বঙ্গোপসাগরে মাছের আকাল

জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্র দূষণ ও জেলিফিসের উৎপাত

নিজস্ব প্রতিবেদক »

মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে এবং ইলিশ রক্ষায় সফলতা থাকলেও বঙ্গোপসাগরে মাছের পরিমাণ কমছে এবং সামুদ্রিক মাছের কিছু প্রজাতি অনেকটা নিঃশেষ হতে চলেছে। বাংলাদেশের সাগরে মাছের মজুদের কোনো সঠিক হিসাব নেই, কী পরিমাণ মাছ ধরা যাবে তারও সীমা নির্ধারিত নেই।
সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা ও জরিপের মাধ্যমে মূল্যায়ন করে গবেষকরা আশঙ্কা করছেন ভবিষ্যতে বঙ্গোপসাগর মাছশূন্য হয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে, অতিরিক্ত আহরণের কারণে যেকোনো মাছ বাণিজ্যিকভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রবল ঝুঁকি থাকে এবং সুরক্ষার ব্যবস্থা করা না হলে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।


আমাদের যে চারটা ফিশিং গ্রাউন্ড আছে সেগুলো মাছশূন্য হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে। লাক্ষ্যা মাছ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ও মূল্যবান মাছ এবং এই মাছটি মারাত্মকভাবে আহরিত হয়ে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে।
সমুদ্রবিজ্ঞানীদের মতে মাছের বংশবিস্তারের জন্য যে পর্যাপ্ত পরিমাণ রেখে দেওয়া দরকার সেটা যদি আমরা না রাখি, তাহলে পরবর্তী সিজনে বংশবৃদ্ধি হবে না। যেমন গালফ অব থাইল্যান্ড অনেকটা মৎস্যশূন্য হয়ে গেছে। আমরাও চাইবো না, আমাদের বে অব বেঙ্গল সে রকম মৎস্যশূন্য হয়ে যাক।
এদিকে বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ এসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে এবছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে বঙ্গোপসাগরে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। সাগর জুড়ে বিচরণ করছে কেবল জেলিফিস। নামের সঙ্গে ফিশ থাকলেও মূলত জেলিফিশ মাছ নয়। এটি অমেরুদণ্ডী প্রাণী।
জেলিফিশের ২৪টি চোখ চারটি ভাগে ভাগ করা। এক একটি ভাগে রয়েছে ছ’টি চোখ। একটি ভাগের ছ’টি চোখের মধ্যে দু’টিতে রয়েছে লেন্স। তা দিয়ে ছবি দেখতে পায় জেলিফিশ। বাকি চারটি দিয়ে শুধু আলো অনুভব করতে পারে জেলিফিশ। জেলিফিশ অনেক দ্রুত সাঁতার কাটে।
ফিশিং ট্রলারে কর্মরত নাবিকদের মতে বিগত ২০ বছরে এতো পরিমাণ জেলিফিশ সাগরে দেখা যায়নি। অত্যধিক জেলিফিশ বিচরণের কারণে মাছ ফিশিং গ্রাউন্ড ছেড়ে গেছে বলে ধারণা করছেন ফিশিং ট্রলারে কর্মরত অভিজ্ঞরা।
সাগরে জেলিফিশ প্রজাতির প্রাণীগুলো সামুদ্রিক ভীমরুল হিসাবে পরিচিত। অত্যন্ত বিষাক্ত এসব জেলিফিশ সামুদ্রিক মাছের জম। ব্যাপক হারে মৎস্য সম্পদ ধ্বংস করে এরা। সাগরে অর্ধশত প্রকারের জেলিফিশ রয়েছে। তন্মধ্যে ‘বক্স জেলিফিশ’ মাছের জন্য সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর। প্রচুর মাছ খেয়ে ফেলে এসব বক্স জেলিফিশ। বিষাক্ত হওয়ার কারণে জেলিফিশের সাথে স্পর্শ হওয়া মাত্রই যে কোন মাছ মারা যায়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পানির লবণাক্ততা এবং তাপমাত্রার ওপরে জেলিফিশের সংখ্যা অনেকাংশে নির্ভর করে।
সাগরে জেলিফিসের সাম্প্রতিক উৎপাতের বিষয়টি অবগত আছেন সমুদ্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী। তিনি এ জন্য বাংলাদেশের কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত সারের ব্যবহার ও সমুদ্র দূষণকেই বেশি দায়ী করছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এই অধ্যাপক সরকারি জরিপ জাহাজ আরভি মীন সন্ধানীর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের সঙ্গেও যুক্ত। তাঁর মতে, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, সাগরের অম্লতা বৃদ্ধির বিষয়টি মোটামুটি স্বীকৃত সমস্যা। তবে আমাদের দেশে কৃষি জমিতে যে পরিমাণ রাসায়নিক সারের ব্যবহার হয় তা প্রকৃতপক্ষে বৃষ্টির পানিতে করে নদী হয়ে সাগরেই মিশছে। এতে অক্সিজেন কমে যাওয়াসহ আপন বৈশিষ্ট হারাচ্ছে সাগরের পানি। ফলে ক্রমেই নিয়মিত মাছের বিচরণ হুমকিতে পড়ছে। অন্যদিকে জেলিফিস এই পরিবেশ সহনশীল হওয়ায় বিচরণ বাড়ছে তাদের। অধ্যাপক সাইদুর মনে করেন, সাগরের বর্তমান অবস্থা সাময়িক না দীর্ঘস্থায়ী তা এখনই নির্ণয় করা কঠিন। তবে জেলিফিসের সাম্প্রতিক উৎপাত থেকে রেহাই পেতে হলে দেশে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমানোর পাশাপাশি সাগরের পানি দূষণরোধে আশু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন এই সমুদ্র বিজ্ঞানী।
সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে বাংলাদেশে কাঠের তৈরি ট্রলার, মাঝারি ট্রলার এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার ব্যবহৃত হয়। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার সাগরে ৪০ মিটার গভীরতার পরে মাছ শিকার করে। সরকার অনুমোদিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিশিং ট্রলারের সংখ্যা ২৬৪। বর্তমানে সাগরে নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলে প্রায় ২৩০ টির মতো ট্রলার মাছ আহরণে নিয়োজিত আছে। সাগরে আশানুরূপ মাছ পাওয়া না যাওয়ায় অলস বসে আছে অধিকাংশ ট্রলার। মাছ ধরতে গিয়ে অপারেটিং কস্টও তুলতে পারছেন না মৎস্য আহরণ শিল্পে নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ এসোসিয়েশনের মহাসচিব মশিউর রহমান চৌধুরী জানান বিগত দেড় মাসে প্রায় ৩০,০০০ হাজার টন মৎস্য আহরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে ফিশিং জাহাজ মালিকরা। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৩৬ কোটি টাকারও বেশি।
ইলিশকে টার্গেট করে যেভাবে সাফল্য এসেছে মূল্যবান ও অর্থকরী সামুদ্রিক মাছের ক্ষেত্রেও আলাদা করে সুনির্দিষ্ট কৌশল পরিকল্পনা করা দরকার।