বঙ্গবন্ধু : দেহ ও দেহোত্তর সংলাপ

মোহীত উল আলম »

বঙ্গবন্ধুকে প্রায় সবংশে হত্যা করার পর ফাঁসিতে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান একটি বিদেশি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার জন্য দায়ি এবং বাংলাদেশ সরকার সাহস থাকলে তার বিচার করতে পারে। ইতিহাসের অমোঘ নৈয়ায়িক বিচারে সে দম্ভোক্তিকারী ফারুকের শুধু ফাঁসিতে মৃত্যু নিশ্চিত হয়নি, সাধারণ আইনি বিচার অনুসরণ করে শেখ হাসিনার সরকার তার কতিপয় ষড়যন্ত্রী সহযোগীকে মৃত্যুর পরপারে পাঠিয়ে আইনের নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা প্রমাণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর দেহাবসানের পর একটি আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া হলো যেটির জন্য মোশতাক-ফারুক গং তৈরি ছিল না। প্রমাণিত হলো যে জীবন্ত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব হাজার গুণে বলীয়ান। এই কথাটিকে উপসংহার ধরে আমি যে আলোচনাটি করতে চাই সেটি হলো, মুজিব যে তাঁর দেহস্থিত প্রাণের চেয়েও দেহ-অন্তর্হিত প্রাণে অধিকতর শক্তিশালী, সেটি নিশ্চয় হত্যাকারীদের কুশীলবদের অজানা ছিল না, কিন্তু তারপরও কেন তারা মুজিবের দেহকে আক্রমণের বস্তু করল? প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে এসেও অনেক মানুষের মধ্যে এমন একটি বর্বর ধারণা কাজ করে যে একটি লোকের দেহের পতন ঘটালে যেন তার চিন্তারও পতন ঘটে। সে বর্বর চিন্তার অনুসরণে তারা মুজিবকে সবংশে নিধন করতে চেয়েছিল। অথচ এক অর্থে সে দেহস্থিত মুজিবের অস্তিÍত্ব ছিল অন্য দশজনের অস্তিত্বের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। একান্ত শারীরিক অস্তিত্বের প্রেক্ষাপটে মুজিব ছিলেন গণতান্ত্রিকভাবে আর সবার মতোই নশ্বর দেহধারী।  অর্থাৎ দেহস্থিত মুজিব আর দশজন সামাজিক এবং সংসারধর্মী লোকের মতোই জীবনযাপন করতেন। মানবদেহধারী মুজিবের শরীরের সঙ্গে অন্য দশজন নেতার শরীরের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। অর্থাৎ, শারীরিক অর্থে, প্রকৃতিগত শরীরের অর্থে মুজিবের শরীরের মধ্যে কোন বিশিষ্টতা ছিল না। তাই, তাঁর শরীরকে লক্ষ্যবস্তু করার অর্থ হলো, ষড়যন্ত্রকারীরা মোটেও তাঁর বিশিষ্টতার জন্য তাঁকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেনি, করেছিল তার অ-বিশিষ্টতার জন্য। অর্থাৎ, যে সব উপাদানের জন্য মুজিব কোনভাবেই সাধারণ আর দশজন মানুষের চেয়ে আলাদা ছিলেন না বা বিশিষ্ট ছিলেন না, সে কারণগুলির জন্যই ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে হত্যা করেছিল।

কিন্তু মুজিব যে কারণগুলির জন্য বিশিষ্ট ছিলেন, যে কারণগুলির জন্য তিনি ষড়যন্ত্রীদের লক্ষবস্তুতে পরিণত হতে পারতেন, সেগুলি সবই ছিল তাঁর দেহ-অন্তর্হিত গুণাবলী, যেগুলির ওপর শুধু ষড়যন্ত্রীদের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না তা নয়, পৃথিবীর কোন শক্তিরই নিয়ন্ত্রণ ছিল না: আর সে গুণগুলি ছিল তাঁর নেতৃত্বশক্তি, সাংগঠনিক শক্তি আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, এবং সর্বোপরি তাঁর মানুষের জন্য ভালোবাসা। এগুলির সবই ছিল অদৃশ্য তড়িৎ শক্তির মতো প্রবহমান এবং সর্বত্রগামী, এবং এগুলি সবগুলোই ছিল মুজিবের দেহস্থিত অস্তিত্বকে ছাড়িয়ে যাওয়া গুণাবলী, এবং এগুলি হত্যাযোগ্য বা নিধনযোগ্য নয়। কাজেই ষড়যন্ত্রীরা মুজিবকে যখন মেরে ফেলল, তখন তারা একটি দেহকে শেষ করল কেবল, বা একজন পিতাকে, ভাইকে বা একজন নেতাকে খুন করল কেবল। কিন্তু যে চেতনার জন্য মুজিব বাংলাদেশের জাতির পিতা হয়ে গেলেন, যে মুজিবের আদর্শের পথ ধরে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে দোর্দ-প্রতাপে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন মধ্য-আয়ের দেশের দিকে সে মুজিবের দেহ-অন্তর্হিত গুণাবলীর তারা কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারল না। কাগুজে টাকার ওপর থেকে এক সময় মুজিবের ছবি অন্তর্হিত করেছিলো মুজিববিরোধী সরকারগুলো, কিন্তু টাকার ওপর থেকে তাঁর ছবি সরানো সম্ভব হলেও মানুষের মন থেকে তাঁর ভাবমূর্তি মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। যুগে যুগে এভারেস্টসম উচ্চতায় অধিষ্ঠিত নেতাদের হত্যা করে ষড়যন্ত্রীরা বারবারই একই ভুলকে প্রমাণিত করেন যে একজন নেতাকে দেহধারী থেকে দেহলীন করার মধ্যে কোন ফায়দা অর্জিত হয় না, বরঞ্চ সর্বক্ষেত্রে ইতিহাস ঘেঁটে এ কথাটা প্রমাণ করা হয় যে ফল হয় উল্টোটা। নেতার দেহ থেকেও নেতার দেহ-অন্তর্হিত অস্তিত্বের শক্তি বহুগুণে বলীয়ান এবং ক্রমবর্ধমান।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শারীরিক পতনের পর তাঁর অশারীরিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার রূপায়ণ তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার সময়কালীন যে হবে তা’তে কোন সন্দেহ নেই। ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার এ পর্যন্ত শাসনামলে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে এ কথা বিশ্বজনীন স্বীকৃত। কিন্তু হঠাৎ করে ২০২০ সাল থেকে অতিমারির আক্রমণ শুরু হলে, এবং ২০২২-ইউক্রেইনকে রাশিয়া আক্রমণ করে বসলে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয় তা’তে শেখ হাসিনার সরকার কঠিন পরীক্ষার সামনে পড়েছে। মাত্র কয়েকদিন আগে (৫/৮/২২) থেকে সব ধরনের জ্বালানির দাম ৫০% বা তার বেশি বেড়েছে। সবরকমের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সমাজে অর্থনৈতিক অস্থিরতা সবচেয়ে বড় সমস্যা। সরকারকে এই সময়ে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কুশলতার পরিচয় দিতে হবে। এখানে একটি পরিস্থিতি ঠিক মুজিব হত্যার পূর্ববর্তী সময়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে প্রায়। যে কোন ভাবেই হোক, তৎকালীন সরকারের ব্যর্থতার কারণে হোক, বা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের চক্রান্তের কারণে হোক ’৭৪ সালের বন্যা এবং বন্যা-পরবর্তী দুর্ভিক্ষের আগমন বঙ্গবন্ধুর সরকারকে যথেষ্ট বিপত্তির মধ্যে ফেলেছিল। এমন কি বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে দেশব্যাপী মানুষের এটার বিরুদ্ধে গণজাগরণের বদলে এক ধরনের বিভ্রান্তিই লক্ষ করা গেছিল। এবং দেখা গেছে মোশতাক সহ ষড়যন্ত্রের সবাই কোন না কোন ভাবে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের একান্ত নিকট ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। হত্যাকা-ের আগের দিন, যা জানা গেছে, খোন্দকার মোশতাক নিজের বাড়ি থেকে রান্না করা ভাত-তরকারি সালুন রেঁধে এনে বঙ্গবন্ধুকে খাইয়েছিলেন।

ঠিক সেরকম, আমার ব্যক্তিগত আশংকা হলো, বর্তমানে যখন বিশ্বপরিস্থিতি গোলমেলে, এবং দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের মধ্যেও নানারকম অসংগতি দেখা যাচ্ছে, সে সময় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যাঁরা আছেন তাঁদেরকে অতীব সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা হয়ে থাকলে, এই সময়ে সেটি সবচেয়ে সক্রিয় থাকবে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে সবচয়ে বেশি খর থাকতে হবে তোষামোদকারী আর বাগাড়ম্বরকারীদের সম্পর্কে, এমনকি সে লোক যদি মন্ত্রী পর্যায়েরও হয়, তাহলেও। এরা হয়তো এখন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে উন্মোচিত হচ্ছে না, কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমশ নি¤œগামী হলে এরা কন্ঠ বদলাতে এবং অবস্থান বদলাতে এক মিনিটও সময় নেবে না। ইতিহাসে এর প্রমাণ ভুরি ভুরি। বিশ্বাসঘাতকতার গভীরতা বস্তুত প্রশান্ত মহাসাগরস্থ মারিয়ান ট্রেঞ্চের গভীরতাকেও হার মানায়।

সরকারকে এই সময়ে সবচেয়ে জরুরিভাবে অনুধাবন করতে হবে যে সাধারণ মানুষ বোকা নয়। তারা হয়তো শিক্ষিত নয়, তাদের হয়তো মুখ থাকে না, প্রতিবাদ থাকে না, কিন্তু তাদের বুঝ কম সেটা ভাবা হবে আরেক বোকামি। উচ্চ পর্যায়ের অনেক ব্যক্তিবর্গের কথাবার্তা শুনে মনে হয়, তাঁরা যা বলছেন, দেশটা যেন ঠিক তাই-ই। তাঁরা যেন হেদায়েৎকারীর ভূমিকায় নেমেছেন। অথচ সাধারণ মানুষের কাছে, সাধারণ চোখে মুহুর্মহ এটাই ধরা পড়ছে যে বাস্তবতা ঠিক অন্যরকম। এই ধরনের অসত্য বয়ানকারী ও প্রলাপকারীদের একটি উদ্দেশ্য থাকে, তারা নিজেদের স্বার্থে সরকারের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চারপাশে একটি নকল আস্থার দেয়াল তৈরি করে। এরা করে কি, সরকারের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চোখ ও কানের দায়িত্ব তারা নিয়ে নেয়। তারা যা দেখে বা দেখাতে চায় সরকার তাই দেখে, যা শোনে বা শোনাতে চায় সরকার তাই শোনে। এরা সরকারকে বারংবার বলবে সব ঠিক আছে, সব ঠিকভাবে চলছে, দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। অর্থাৎ বলতে চাই এই ধরনের অস্থির সময় খোন্দকার মোশতাক বা তার সমগোত্রীয়দের জন্ম নেবার উপযুক্ত সময়। উইপোকার বংশবৃদ্ধির জন্য একটি পরিবেশ লাগে, ঠিক সেরকম বিশ্বাসঘাতকের জন্ম নিতেও অনুকূল পরিস্থিতি লাগে। সে ধরনের অনিশ্চিত অস্থিরতা এখন তৈরি হয়েছে, তাই সংশয়। এবং যেটি এই তোষামোদকারীদের নির্মমভাবে করতে পারদর্শী সেটা হলো পরিস্থিতি বিপজ্জনক মোড় নিলে তারা নিজেদের ভূমিকার পক্ষে সাফাই গেয়ে সব দোষ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর বর্তে দেয়। নিজেরা আড়ালে চলে যায়। তখন হয় কি, যে শরীরের আপাতকালীন গণতান্ত্রিক অস্তিত্বের কথা বলেছিলাম সেই শরীরটিই তখন অপশক্তির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এবং ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় বিড়ম্বনার সময় সরকারের মধ্যে যখন বাছাই করার সমস্যা হয় দু’টো জিনিসের বা দু’জন ব্যক্তির মধ্যে তখন সরকার প্রায়শই ভুল সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক তাঁর সবচেয়ে আস্থাভাজন ব্যক্তি তাজউদ্দিন আহমেদকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাদ দেয়ার প্রসঙ্গটি আসবে।

সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর তিরোধানের সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের মধ্যে সামাজিক অস্থিরতার দিক থেকে সমতা বিব্রতজনকভাবে এখন সবচেয়ে বেশি। সেজন্যই আমাদের উদ্বেগ যে সরকারের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রকৃতিগত শরীরটি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠে কিনা। সাবধানতা সকলের জন্যই প্রয়োজনীয়।

অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক