বিজ্ঞান : ‘ব্ল্যাকহোল’ একদিন পৃথিবী গিলে খাবে

Black hole or a neutron star and pulling gas from an orbiting companion star.

সনেট দেব :

মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ও প্রকৃতিবিষয়ক একটি বহুল প্রচলিত রহস্য হলো কৃষ্ণগহ্বর বা কৃষ্ণ বিবর (ব্ল্যাকহোল নামেও পরিচিত)। কৃষ্ণগহ্বর মহাবিশ্বের এমন একটি বস্তু যা এত ঘন সন্নিবিষ্ট বা অতিক্ষুদ্র আয়তনে এর ভর এত বেশি যে এর মহাকর্ষীয় শক্তি কোনো কিছুকেই তার ভিতর থেকে বের হতে দেয় না, এমনকি তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণকেও (যেমন : আলো) নয়। প্রকৃতপক্ষে এই স্থানে সাধারণ মহাকর্ষীয় বলের মান এত বেশি হয়ে যায় যে এটি মহাবিশ্বের অন্য সকল বলকে অতিক্রম করে। ফলে এ থেকে কোনো কিছুই পালাতে পারে না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রথম তৎকালীন মহাকর্ষের ধারণার ভিত্তিতে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের বিষয়টি উত্থাপিত হয়।

সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে, কৃষ্ণগহ্বর মহাকাশের এমন একটি বিশেষ স্থান যেখান থেকে কোনো কিছু, এমনকি আলো পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পারে না। এটা তৈরি হয় খুব বেশি পরিমাণ ঘনত্ব বিশিষ্ট ভর থেকে। কোনো অল্প স্থানে খুব বেশি পরিমাণ ভর একত্র হলে সেটা আর স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতে পারে না। আমরা মহাবিশ্বকে একটি সমতল পৃষ্ঠে কল্পনা করি। মহাবিশ্বকে ভাবা যাক একটি বিশাল কাপড়ের টুকরো হিসেবে এবং তারপর যদি কাপড়ের ওপর কোনো কোনো স্থানে কিছু ভারী বস্তু রাখা হয়, তাহলে কি দেখা যাবে? যেসব স্থানে ভারি বস্তু রয়েছে সেসব স্থানের কাপড় একটু নিচু হয়ে গিয়েছে। এই একই ব্যাপারটি ঘটে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও। যেসব স্থানে ভর অচিন্তনীয় পরিমাণ বেশি, সেসব স্থানে গর্ত হয়ে আছে। এই অসামান্য ভর এক স্থানে কু-লিত হয়ে স্থান-কাল বক্রতার সৃষ্টি করে। প্রতিটি গ্যালাক্সির স্থানে-স্থানে কম-বেশি কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিতের কথা জানা যায়। সাধারণত বেশির ভাগ গ্যালাক্সিই তার মধ্যস্থ কৃষ্ণগহ্বরকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান।

কৃষ্ণগহ্বর শব্দের অর্থ কালোগর্ত। এর এই নামকরণের পেছনের কারণ হল : এটি এর নিজের দিকে আসা সকল আলোকরশ্মিকে শুষে নেয়। কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোনো আলোকবিন্দুই ফিরে আসতে পারে না ঠিক থার্মোডায়নামিক্সের কৃষ্ণবস্তুর মতো। অনেকদিন পর্যন্ত কৃষ্ণগহ্বরের কেনো প্রত্যক্ষ দর্শন পাওয়া যাচ্ছিল না। কারণ এ থেকে আলো বিচ্ছিুরিত হতে পারে না। যে-কারণে একে দেখা সম্ভব নয়, কিন্তু এর উপস্থিতির প্রমাণ আমরা পরোক্ষভাবে পাই। কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিতের প্রমাণ কোনো স্থানের তারা বা নক্ষত্রের গতি এবং দিক দেখে পাওয়া যায়। মহাকাশবিদগণ ১৬ বছর ধরে আশেপাশের তারাম-লীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে ২০০৮ সালে প্রমাণ পেয়েছেন অতিমাত্রার ভরবিশিষ্ট একটি কৃষ্ণগহ্বরের, যার ভর সূর্য থেকে ৪ মিলিয়ন গুণ বেশি এবং এটি আকাশগঙ্গার মাঝখানে অবস্থিত। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে লাইগো সংগঠন মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রথম প্রত্যক্ষভাবে শনাক্তকরণের ঘোষণা দেয়, যা ছিল দুটি কৃষ্ণগহ্বরের একত্রীভবনের প্রথম পর্যবেক্ষণ। ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ১১টি মহাকর্ষীয় তারঙ্গিক ঘটনা পর্যবেক্ষিত হয়েছে, যার মাঝে ১০টি ঘটনা কৃষ্ণগহ্বরের একত্রীভবনের ফল এবং ১টি ঘটনা দ্বৈত নিউট্রন তারা একত্রীভবনের ফলে সৃষ্টি। ২০১৭ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ দ্বারা মেসিয়ে ৮৭ ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত অতিভারী কৃষ্ণগহ্বরের পর্যবেক্ষণের পর, দীর্ঘ বিশ্লেষণ শেষে ১০ এপ্রিল ২০১৯ সালে প্রথমবারের মত একটি কৃষ্ণবিবর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রত্যক্ষ চিত্র প্রকাশিত হয়।

পৃথিবী হলো সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ। যেখানে মানুষ বসবাস করে। সূর্যের পরিবারের অন্যতম সদস্যও বটে। এ গ্রহপুঞ্জগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা নামের একটি ছায়াপথে। যার ঠিক মাঝখানে রয়েছে বিশাল এক কৃষ্ণগহ্বর। বিশ্বজুড়ে মহাকাশবিজ্ঞানীদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন ১৯৮৫ সাল থেকে বলে আসছিল, আকাশগঙ্গার কেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বর স্যাগিটেরিয়াস-এ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব ২৭ হাজার ৭০০ আলোকবর্ষ। কিন্তু এখন নতুন এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, স্যাগিটেরিয়াস-এ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আসলে ২৫ হাজার ৮০০ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ প্রচলিত ধারণার চেয়ে পৃথিবী ওই কৃষ্ণগহ্বরের আরও দুই হাজার আলোকবর্ষ কাছে অবস্থান করছে। এখানে শূন্য মাধ্যমে আলো প্রতি সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। এভাবে এক বছরে আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করে, তাই এক আলোকবর্ষ। তাহলে বুঝা যাচ্ছে, পৃথিবী ওই কৃষ্ণগহ্বরের আরও কাছে চলে এসেছে।

যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, নতুন গবেষণাটি প্রকাশ করেছে জাপান থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী পাবলিকেশনস অব দ্য অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি অব জাপান। গবেষণাটি করেছেন জাপানের মহাকাশ প্রকল্প ভিএলবিআই এক্সপ্লোরেশন অব রেডিও অ্যাস্ট্রমেট্রির (ভিইআরএ) বিজ্ঞানীরা। ২০০০ সাল থেকে এ প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা আকাশগঙ্গায় বিভিন্ন বস্তুর বেগ ও বিশেষ কাঠামোর ত্রিমাত্রিক ছবি দাঁড় করানোর কাজ করে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে আকাশের বিশদ ছবি পেতে দূরবীক্ষণযন্ত্রের মাধ্যমে আলোর ব্যতিচার, রেডিও বা শব্দতরঙ্গ কাজে লাগানো হয়েছে। এ জন্য জাপানজুড়ে বসানো হয়েছে রেডিও টেলিস্কোপ। এতে বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণক্ষমতা এতটাই বেড়েছে যে চাঁদের বুকে একটি কয়েন পড়ে থাকলেও তা তাঁরা শনাক্ত করতে পারবেন। গবেষণা নিবন্ধে আরো জানানো হয়, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত কাজে লাগিয়ে ভিইআরএ প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা আকাশগঙ্গার বিভিন্ন বস্তুর অবস্থান ও বেগ নির্ণয় করেছেন। তাঁরা আকাশগঙ্গার কেন্দ্রের অবস্থানও শনাক্ত করেছেন। ঠিক এ কেন্দ্রেই রয়েছে বিশাল কৃষ্ণগহ্বর স্যাগিটেরিয়াস-এ স্টার। কৃষ্ণগহ্বর হলো মহাবিশ্বের এমন একটি এলাকা, যেখানে প্রবল মাধ্যাকর্ষণ বল বিরাজমান। এ বল এতটাই শক্তিশালী যে ওই এলাকা থেকে আলোকরশ্মিও বের হতে পারে না। বিজ্ঞানীদের মতে, বিপুল ভরের কোনো নক্ষত্রের মৃত্যুর পর তা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়। এরপর ক্রমেই আশপাশের অন্যান্য বস্তু গিলে নিয়ে এবং তাদের ভর নিজের মধ্যে ধারণ করে কৃষ্ণগহ্বরটি বড় হতে থাকে। আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে যে কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে, তা সূর্যের চেয়ে ৪২ লাখ গুণ বড়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বেশির ভাগ ছায়াপথেরই কেন্দ্রে এমন বিশাল আকৃতির কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে।

এ গবেষণায় আরও চমকপ্রদ তথ্য জানা গেছে। আকাশগঙ্গার কেন্দ্রের চারপাশ ঘিরে পৃথিবীর গতি এতদিন জানা ছিল প্রতি সেকেন্ডে ২২০ কিলোমিটার। কিন্তু নতুন গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, পৃথিবীর এ গতি আসলে প্রতি সেকেন্ডে ২২৭ কিলোমিটার। বিজ্ঞানীদের দাবি, স্যাগিটেরিয়াস-এ আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে সর্বশেষ ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ৩৫ লাখ বছর আগে। ওই ঘটনার ৬ কোটি ৩০ লাখ বছর আগে গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবী থেকে ডাইনোসররা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়। স্যাগিটেরিয়াস-এ এর কারণে ওই বিস্ফোরণের পর আকাশগঙ্গার কেন্দ্র থেকে দুইদিকে মেঘের মতো চোঙাকৃতির দুটি পারমাণবিক রেখা ২ লাখ আলোকবর্ষ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওই বিস্ফোরণের পর কৃষ্ণগহ্বরটির আচরণ যেন অনেকটা ‘ঘুমন্ত ড্রাগনের’ মতো। পৃথিবী একদিন এ কৃষ্ণগহ্বরের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে তা স্পষ্ট ধারণ করা গেলেও তবে কখন কিংবা কত সময় পর এমন ঘটনা ঘটবে এর কোনো ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত দিতে পারেননি মহাকাশবিজ্ঞানীরা।

 

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া ও বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা