নিরপেক্ষতা উপহাসের বিষয়!

শঙ্কর প্রসাদ দে »

নিরপেক্ষ থাকা নিয়ে আলোচনার বিরাম নেই। ব্যক্তির নিরপেক্ষ অবস্থান বা প্রশাসনের নিরপেক্ষতা বহুল আলোচিত বিষয়, দেখা যাচ্ছে নিরপেক্ষতাকে নৈর্ব্যক্তিক করে তোলা হচ্ছে। অথচ নিরপেক্ষতা বিবেচনার মাপকাঠি হচ্ছে সত্য, ন্যায় আর বিধিÑবিধানের প্রতি অনুগত থেকে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন। শত্রুÑমিত্র থেকে সমদূরত্বে থাকা কিংবা সত্যÑমিথ্যার আবরণ আড়াল করে নিজের সুবিধা বা স্বার্থ সুরক্ষা নিরপেক্ষতা হতে পারে না।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আমরা নিরপেক্ষতা নিয়ে অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হই। আমার শিক্ষক স্ত্রীর প্রমোশন বিষয়ে শিক্ষাভবনে গেলাম। কর্মকর্তা বললেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী প্রমোশনে কলেজ কর্তৃপক্ষ ফরোয়ার্ড করলে উনিই প্রমোশন পাবেন। আমি বেকুবের হাদা বললাম, কলেজ কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় নিরপেক্ষ ও ন্যায়ের পক্ষে থাকবেন। তিনি আবার বললেন, আমাদের অভিজ্ঞতা, কলেজ কর্তৃপক্ষ সাধারণত নিরপেক্ষ থাকেন না। তারা নানামুখী চাপে যোগ্য ব্যক্তির বদলে অযোগ্য ব্যক্তিকে সিলেকশন দিয়ে থাকেন। তখন সরকারের কিছুই করার থাকে না।
এই প্রথম ধাক্কা খেলাম। বলেন কি ভদ্রলোক। শেষ পর্যন্ত তাঁর কথাই সত্য হল। সত্যি সত্যি যখন প্রমোশনের প্রসঙ্গটি এলো, কলেজ কর্তৃপক্ষ ঠিকই পেছনের ইনডেক্স ধারীকে সুপারিশের ব্যবস্থা করল। সেদিন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের ন্যক্কারজনক ভূমিকা একটি কালো দাগ রেখে গেল। প্রমোশনের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল মানÑসম্মানের প্রশ্ন। কলেজের সভাপতি সংসদ সদস্য আবুল কাশেম মাস্টার সাহেবের হস্তক্ষেপে শেষ রক্ষা। আমার বাবার কথাই সত্য হল। তিনি এইভাবে বলেছেন, শিক্ষকদের মনের দিগন্ত বড় হয় না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, তবে এ সমাজে বহু মানুষ সুযোগ পায় না বলে ঐসব সৎ মানুষগুলোকে পারিবারিক জীবনে দেখা যাবে অন্যরূপে। বিচারাঙ্গনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এক কঠিন কাজ। আইনি ব্যাখ্যায় বিচারক ভুল করতেই পারেন। সেটি মোটেও দোষের নয়।
দেশের অনেক আদালতেই দেখলাম, আইনজীবী আত্মীয় বা রাজনৈতিক চেনামুখ হলে সুবিধা দেন অনেক। এখানে আইনের চেয়ে ব্যক্তিগত অনুভূতি, ভবিষ্যতের প্রয়োজন, ব্যক্তিগত পছন্দ প্রাধান্য পায় বেশি। জীবনের এ প্রান্তে এসে বুঝলাম, বিচারাঙ্গনে আইনকে প্রাধান্য দিলে এতো পক্ষপাত হতো না।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এদেশে নিরপেক্ষতার চেয়ে পক্ষপাত বেশি। মাজদার হোসেন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগকে পৃথক করার কথা বলেছিল। মঈনÑউÑআহমেদ সেটির দাপ্তরিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া সম্ভব হয়নি। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও সরকারের সাথে বিরোধের সূত্রপাত ওখান থেকে। বুঝলাম নিরপেক্ষতাও একটি আপেক্ষিক শব্দ।
স্বাধীনতাত্তোর কোন সময়েই দেশের প্রশাসন নিরপেক্ষ পথে হাঁটেনি। নিয়োগ, প্রমোশন, সম্পদের বণ্টনসহ সর্বক্ষেত্রে আইনের চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক নৈকট্য ইত্যাদি। শুরু থেকে এ রাষ্ট্র আইনকে প্রাধান্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো অবস্থার তেমন হেরফের হয়নি। আমার এক অনুজপ্রতিম প্রমোশনের জন্য যোগ্য এবং যথাযথ মার্কিং নাম্বার থাকার পরও সে সিনিয়র সহকারী সচিব। আবার তার চাকরি পঁচিশ বছর হতে চলল। তার অপরাধ, ইউএনও থাকাকালীন নেতার কথামত ভোট পরিচালনা করেননি। ছাত্রজীবনে একনিষ্ঠ বাসদ কর্মি হওয়া সত্ত্বেও সরকারের খাতায় এখন সে রাজাকারতুল্য। সবচেয়ে বেশি আইনের ব্যত্যয় হয়েছে এদেশের আমলাতন্ত্রে। ফলে আইনানুগ একটি সমাজ গড়তে না পারায় আজকের এই পরিণতি। বিগত তিন দশক ধরে রাজনীতিতে সব’চে বিতর্কিত ও গর্হিত বিষয় হলো নিরপেক্ষতা। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদকে দিয়ে এই চর্চার শুরু। শেষ কবে হবে জানি না। যদিও সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দিয়েছেন কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে, একটি নিরপেক্ষ অর্থাৎ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। নিরপেক্ষতার চৌহদ্দি কি? একজন ব্যক্তি কতদূর বা কি রকম আচরণ করলে নিরপেক্ষ বলে ধরে নেব। তার বর্ণনা কি? নাকি আদৌ কোন ব্যক্তিকে নিরপেক্ষ বলে গণ্য করার সুযোগই নেই?
বেগম খালেদা জিয়ার মতে পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন। তিনি যে দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন, সেদিক থেকে শিশু এমনকি পাগলও নিরপেক্ষ নহে। শিশুও পিতামাতা চেনে। পাগলতো কোন সিদ্ধান্তই দিতে পারে না। সুতরাং নিরপেক্ষ বলতে যা বুঝায় তা শিশু ও পাগলের পক্ষে আচরণ করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মতে সর্ষেতে ভূত লুকিয়ে থাকে। মনে হয় বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি কথাটি বলেছেন, ক্ষমতা হস্তান্তর করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ এবং প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান গোটা প্রশাসনকেই এমনভাবে ওলটপালট করেছেন যে, মনে হয়েছে শেখ হাসিনা যাতে ক্ষমতায় ফিরে আসতে না পারে সে লক্ষ্যেই সবকিছু ঘটানো হয়েছে। যদি ধরে নেই যে লতিফুর রহমান যা করেছেন তা আইনসম্মতভাবেই করেছেন, তবে বলতেই হয়, আইনেই ত্রুটি ছিল।
আসলে আইনটাই প্রধান বিষয়। রাষ্ট্রের সবাইকে আইন মান্য করার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হওয়া চাই। অন্যান্য দেশের অন্তর্বর্তী সরকারগুলো কোন অবস্থাতেই আইনি সীমা লঙ্ঘন করেন না। ফলে প্রশাসনের যে কোন ব্যক্তির কর্মকা- হয়ে উঠে রাষ্ট্রের প্রতি পক্ষপাতমূলক, ব্যক্তি বা দলের প্রতি নয়।
ভারত, আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, জাপানের একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আইন মেনেই নির্বাচন সম্পন্ন করেন। এই আইন মান্য করার সংস্কৃতি এদেশে চালু করা যায়নি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আমাদের বাঁধভাঙা আবেগের কারণে সবাই মনে করছিল, দেশ আমিই স্বাধীন করেছি। যা ইচ্ছে তা করার অধিকার আমার। এটা সময়ের সাথে নিয়ন্ত্রণ করা যেতো যদি বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতেন। সামরিক শাসকরাতো ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠানকেই অক্ষত রাখেননি। তারা ক্ষমতা নিয়েছে আইন ভঙ্গ করে। এ অবস্থা থেকে ফিরতেই হবে। আইনের সংস্কার করতে হবে দায়িত্ব পালনের সাথে দায়িত্ব পালনের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রেখে। এখন আমরা নিরপেক্ষতা নিয়ে উপহাস করছি। এই চক্র থেকে বের হতে হলে আইন সংস্কার এবং আইন মান্য করার সংস্কৃতিতে ফেরা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট