বকরি ঈদ, বঙ্গভ্যাক্স ও বদ্বীপবাসী

এস এম মারুফ »

কয়েকদিন আগে, গরু নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে এই অভিযোগে তিন ব্যবসায়ী গণপিটুনিতে মারা  গেছে। এই ঘটনা ঘটেছে ভারতের ত্রিপুরায়। একজন  কোনমতে পালিয়ে  যেতে সক্ষম হলেও পরে অন্যত্র ধৃত হয এবং সেখানে সেও গণপিটুনিতে মারা গেছে। প্রতিবার বকরি ঈদ এলে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গরু পাচারের অভিযোগে অনেকগুলো অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বছর ঘুরে আবার ঈদ এসেছে, আগামী মাসের মাঝামাঝিতে ঈদ। ১ কোটি ১৩ লক্ষ পশু উৎসর্গ হবে এই সময়, এই বাংলাদেশে। করোনাকালে মানুষের আর্থিক সামর্থ্য কমে গেছে। এই সংখ্যা তাই কমে যাবার সম্ভাবনা বেশি। কতটা কমবে আগাম বলা না গেলেও নিশ্চিতভাবেই কমবে। আগে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো  থেকে ২০/২৫ লাখের মতো গরু আসতো, এখন আসে ১/১.৫ লাখ। এক দেড় লাখ  তো দূরের কথা এক দেড় ডজন গরু আসাও বাংলাদেশের জন্য  বোঝা। কারণ বাংলাদেশ এই মুহূর্তে পশুসম্পদে উদ্বৃত্ত । গত বছর কোরবানির জন্য প্রস্তুতকৃত ৫ লাখের উপর গবাদিপশু উদ্বৃত্ত থেকে গেছে।

বাংলাদেশ কিভাবে রাতারাতি পশুসম্পদ উদ্বৃত্ত দেশ হলো তারও একটা  ছোট গল্প আছে। ২০১৪ সালের পর থেকে ভারতের সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে সেখান থেকে গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়। ভারতীয় অংশে গরু-ছাগলের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে ভীষণ কড়াকড়ি আরোপ হয়। এই নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশ প্রথমদিকে অপ্রস্তুত হলেও এখন গবাদিপশুর ভারত থেকে বাংলাদেশে আগমন ভারতের জন্য যেমন সুখবর নয়, বাংলাদেশের জন্য মোটেও নয়।

গত জলাইয়ে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কৃষিশুমারি ২০২০- এর প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, দেশে গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৮৪ লাখ ৮৭ হাজার ৪১৫টি। মহিষের সংখ্যা ৭ লাখ ১৮ হাজার ৪১১টি। ছাগলের সংখ্যা ১ কোটি ৯২ লাখ ৮৭ হাজার ৪১৩টি।  ভেড়ার সংখ্যা ৮ লাখ ৯২ হাজার ৬২৮টি। পশু সম্পদের দিক  থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম।

ছাগলের দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ অবস্থান দ্বিতীয়। ছাগলের  গোশত এবং সংখ্যার বিচারে চতুর্থ।  বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মাংস পৃথিবীর সেরা। এ অঞ্চলের যমুনাপাড়ি ছাগলের মাংসও বিশ্বমানের।

চট্টগ্রামের লাল গরু, মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিম গরু, উত্তরবঙ্গের ধূসর গরু বেশ ভাল জাতের। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের গরুর মাংসের স্বাদের সুনাম আছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের পশুসম্পদ বিপুল সম্ভাবনা আছে। সরকারি হিসেবে ৬ লাখ,  বেসরকারি হিসেবে  ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখের উপরে পশু খামারি আছে বাংলাদেশে। এদের নিয়েও সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার। বিশ্বজুড়ে হালাল মাংসের ব্যাপক চাহিদা এই খামারিদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে, সেই সঙ্গে বাংলাদেশেরও। কেবলমাত্র গার্মেন্টস শিল্পের উপর নির্ভর করে জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সরকার ইন্সেন্টিভ দিয়ে গার্মেন্টস সেক্টর ধরে রাখতে চেষ্টা করছে, আপাতত  সেখান থেকে কোনো সুসংবাদ নেই।

খামারিদের টিকিয়ে রাখতে নিজের স্বার্থেই সীমান্তে গরু চোরাচালান বন্ধে  বাংলাদেশকে ভারতের মতই শক্ত ভূমিকা নিতে হবে।

ভারত-বাংলাদেশ গবাদিপশু পাঠানোর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় বাংলাদেশের জন্য এই খাতের স্বর্ণ দুয়ার খুলে গেছে।

উভয়  দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্তরিক হলে এই চোরাচালান এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষের মৃত্যু কারো কাছেই কাম্য হতে পারে না। আমরা মৃত্যু চাই না, গরুও চাইনা।

গবাদিপশুর ঘটনা ২০২১ সালে এসে ঘটেছে করোনা টিকার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ টাকা দিয়েও বন্ধুর কাছ থেকে টীকা পেল না। অদূর ভবিষ্যতে পাবে বলেও মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে গতকাল দেশে ফিরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন জানালেন সবাই শুধু টিকা দেবে দেবে বলছে কেউ দেয় না। সবাই মুলা দেখিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝে ফেলেছে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কোন শত্রু বন্ধু নেই। জীবন বাঁচাতে আত্মশক্তির উদ্বোধন ঘটাতে হবে। টিকা রাজনীতির শিকার হয়ে এদেশের মানুষ বেঘোরে প্রাণ দিবে কোন দেশপ্রেমিক সরকার এটি কখনো হতে দিতে পারেনা। টিকার  ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে আজ হোক অথবা কাল, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নিজের দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে, জিডিপির স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে  দেশের অভ্যন্তরে টিকা কর্মসূচির আগ্রাসী প্রয়োগ বাস্তবায়ন করতে হবে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এর তথ্য অনুযায়ী কোন দেশ যদি তার দেশের নাগরিকদের অন্তত ৭০ পার্সেন্ট মানুষকে টিকা দিয়ে দিতে পারে, তবে দেশটিকে করোণা  মোকাবেলায় সক্ষম  রাষ্ট্র হিসেবে ধরা হবে। তাই টিকা আমদানির পাশাপাশি অন্যের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য  বাংলাদেশের উচিত হবে নিজেদেরই টিকা উৎপাদনের দিকে মনোযোগী হওয়া।

যারা ভাবেন বাংলাদেশ টিকা উৎপাদন করতে পারবে না, বাংলাদেশের বিজ্ঞান ভাবনা এতদূর এগোয়নি যে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে টিকা আবিষ্কার করতে পারবে অথবা উৎপাদন করতে পারবে, তারা মহাভুলের  ভেতর বাস করছেন। পৃথিবীতে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। বাংলাদেশের প্রতিভা আছে, বাংলাদেশের টাকা আছে।  প্রয়োজনে বাংলাদেশ বিদেশ থেকে বিজ্ঞানী আনবে। প্রয়োজনে বিদেশি ল্যাবসহ বিজ্ঞানীদের বাংলাদেশে প্রতিস্থাপিত করা হবে। এটা  মোটেই অসম্ভব কিছু নয়। জিডিপির অব্যহত প্রবৃদ্ধি চাইলে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে হবে প্রথম। স্বাভাবিক কর্মকান্ড অব্যহত রাখতে চাইলে টিকা বিপ্লবের বিকল্প নেই।

এই যে দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউন এলো, এ খবর তো আত্মঘাতী। টিকা নেই, সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। কেবল লকডাউন দিয়ে করোনা মোকাবেলা বড় কঠিন হবে। আজ বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডাঃ রোবেদ আমিন বলেছেন জনগণ সহযোগিতা না করলে করোনা পরিস্থিতি শোচনীয়ও হতে পারে। আমি ঠিক বুঝি নাই তিনি জনগণের কি সহযোগিতা চান? ঢাকা শহর বাংলাদেশের জিডিপিতে ৩৭% অবদান রাখে। আপনি ঢাকা শহর  লোকজনের আসা যাওয়া বন্ধ করে দিলেন, রুটিরুজি থামিয়ে দিলেন। মানুষ  তো প্রতিবাদ করছে না। কষ্ট করে হলেও মহামারিতে ধৈর্য ধারণ করে চলেছে। সরকারের দায়িত্ব ছিল টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করার। মানুষ তো আর টিকার ব্যবস্থা নিজে থেকে করতে পারেনা। এ দায়িত্ব সরকারের। সামনের করোনা পরিস্থিতির অবনতির দায়ও সাধারণ জনগণ কেন নেবে? আরো আগে যদি বঙ্গভেক্সের টিকার বিষয়ে সরকারি সহায়তা  নিয়ে  সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যেত, ভালো হতো। শর্তসাপেক্ষে বঙ্গভ্যাক্সের  টিকার মানবদেহে প্রয়োগ অনুমোদন দেয়া হয়েছে তাও প্রায় সপ্তাহ দুই হতে চলল। শর্ত পূরণ হলো কিনা, মানবদেহে প্রয়োগ হবে কি না? হলে কবে হবে? আমরা কেউ কিছু জানি না। বাংলাদেশ স্পুটনিক ভি এবং সিনোফার্মার টিকার জন্য প্রযুক্তি কৌশলসহ আমদানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশকে উৎপাদন করতে দিতে রাজি আছে কিনা তাও এখনো স্পষ্ট নয়। বরং পশ্চিমা মিডিয়ায় শুনতে পাই, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে টিকা তৈরীর কৌশল চলে যাওয়া নিরাপদ হবে না। মানবাধিকারবাদী দেশগুলো প্রয়োজনের কয়েকগুণ টিকা মজুদ করে রাখবে, আর বিশ্ব সম্প্রদায়ের অপর অংশ টিকা না পেয়ে বেঘোরে প্রাণ দেবে – মোটাদাগে এটাই বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা। টিকা পরিস্থিতি বুঝতে কারো পিএইচডি ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্র যার কিনা জনসংখ্যাই প্রকৃত সম্পদ, তার জন্য টিকায় আত্মনির্ভর না হয়ে আর  কোনো পথ খোলা নেই।

কাজটা চ্যালেঞ্জিং, তবে অসম্ভব নয়।

লেখক : প্রকৌশলী।