোর দিতে হবে’। ফলে অর্থনীতির এমন পরিস্থিতিতে রপ্তানির জন্য বিকল্প বাজার ও রপ্তানি পণ্যের বহুমুখিকরণ করা দরকার। বর্তমান আর্থিক সঙ্কট কাটাতে বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়াতে হবে। এ জন্য যেসব দেশে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা ভালো সেসব দেশের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি বা পশ্চিমা দেশের উপর নির্ভরতা কমিয়ে অন্যদিকে এর প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি রপ্তানি সম্ভাবনাময় পণ্য, যেমন-কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, বাইসাইকেল, প্লাস্টিক, ফার্নিচার প্রভৃতি চাহিদাসম্পন্ন পণ্যের বাজার সৃষ্টি করতে হবে। অর্থাৎ রপ্তানির বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে।
কোভিড-১৯ এ অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (ওগঋ) এর পূর্বাভাসে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ১.৬ % থেকে ৩.৮ % এরমধ্যে নেমে আসবে বলে ধারণা করলেও গত ৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরে বাংলাদেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি আসে ৫.২৪% যা একধরনের ইতিবাচক বলা চলে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অউই ইতিমধ্যেই ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ এবং ৪০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে আরো ৯ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশকে দেবে।
একইসাথে আশার কথা হলো, যেখানে করোনায় সারা বিশ্বের অর্থনীতি বিধ্বস্ত সেখানে জুনÑজুলাই মাস হতে বৈদেশিক রেমিটেন্স এবং রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বলা চলে, একই মানের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এই সংকটকালীন অবস্থাতেও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী পরিস্থিতিতে প্রবেশ করেছে।
কিন্তু মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে জাতীয় আয়ের শুধু মাত্র ১% স্বাস্থ্যখাতে ব্যবহার, যা কখনোই কাম্য হতে পারে না। কারণ দেশের জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পারলে দৃশ্যমান মেগাপ্রকল্পগুলোর কোন প্রয়োজন নেই। একই সাথে কর আদায়ের সংস্কার জোরদার করা, বিদেশে টাকা পাচারের নজরদারি বৃদ্ধি করা, ব্যাংকিং খাতে সংস্কার, কঠোর হাতে দুর্নীতি দমন, পুঁজিবাজারে সংস্কার এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে। যা এবার করোনায় ত্রাণ বিতরণ দুর্নীতিতে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে। বেকারত্ব নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্রিয়াশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমকে মুক্তভাবে বিচরণের সুযোগ দিতে হবে, আইনসভার কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঠিক দিক নির্দেশনা এবং গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নে দেশে কর্মরত সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ দেশের আপামর জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা দ্রুত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং সম্ভাবনার পথে এগিয়ে নিতে পারবো। একইসাথে জীবন-জীবিকার ভ্রান্তির বেড়াজাল হতেও মুক্ত হতে পারবো।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক, কলেজ শিক্ষক