বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু

সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার :

গ্রামের একটি বিদ্যালয়ে ইন্সপেক্টর এসেছিলেন। ছাত্রদের পাঠোন্নতি পরীক্ষার জন্যে তিনি হঠাৎ একটি শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করলেন। শিক্ষক তখন ছাত্রদের ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের বোধোদয় থেকে পড়াচ্ছিলেন। ইন্সপেক্টর বইটি নিয়ে কোনো এক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চিরুনি’ শব্দের অর্থ কী। ছাত্রটি কিছুক্ষণ আমতা আমতা করলো, উত্তর দিতে পারলো না। ইন্সপেক্টর পর পর আরও কয়েকজন ছাত্রকে একই শব্দের অর্থ  জিজ্ঞেস করলেন, তারাও নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর ইন্সপেক্টরের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো ক্লাসের কোণার বেঞ্চিতে একটি ছাত্রের প্রতি। তিনি ছাত্রটিকে বললেন, বলতে পারো চিরুনি শব্দের অর্থ কী? চিরুনি শব্দের অর্থ ফাড়ুনি স্যার — ছেলেটি দাঁড়িয়ে ঝটপট উত্তর দিলো। ছেলেটির এমন বোকামিপূর্ণ উত্তর শুনে শিক্ষক মনে মনে ক্ষেপে গেলেন। ভুল উত্তর দিলেও ইন্সপেক্টর কিন্তু ছেলেটির উত্তরে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। ইন্সপেক্টর প্রধান শিক্ষককে বললেন, ছেলেটির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখবেন। তার স্বাধীন চিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তি আছে। সে জানে চেরা শব্দের অর্থ ফাড়া এবং সে-হিসেবে সে আপন জ্ঞান বুদ্ধিতে চিরুনি শব্দের অর্থ ফাড়ুনি উদ্ভাবন করেছে। ইন্সপেক্টর সস্নেহে ছেলেটির মাথায় হাত রাখলেন। আমাদের কাছে সেদিনের সেই অচেনা অপরিচিত ছেলেটি এখন সবার সুপরিচিত ও শ্রদ্ধেয়। সেই ছেলেটি হলেন বিশ্বখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু।

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু জন্ম গ্রহণ করেন ঢাকা শহরের কাছে ধলেশ্বরী নদী বিধৌত বিক্রমপুরের রাঢিখাল গ্রামে। জন্মতারিখ ৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ ইং। তাঁর পিতার নাম ভগবান চন্দ্র বসু এবং মাতার নাম রামা সুন্দরী দেবী। পিতা ছিলেন সরকারি পদস্থ অফিসার। পিতার কর্মস্থল ফরিদপুরেই শুরু হয় জগদীশের প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত হলে বালক জগদীশকে ভর্তি করানো হয় কলিকাতা হেয়ার স্কুলে। সেখানে মাস তিনেক লেখাপড়ার পর তাঁকে নিয়ে আসা হয় সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। এ স্কুল থেকে জগদীশ চন্দ্র বসু প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং বৃত্তি লাভ করেন। এরপর ভর্তি হন সেন্টজেভিয়ার্স কলেজে। এ কলেজ থেকে ১৮৭৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৮৮০ সালে বি এসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উচ্চ শিক্ষার জন্যে জগদীশ চন্দ্র বসু বিলাত গমন করেন। ভর্তি হন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে অধ্যয়ন কালে তিনি পদার্থ বিজ্ঞানী অধ্যাপক লর্ড ব্যালি এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ভাইনসের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে  আসেন। জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৮৪ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে ট্রাইপস (তিনটি বিষয়ে অনার্স) নিয়ে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর বিষয় ছিলো পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞান। ১৮৮৪ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু ভারতে ফিরে এসে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেন।

জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৯৪ সালের ৩৬ তম জন্মদিনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি নিজের জীবনকে গবেষণার জন্যে উৎসর্গ করবেন। সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে তিনি সবসময় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন।

১৮৯৫ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে বিদ্যুশক্তির দিক পরিবর্তনের ওপর বক্তব্য রাখেন। তাঁর এই বক্তৃতা বিজ্ঞানী মহলে যথেষ্ট কৌতুহলের সৃষ্টি করেছিলো। এই গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাটি লন্ডনের বিখ্যাত পত্রিকা ইলেক্ট্রিশিয়ানে প্রকাশিত হয়। গবেষণা বক্তৃতাটির জন্যে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৬ সালে জগদীশ চন্দ্র বসুকে ডি এসসি উপাধিতে সম্মানিত করেন।

বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু সর্বপ্রথম বিনা তারে বার্তা প্রেরণের কৌশল আবিষ্কার করে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর সূত্রকে কাজে লাগিয়ে ইতালি র বিজ্ঞানী মার্কনি উত্তরকালে বেতারযন্ত্র আবিষ্কার করেন।

বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর বেশির ভাগ গবেষণা পরিচালনা করেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ওপর। তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাণিদের মতো এরা আচরণ করে। তিনি ক্রোস্কোগ্রাফ নামে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রের সাহায্যে অতি অল্প সময়ে উদ্ভিদদেহে খাদ্য, বৈদ্যুতিক প্রবাহ, বিভিন্ন উদ্দীপনা, প্রতিক্রিয়া সহজেই নিরুপণ করা যায়।

একজন বিজ্ঞানী হিসেবে জগদীশ চন্দ্র বসুর নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো। ১৯১৭ সালে তিনি স্যার উপাধিতে ভূষিত হন। পদার্থ বিজ্ঞান ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানে অবদানের জন্যে লন্ডন রয়েল সোসাইটি ১৯২০ সালে তাঁকে ফেলো নির্বাচিত করে। ১৯২৭ সালে তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সভাপতি মনোনীত হন। ১৯২৬-২৭ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু জাতিসংঘ সম্মেলনের সভ্য মনোনীত হয়ে অনেক দেশ সফর করেন। ১৯৩৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীকে ডি এসসি উপাধিতে ভূষিত করে। বিজ্ঞান সাধনার পাশাপাশি তিনি প্রচুর সাহিত্য সাধনাও করেছেন। বিজ্ঞান বিষয়ক তাঁর অনেক রচনা বাংলাসাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ।

জগদীশ চন্দ্র বসু আজ পৃথিবীতে নেই। ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর তিনি প্রয়াত হয়েছেন। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে-অবদান তিনি রেখে গেছেন তার কল্যাণে তিনি চির অমর হয়ে থাকবেন। ছোট্ট বন্ধুরা তোমরা বড়ো হয়ে এই অমর বিজ্ঞানী সম্পর্কে আরও অনেক জানতে পারবে।