বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, জাদুবাস্তবতার উজ্জ্বল চিত্র

কামরুল হাসান বাদল »

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তার অবিস্মরণীয় উপন্যাস ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’ বা ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ প্রকাশ করেন ১৯৬৭ সালে। বিশ্বের বহুভাষায় অনূদিত ও সমাদৃত এই উপন্যাসটির জন্য তিনি ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। লাতিন আমেরিকান এই লেখকের জন্ম ১৯২৮ সালে কলম্বিয়ার আরাকাতকায়। জাদুবাস্তবতা লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের এক বড় উপাদান। একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে এই কাহিনী গড়ে ওঠে। ‘বুয়েন্দিয়া’ পরিবারের একজনের নেতৃত্বে একদল দুঃসাহসী অভিযাত্রী দক্ষিণ আমেরিকার গহীন জঙ্গলে বসতি স্থাপন করে। গড়ে তোলে মাকোন্দো নামে একটি বসতি। আশ্চর্য জাদুবাস্তবতার গল্প তা। যেন এক মহাকাব্যিক জগৎ। একই সঙ্গে নিয়তির আশীর্বাদপুষ্ট, অভিশাপলাঞ্ছিত আর খামখেয়ালির শিকার একটি অসাধারণ পরিবারের।
বইটি প্রকাশের পরপরই আলোচিত হয়ে ওঠে। মার্কেজের অসাধারণ কল্পনাশক্তি বিমোহিত করে বিদগ্ধ পাঠকদের। ‘দ্য টাইমস’ এর সাহিত্য পাতায় বলা হয়, “দক্ষিণ আমেরিকার এক সুদূর বসতি মাকোন্দোর পত্তনকারী বুয়েন্দিয়া পরিবারের গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ রচিত সম্মোহক ইতিহাস ফ্যান্টাসি আর বাস্তবতার এক প্রাণবন্ত উপখ্যান। প্রহসন আর উচ্চহাস্য তার জগতের বিশেষ মেজাজটি গড়ে দিয়েছে। মার্কেজকে একজন কবিই বলা যায়। একজন দ্রষ্টা, এক আলকেমিস্ট। এক দুর্দান্ত শক্তিশালী কাজ, মোহনীয় সংবর্তসংকুল এবং রূঢ়।” গার্ডিয়ান পত্রিকায় সে সময় সাহিত্য সমালোচক ফ্রেড ডা অগিয়ার লিখেছিলেন, “দক্ষিণ আমেরিকার এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলের অস্তিত্ব না থাকলেও এই উপন্যাস থেকেই তা সৃষ্টি করা সম্ভব হতো।”
মাকোন্দো কোনো সত্যিকার জনবসতি ছিল না। মার্কেজ তার অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার গুণে এমন ঘটনাগুলো সাজিয়েছেন যা পাঠকদের বাস্তবতা থেকে জাদুর মতো মোহবিষ্ট এক জগতে প্রবেশ করিয়ে দেয়।
মার্কেজের উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৬৭ সালে। মার্কেজের যে জনবসতি মাকোন্দো তা বাস্তব নয়, কল্পনা। তিনি যখন কল্পনায় একটি বসতি গড়ে তুলছিলেন গত শতকের ছয় দশকের মাঝামাঝি ঠিক সে সময়ে আমেরিকার ঠিক উল্টো পৃষ্ঠে ভারত উপমহাদেশের ছোট্ট একটি পরাধীন দেশে আরেক কারিগর, রাজনীতির মহাকবি, অসম্ভব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং স্বপ্নদ্রষ্টা অকুতোভয় সংগ্রামী, যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি একটি সত্যিকার স্বাধীন দেশের, স্বাধীন ভূখণ্ডের ভ্রুণ রচনা করে ফেলেছেন।
যে বছর ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ বেরোলো সেই বছর মুজিবের সেই নতুন দেশটি প্রায় চারাগাছ ছিল। মার্কেজের কাহিনী ছিল জাদুবাস্তবতা। আর শেখ মুজিবেরটি রূঢ় বাস্তবতা। এবং কখনো তা জাদুবাস্তবতার মতো ঠেকেছিল অনেকের কাছে তার এক বছর আগে ১৯৬৬ সালে তিনি যখন ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবের সেই ছয় দফার মধ্যেই লুকায়িত ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন–ভ্রুণ। মার্কেজ উপন্যাস পড়ে বিশ্বপাঠক তার অসাধারণ কল্পনাশক্তি দেখে বিমোহিত হয়েছিল। আর তার উল্টো এই ভূখণ্ডের কিছু মানুষ শেখ মুজিবের ছয় দফাকে বোকামি বলে উপহাস করেছিল আর একদল মানুষ বিমোহিত হয়েছিল এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এবং তখন পর্যন্ত তার জাদুবাস্তবতায়। বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন তখন তা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। এমনকি লাহোরে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে ঢাকায় এসে তিনি নিজদলের অনেকের সমালোচনার মুখে পড়েন, বাধার মুখে পড়েন। ফলে ছয়দফার পক্ষে তাকে প্রথম প্রকাশ্য জনসভাটি করতে হয়েছিল চট্টগ্রামে এসে। এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখের সহযোগিতায় লালদীঘি মাঠে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্য জনসভায় ছয়দফা ঘোষণা করা হয়।

এ যেন এক মহাকাব্যের পদধ্বনি। নতুন একটি জাতিসত্তার উন্মেষের মহালগ্ন। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে ছয় দফা উত্থাপন করেন। ১৩ই মে পল্টনে আয়োজিত আওয়ামী লীগের জনসভায় ৭ই জুন ছয় দফার সমর্থনে হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৭ই জুন তেজগাঁওয়ে বেঙ্গল বেভারেজের শ্রমিক সিলেটের মনু মিয়া পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। এতে বিক্ষোভের প্রচণ্ডতা আরও বাড়ে। এরপর থেকে ৭ই জুন ছয়দফা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
ছয়দফা ঘোষণার পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই রাষ্ট্রটি স্বাধীন হয়ে যায়। ছয় দফার কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে ২৫শে মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে দ্রুত। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়। পরবর্তী যা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। এরপর বঙ্গবর্ন্ধু মুক্তির জন্য লড়াই সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মুখে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভ করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন। এবং পক্ষান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ৭ই মার্চ যেদিন বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, সেদিন হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেনি তার পরের বছরের ৭ মার্চের মধ্যে এ দেশ হবে স্বাধীন–সার্বভৌম।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা টেবিলে বসে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া কোনো বিষয় নয়। স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করে নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করে ত্রিশ লাখ প্রাণ ও প্রায় চার লাখ মা–বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধু জাদুবাস্তবতাকে শুধু এক নিরেট বাস্তবতায় নিয়ে এসেছিলেন। যে বাস্তবতার জন্য প্রাণ দিয়েছে লোক অকাতরে। নারীদের সম্ভ্রম দিতে হয়েছে। যে জাতি কখনো স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেনি ভালো করে সে জাতি তখনো স্বাধীনতা কাকে বলে জানতো না। সে জাতির জন্য তিনি এক বাস্তব জন্মভূমি এনে দিয়েছিলেন। এ রাষ্ট্রটি কখনো স্বাধীন হতে পারে, বাঙালি একটি বীরের জাতি এ কথা যারা বিশ্বাস করতো না তিনি তাদের জন্য জাদুবাস্তবতার এক রূপকার হয়ে উঠেছিলেন।
মাকোন্দোর কোনো অস্তিত্ব নেই। একশ বছর পরে এই উপন্যাসের জনপ্রিয়তা কোথায় যাবে জানি না। মার্কেজকে হয়তো কেউ কেউ মনে রাখবে কারণ এক দারুণ জাদুবাস্তববাদও জন্ম দিয়েছিলেন তিনি তার উপন্যাসে। কিন্তু একশ বছর পরে কিংবা তারও অনেক অনেক শত শত বছর পর বঙ্গবন্ধুর বাস্তব দেশ বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে।
মার্কেজের মাকোন্দোবাসীরা একসময় রাতজাগা রোগে আক্রান্ত হয়। ফলে তাদের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলতে থাকে। পরিস্থিতি এমন হয় যে তাদের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের গায়ে লিখে রাখতে হতো কোনটা কোন কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন কোদালের গায়ে লিখে রাখতে হতো ‘এটা দিয়ে মাটি কাটা হয়’। আজ দেখে শুনে মনে হয় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশেও সে রোগ দেখা দিয়েছে। স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলার রোগ। মাকোন্দোবাসীর তা হয়েছিল রাতজাগা রোগের কারণে। আর বাংলাদেশে এই রোগ হচ্ছে কিছু রাজনৈতিক দল বুদ্ধিজীবী ও তথাকথিত সুশীল শ্রেণির কারণে। তারা খুব দক্ষতার সাথে এদেশের জন্মকথা, জন্মঋণ, জন্মব্যথা এবং তারপরের নির্মম ইতিহাসগুলো ভুলিয়ে দিতে চাইছে। এরা ভদ্রতা, সভ্যতা আর মানবাধিকারের মুখোশ পরে নতুন প্রজন্মের কাছে শুধুই বর্তমানকেই কঠিনভাবে তুলে ধরছে। এর পেছনে যে অমানবিক ইতিহাস আছে, নির্মমতা আছে, হত্যা আর বীভৎসতা আছে তা গোপন করতে চাইছে। এরা কৌশলে গণতন্ত্রের কথা বলে দেশের অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে লালন করতে চাইছে। এরা ভুলিয়ে দিতে চাইছে ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার নিষ্ঠুর, নির্মম ইতিহাসকে, ৩ নভেম্বরের জেলহত্যার মতো ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডকে, ভুলিয়ে দিতে চাইছে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্টে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনাকে। ভুলিয়ে দিতে চাইছে প্রকাশ্য জনসভায় আহসানউল্লাহ মাস্টার, শাহ এএম এস কিবরিয়াকে হত্যার মতো ঘটনাকে। যে দলের নেতৃত্বে এদেশে স্বাধীনতা এসেছে যে দল সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করেছিল সে দলকে ফ্যাসিস্ট হিসেবে আখ্যায়িত করতে চাইছে, প্রচার প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। আর তা শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তার বিস্তার ঘটিয়েছে।
মাকোন্দোবাসীদের সে রোগ সারিয়ে তুলতে ত্রাতার ভূমিকায় এসেছিলেন এক আশ্চর্য চরিত্র মেলকিয়াদেস। যিনি মাকোন্দোবাসীদের ভুলে যাওয়া রোগ সারিয়ে তুলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশেও আজ একজন অথবা লাখ লাখ মেলকিয়াদেসের প্রয়োজন। যারা আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের ভুলে যাওয়া রোগ থেকে উদ্ধার করবে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে রক্ষা করবে।
১০ই জানুয়ারি জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে তাই বারবার মনে হচ্ছে কী অসাধারণ সময় ছিল আমাদের। পরাধীন দেশ থেকে গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় দশ মাস অমানবিক জেলজীবন শেষ করে স্বদেশে ফিরছেন স্বপ্নবাজ আর জাদুকে বাস্তব করে তোলা এক মোহন কারিগর। সে দিনকে, সে অবিস্মরণীয় ক্ষণকে ভুলতে পারে না বাঙালি।