বাংলাদেশ চিনি, তেল, ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যে কবে স্বনির্ভর হবে

পেঁয়াজ নিয়ে প্রতি বছর আলোচনা হয় দামের কারণে।

সুপ্রভাত ডেস্ক »

বাংলাদেশে চিনি, ভোজ্য তেল সহ কয়েকটি পণ্যের দাম হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে এবং এ জন্য কারণ হিসেবে দেখানো যাচ্ছে বিশ্ব বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া। বিজ্ঞানীরা বলছেন এ ধরণের সংকট এড়াতে আমদানি হয় এমন কিছু পণ্যে স্বনির্ভর হওয়ার সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের।

বাংলাদেশে প্রতিবছরই বিভিন্ন সময়ে চিনি, ভোজ্য তেল, পেয়াজ, রসুন ও ডালের মতো জরুরি নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণের দাম বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে এবং এ নিয়ে তুমুল শোরগোলও শোনা যায়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে সরবরাহ কম থাকায় আমদানি ব্যয় বাড়ছে বলেই তার প্রভাব পড়ছে দেশের বাজারে।

কিন্তু এসব পণ্যে কি বাংলাদেশ নিজেই উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে ?

ভোজ্য তেল

বাংলাদেশে ভোজ্য তেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন, যার সত্তর শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন হিসেবে, বাংলাদেশে ভোজ্য তেল উৎপাদন হয় সাড়ে তিন লাখ টনের মতো।

সরকারের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে বাংলাদেশে গত চার বছরের ব্যবধানে জন প্রতি তেল খাওয়ার পরিমাণ বা খাবার তেলের ভোগ প্রায় পাঁচ কেজি করে বেড়েছে। অর্থাৎ প্রতিনিয়তই ভোজ্য তেলের চাহিদা বাড়ছে।

আর এই তেলের মধ্যে বেশি দরকার হয় সয়াবিন তেল, কারণ রান্নার কাজে এই তেল বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

মার্কিন কৃষি বিভাগের হিসেবে, বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ সয়াবিন তেল আমদানিকারক দেশ। এখানে সয়াবিন তেলের বড় অংশই আমদানি করা হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ডাল, তেল ও মসলা বীজ সম্পর্কিত একটি প্রকল্পের পরিচালক খায়রুল আলম বলছেন, বাংলাদেশে যে ভোজ্য তেল উৎপাদন হয় তার বেশিরভাগই সরিষা থেকে।

অন্যদিকে, কৃষি তথ্য সার্ভিসের হিসেবে গত ছয় বছরে প্রায় ৭৭,০০০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন উৎপাদন হলেও তা থেকে পাওয়া সয়াবিন তেল নিষ্কাশনে ব্যবহৃত না হয়ে মুরগী ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এসব কারণে সয়াবিন তেলের বিপুল চাহিদা আপাতত শুধু উৎপাদনের মাধ্যমে মেটানো কঠিন বলেই জানিয়েছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।

চিনি

সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে বছরে চিনির চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন। আর এখন সরকারি চিনিকলে উৎপাদনের পরিমাণ এক লাখ টনেরও কম।

চলতি মৌসুমে উৎপাদন ছিলো মাত্র ৪৯,০০০ মেট্রিক টন। মূলত ব্যাপক লোকসানকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে অন্তত ছয়টি চিনিকলে উৎপাদন বন্ধ রাখায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

ফলে ঘাটতি মেটাতে ব্রাজিল, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়া থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেন বেসরকারি আমদানিকারকরা।

চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের পরিচালক মো: এনায়েত হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, আখ চাষের দরকারি জমিই এখন আর নেই। আবার যারা জমির মালিক তারা প্রকৃত কৃষক না।

“যেসব এলাকায় আখের জমি ছিলো সেখানে এখন আম বা পেয়ারা বাগান হচ্ছে। আবার যারা আখ চাষ যারা করে তাদের জমি নেই। পাশাপাশি ধৈর্য ধরে বিনিয়োগ করার মতো কৃষক খাতে নেই। এসব কারণেই দেশে চাইলেও চিনি উৎপাদন বাড়িয়ে পুরো চাহিদা পূরণ করা কঠিন,” বলছিলেন তিনি।

তবে আধুনিক কারখানা করা, কৃষকদের পৃষ্ঠপোষকতা করার মধ্যে কাঁচামাল সহজলভ্য করা গেলে উৎপাদন অনেকগুণ বাড়ানো সম্ভব হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

পেঁয়াজ

বাংলাদেশের কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। ২০২০ সালে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন। তবে এই উৎপাদন থেকে গড়ে ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়।

ফলে দেশে মোট পেঁয়াজের উৎপাদন গিয়ে দাঁড়ায় ১৮ থেকে ১৯ লাখ টনে। অথচ দেশের বাকি চাহিদা পূরণ করতে প্রায় ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের চাহিদার পুরোটা পূরণ করতে হলে দেশেই অন্তত ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজের উৎপাদন করতে হবে। তাহলে যেটুকু নষ্ট হবে, তা বাদ দিয়ে বাকি পেঁয়াজ দিয়ে দেশের পুরো চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে।

পেঁয়াজের উৎপাদনচিত্র থেকে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ সালে ১.০৮ লাখ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করে উৎপাদন পাওয়া গিয়েছিল ৭.৩৫ লাখ মেট্রিক টন। পরবর্তী ১০ বছরে আবাদি জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৭-১৮ সালে ১.৭৮ লাখ হেক্টর জমি থেকে উৎপাদন পাওয়া গেছে ১৭.৩৮ লাখ টন।

বাংলাদেশে মসলা জাতীয় ফসলের গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালক ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার তারা আশা করছেন আগামী কয়েক বছরে পেঁয়াজ উৎপাদন অনেক বাড়বে।

“এ বছরেই সব ঠিক থাকলে আশা করছি ঘাটতি তিন লাখ টনের মধ্যে নেমে আসবে। উচ্চফলনশীল জাতের পেঁয়াজ চাষ আর উৎপাদন মৌসুমে আমদানি বন্ধ করায় উৎপাদন অনেকে বেড়েছে। আশা করছি এবার ৩৩ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হবে। সরকারের লক্ষ্য ২০২৩ সালের মধ্যে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া,” বলছিলেন তিনি।

রসুন

ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলছেন এ মূহুর্তে বাংলাদেশে পেঁয়াজের তুলনায় রসুনের ঘাটতি অনেক কম। দেশের সাড়ে সাত লাখ টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ছয় লাখ টন উৎপাদন।

তিনি বলেন, যে পনের শতাংশ ঘাটতি আছে সেগুলোর জন্যও উচ্চ ফলনশীল জাতের ব্যবস্থাসহ নানা পরিকল্পনা হচ্ছে।

“আশা করছি এটিতেও কয়েক বছরে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবো। যেটুকু রসুন দরকার হয় সেটুকু আমরাই উৎপাদন করবো,” বলছিলেন তিনি।

ডাল

বাংলাদেশে ডালের (মুগ, খেসারি বা মাসকলাইসহ) চাহিদা বছরে ২৫ লাখ মেট্রিক টন আর উৎপাদন হয় নয় লাখ মেট্রিক টন। বাকিটা আমদানি করা হয় এবং বেশি আসে ক্যানাডা আর অস্ট্রেলিয়া থেকে। আর বাংলাদেশে বেশি ডাল চাষ হয় ফরিদপুর আর বরিশালে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট বলছে, তারা সাতটি ডালের ৪২টি উন্নত জাত ও ৪১টি উন্নত চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।

ডাল গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ড: মোহাম্মদ হোসেন বলছেন, ডালের যত ভ্যারাইটি আছে তা সম্ভাব্য উপযোগী সব জায়গায় চাষ করা গেলে ১৫ লাখ টন পর্যন্ত উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হতে পারে।

“হয়তো পুরো চাহিদা পূরণ করা যাবে না, তবে যথাযথ পরিকল্পনা নিলে অনেকটা সম্ভব। এখন কিছু প্রকল্পও নেয়া হয়েছে। আবার দেশের উত্তরাঞ্চলে বরেন্দ্র এলাকাসহ নানা জায়গায় ডাল চাষও বাড়ছে,” বলছিলেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি