বিশ্ব নদী দিবসে নদীময় ভাবনা

মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি :

সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রবিবার বিশ্ব নদী দিবস। বিশ্বের নদীসমূহের অবস্থা, শঙ্কা-সংকট, অবস্থান, অবদান,দূষণ-শোষণ এবং নদীর অংশীজনদের দায়িত্ববোধ, করণীয় প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা, সমালোচনা, সচেতনতা সৃষ্টি ও বিস্তৃত করার দিবস বিশ্ব নদী দিবস।

পৃথিবীর দেশে দেশে এই দিনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে মানুষের চেতনাকে-ভাবনাকে নদীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। মানুষের দায়িত্ব, বোধকে নদীবাস্তবতার সাথে সংমিশ্রিত করা হয়। নদীর উপকারিতা, সহযোগিতা, পরিবেশ বাস্তবতা, শঙ্কা-সংকট, দখল-দূষণ, সেবা- প্রভৃতি বাস্তবতা ও চিন্তা-চেতনা নিয়ে কথা বলা হয়। নদীর দূষণ-দখল, পরিচর্যা প্রভৃতি বিষয়ে তুলনামূলক পর্যালোচনা এই দিনের বিশেষত্ব।

নদী পৃথিবীর বাস্তুজগতের জীবন্ত সত্তা। নদীর বয়ে চলার, প্লাবিত হওয়া, পলল-প্লাবনভূমি সৃষ্টি করার অধিকার আছে। এটি প্রাকৃতিক বাস্তবতা। নদীর প্রবাহকে আটকে দিয়ে, দেহকে দখল করে, নাব্যতাকে সংকটাপন্ন করে নদীকে নদী থাকতে না দেয়া, নদীকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা, নদীর গতিপথ বন্ধ করে দেয়া, সুস্থ স্বাভাবিক মানবিক কাজের পরিচায়ক নয়।

দেশে দেশে মানুষের, পরিবেশের, প্রকৃতির উপকারী প্রাকৃতিক এই সত্তাটি সংকটাপন্ন, সংশয়াকুল, বিপদাপন্ন।

মানুষ বৃদ্ধির সাথে সাথে, সভ্যতার পথে চলে চলে মানুষের আগ্রাসনের শিকার, অব্যবস্থাপনার শিকার, দেশে দেশে নান্দনিক, ঐতিহাসিক নদনদীসমূহ। পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে, অঞ্চল নির্বিশেষে নদী সঙ্কটের চরিত্র অভিন্ন। নদীকেন্দ্রিক সামাজিকতা, সংস্কৃতিকতা, জীবন ব্যবস্থা, প্রকৃতি, অর্থনৈতিক কর্মকা- মানুষ বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন বৈপরীত্য অতিক্রম করছে।

নদীকে নদী থাকতে না দেয়া। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা। পানি বণ্টনে বিরোধ-বিতর্কের সৃষ্টি হওয়া। আন্ত ও আন্তর্জাতিক নদীসমূহের সম্পদের বণ্টন, পানির প্রবাহের হিস্যায় মতান্তর, শিল্পের সাথে সম্পৃক্ততা, সংশ্লিষ্টতা, সংকটাপন্নতা নদীকে বিপন্ন করে তুলেছে।

আন্তর্জাতিক এই শঙ্কাটি  যথাযথভাবে অ্যাড্রেস করা হচ্ছে না, যাচ্ছে না। দেশে দেশে নান্দনিক যেসকল নদনদী আছে, তা আমাদের প্রাকৃতিক মূলধন। বর্তমান বিশ্বের টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের সিংহভাগ জুড়ে জল ও স্থল বাস্তুতান্ত্রিকতা সংরক্ষণ, সুপেয় পানির সুব্যবস্থাপনা, সুস্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধা নিবারণ, নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, জলবায়ু কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

পৃথিবীর অনেক দেশেই বিশেষায়িত নদী হিসেবে জাতীয় নদী আছে। নদীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কোথাও কম নেই। নদীর মৎস্য সম্পদ পৃথিবীর মানুষের পুষ্টির যোগান দেয়, দেশকে সমৃদ্ধ করে।

নদী দেশে দেশে, অঞ্চলে অঞ্চলে মানুষের সাংস্কৃতিক-সামাজিক ঐতিহ্যকে বর্ধিত করেছে, লালন করেছে, টেকসই করেছে। নদী যখন দেয় উজাড় করে দেয়। পৃথিবীর অপরাপর সৃষ্টি জীবের ভেতর নদীকে বেশি ব্যবহার করেছে, নদীর সম্পদ বেশি লণ্ঠন করেছে মানুষ। মানুষ পৃথিবীতে প্রাকৃতিক সম্পদসহ  অন্যান্য সম্পদের অধিকারী হয়েছে।

নদীর সম্পদ পৃথিবীর মানুষের সম্পদ। নদী বেঁচে থাকলে, নাব্য থাকলে এই সম্পদগুলোর প্রবৃদ্ধি ঘটে, ঘটবে। মানুষের সভ্যতা-সমৃদ্ধির জন্য, পৃথিবীর আয়ু প্রবৃদ্ধির জন্য, পৃথিবীতে উত্তরাধিকার প্রজন্মকে পৃথিবীর সম্পদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষার জন্য নদীর প্রতি আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিত।

দেশে দেশে নদীসমূহের সংকট- সংশয়কে দূর করে নদীগুলোকে জীবন্ত রাখা উচিত। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি না। অন্যদের দায়িত্ব পালনেও সংকটের সৃষ্টি করছি। মানুষ হিসেবে পৃথিবীর প্রাকৃতিক মূলধনের পরিচর্যা, সংরক্ষণ এবং মানুষের মাঝে তার যৌক্তিক বণ্ঠন প্রবণতা শিক্ষা নেয়া অত্যন্ত জরুরি।

পানি পৃথিবীর অবারিত সম্পদ নয়। প্রাকৃতিক পানির বাহক নদ-নদী, জলাশয়, জলাধার স্রোতস্বিনী, খাল-বিল প্রভৃতি। নদীর সুরক্ষা এবং সংরক্ষণ, জলাধারের সুরক্ষা এবং সংরক্ষণ অন্যান্য বাস্তুতান্ত্রিক সম্পদেরই সংরক্ষণ। এটি পরিবেশেরই সংরক্ষণ, জীবনেরই সুরক্ষা এবং সংরক্ষণ। পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদকে সংরক্ষণ, সুরক্ষিত করেই পৃথিবীতে প্রাণের ধারাবাহিকতা, নিরাপত্তা, নিবিড়তা সংরক্ষণ ও টেকসই করা যায়। এর অন্য কোন বিকল্প নেই।

পৃথিবীর অম্লগ্যাস সাগর দ্বারা শোষিত হচ্ছে। আগামীদিনের সাগর সুস্থ থাকবে না। সাগরেরই জল বাহক নদী-খাল, জলাশয়। নদীকে সুরক্ষিত রেখে সাগরকে সুরক্ষিত রাখার কথা ভাবতে হবে। আগামী প্রজন্মের টেকসই জীবন ও ভবিষ্যতের ধারাবাহিকতা ভাবতে হবে। পৃথিবীর স্থায়িত্বের জন্য পৃথিবীর সম্পদগুলোকে সুরক্ষিত করতে হবে। প্রাকৃতিক মূলধনগুলোকে ধ্বংস করা যাবে না। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাকৃতিক মূলধন। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীপথ সংকুচিত হয়েছে। পঁচিশ হাজার কিমি থেকে সাড়ে তিন হাজার কিমিতে নেমে এসেছে।  এটি ভয়াবহ একটি পরিবর্তন। অবশিষ্ট যা আছে সেগুলোকে সুরক্ষিত করতে হবে, নাব্য রাখতে হবে। বিশ্ব নদী দিবসের  ভাবনায় নদীপথের নাব্যতা এবং সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা দূর করে নদীকে জীবনের জন্য, জীবের জন্য, সমাজের জন্য উন্মুক্ত, অবারিত রাখতে হবে। সুস্থ, স্বাভাবিক, পরিচ্ছন্ন নদী প্রবাহ সুস্থ জীবনের পরিচায়ক, পরিবাহক। বিশ্বে মানুষ বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। প্রাকৃতিক সকল প্রকার সম্পদের সংকোচন  প্রয়াস রোধ করতে হবে।

পদ্মা-মেঘনা-যমুনা কেন্দ্রিক যে জাতীয়তা বোধ, সুরমা-কুশিয়ারা-গোমতী কেন্দ্রিক যে আঞ্চলিকতা বোধ, কর্ণফুলী-হালদা-সাংগু-মাতামুহুরী কেন্দ্রিক যে সমৃদ্ধ সামাজিক সংস্কৃতি, কপোতাক্ষ-রুপসা-ভৈরবের যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব, করোতোয়া-ইছামতি-তিস্তা-ঘাঘট-নারোদ প্রভৃতি নদী কেন্দ্রিক যে আঞ্চলিক বিশেষত্ব, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-সোমেশ্বরী-কংশ-শঙ্খ অববাহিকার যে সামাজিক আবেদন- এই সবগুলোকেই অক্ষত, সুরক্ষিত, সুসজ্জিত, সুবিন্যাস্ত, অবাধ রাখতে হবে।

বিশ্ব নদী দিবস আমাদের ঐতিহ্যকে জাগানোর, জড়ানোর একটি সামাজিক সচেতনতা দিবস।সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ ঐতিহ্যকে বর্জন করতে পারে না। ঐতিহ্যের চর্চার যে ঐতিহাসিকতা আছে, তাকে বাদ দেয়া যাবে না। সাম্পান মাঝির আঞ্চলিক গান, ভাটির দেশের ভাটিয়ালি গান, পালতোলা নৌকার ঐতিহ্যবাহী আনাগোনা, ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে আমি আর বাইতে পারলাম না’ অথবা ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’ প্রভৃতি ঐতিহ্যিক উচ্চারণগুলো ভুলে গিয়ে সংস্কৃতি চর্চা করে শেকড়ের সন্ধান পাওয়া যাবে না। আমাদের অগ্রগতি, উন্নয়ন অভিযাত্রা, অদম্যযাত্রা হবে শেকড়ের সাথে সম্পৃক্ত থেকে, শেখরকে স্পর্শ করতে।

বিশ্ব নদী দিবসের  প্রাক্কালে আমাদের নদীর পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে। নদী ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার সর্বপ্রকার কর্মকা- হাতে নিতে হবে। সংস্কৃতিকে, সামাজিকতাকে নদীময় করে অনন্ত জীবন প্রবাহে যুক্ত করতে হবে। নদীর স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন প্রবাহের চেতনার মধ্য দিয়ে সামাজিকতাকে, সংস্কৃতিকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আসুন জীবনকে পরিচ্ছন্ন নদীময় করার চেষ্টা করি।

 

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, কর্ণফুলী গবেষক