পিঁপলুর হলো ইচ্ছেপুরণ

মোনোয়ার হোসেন :

বড় একটা বটগাছ। গাছটার অনেক বয়স। পিঁপলুরা বাস করে এই গাছের নিচে। পিপলুর দাদু বলেছেন, এই বটগাছ হলো কালের সাক্ষী।

পিঁপলু চোখ বড় করে। দাদুর কাছে জানতে চায়, কালের সাক্ষী মানে কী, দাদু?

দাদু বলেন, যুগে যুগে ঘটে যাওয়া সব কিছুর সাক্ষী যে।

পিঁপলু বলে, যুগে যুগে কী ঘটেছিল?

দাদু বলেন, এই দেশে উনিশ শো বায়ান্না সালে হয়েছিল ভাষা আন্দোলন, উনিশ শো একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ।

পিঁপলুর চোখ কপালে ওঠে। যুদ্ধ? সে তো মারামারি, দাদু!

হুমম, মারামারিই তো।

মারামারি করা তো ভালো নয়। মানুষ কেন মারামারি করেছিল?

সে অনেক কথা।

বলো দাদু, আমি সব শুনবো।

শোনো তাহলে। দাদু বলতে শুরু করলেন। আমাদের এই দেশের নাম আগে ছিল পূর্ব পাকিস্তান। মানে আমরা ছিলাম পাকিস্তানের একটা অংশ। পাকিস্তানের লোকজন ছিল শোষক। তারা নানাভাবে এদেশের  লোকজনকে শোষণ করতো। নায্য অধিকার কেড়ে নিতো। দেশের মানুষের ওপর নানাভাবে নিপীড়ন চালাতো। তারপর এদেশে একটা সাহসী ছেলের জন্ম হলো। নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এই অত্যাচার-নিপীড়ন মেনে নিতে পারলেন না। বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করলেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। তাঁর ভাষণে দেশের মানুষ সাহস খুঁজে পেলো। আশার আলো দেখতে  পেলো। সবাই এক হলো। নিজেদের নায্য অধিকার আদায়ের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের সত্য ও সাহসী লড়াকুর কাছে পাকিস্তানিরা পরাজিত হলো। এদেশের মানুষ পেলো স্বাধীন একটি দেশ। বাংলাদেশ।

হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠলো পিঁপলু। সাবাশ দাদু, সাবাশ! তারপর পিঁপলু বললো, দাদু, দেশে এতো বড় একটা মহান মুক্তিযুদ্ধ হলো।  তোমরা কি যুদ্ধে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াওনি? তাদের সহযোগিতা করোনি?

দাদু বললেন, হ্যাঁঁ , সেতো নিশ্চয় করেছি।

পিপলুর আগ্রহ আরো বাড়ে। দাদুর কোলঘেঁষে বসে। বলো দাদু,  তোামার যুদ্ধের কথা বলো।

দাদু একটু নড়েচড়ে বসেন। চোখ বন্ধ করেন। হয়তো সেইদিনটা তিনি  চোখের সামনে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন। যাতে পুরো ঘটনাটাই পিঁপলুকে ভালো ভাবে বলা যায়। একটু পর চোখ খুললেন। উজ্জ্বল মুখে বলতে লাগলেন, শোনো তাহলে। সেটি ছিলো বর্ষাকাল। সবে সন্ধ্যা নেমেছে। চারদিকে ছোপ-ছোপ অন্ধকার। বাঁশঝাড়ে জোনাকপোকা জ্বলছে, রাস্তার ধারে ঝিঁঝিপোকা ডাকছে। কেমন একটা গা ছমছম করা পরিবেশ। এসময় আকাশে মেঘ জমলো। কালোমেঘ। গুডুম গুডুম মেঘ ডাকতে লাগল আর টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো। এসময় পাকিস্তানি মিলিটারিরা এই বটগাছের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তারা তো ছিল বোকার হদ্দ।  বৃষ্টিকে খুব ভয় পেতো। বাঘ সামনে এলে মানুষ যেমন ভয় পায়, ঠিক  সে রকম। বৃষ্টি দেখে তারা হকচকিয়ে গেলো। আশপাশে কোনো বাড়িঘর নেই, তারা আশ্রয় নেবে। তাই দৌড়ে এলো এই বটগাছের নিচে। এখানেই আশ্র নিলো। আমার বড়ভাই, মানে তোমার বড় দাদু, তাদেরকে দেখেই চিনে ফেললো। এরা তো পাকিস্তানি মিলিটারি! হায়েনা।

আমরা সবাই বুদ্ধি করতে লাগলাম, কিভাবে এই হায়েনাদের শায়েস্তা করা যায়। হঠাৎ তোমার বড় দাদুর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সে সবার কানে কানে বলে দিলো আমাদের কী করতে হবে।

আমরা তো মহাখুশি। সবাই মিলিটারিদের পায়ের কাছে চুপটি মেরে বসে থাকলাম। এক সময় মুক্তিযোদ্ধারা টের পেলো বটগাছের নিচে মিলিটারিরা আশ্রয় নিয়েছে। তারা বটগাছটি ঘিরে ফেললো এবং মিলিটারিদের লক্ষ করে গুলি ছুড়তে লাগল। মিলিটারিরাও পাল্টা গুলি করতে লাগল। আর আমরা কাজটা ঠিক তখনই শুরু করলাম। যেই না মিলিটারিরা গুলি ছুড়বে, অমনি তাদের পায়ে বসালাম মরণকামড়। এদিকে পিঁপড়ের কামড়, ওদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি, বোকার হদ্দ মিলিটারিরা একেবারে দিশেহারা আর এলোমেলো হয়ে গেল। নিশানায় গুলি ছুড়তে পারছে না। এলোমেলো গুলি চালাচ্ছে। এই সুযোগটাই কাজে লাগালেন মুক্তিযোদ্ধারা। সবকটা মিলিটারিকে মেরে ফেললেন তারা।

হাততালি দিয়ে উঠলো পিঁপলু। সাবাশ দাদু, সাবাশ। তোমরাও মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা পিঁপড়া। হঠাৎ পিঁপলুর মনটা খারাপ হয়ে  গেল। ইশ, আমিও যদি সে সময় নিতাম!  তাহলে আমিও মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করতে পারতাম।

পিঁপলুর মন খারাপ, বুঝতে পারলেন দাদু। বললেন, তোমার কী হলো দাদু, মনখারাপ কেন?

পিঁপলু বললো, দাদু, আমারও যদি তোমাদের সময়ে জন্ম হতো, আমিও যুদ্ধে সাহায্য করতে পারতাম।

পিঁপলুর কথা শুনে দাদু হেসে দিলেন। বললেন, আরে, এতে মনখারাপের কী আছে? এখনো দেশে কত অন্যায় কাজ হচ্ছে, তুমি এসবের প্রতিবাদ করো। তবেই তো তোমার হয়ে গেলো ভালো কাজ। যুদ্ধের মতোই ভালো কাজ।

পিঁপলু ভাবলো, ঠিকই তো!

সেদিন দুপুরবেলা। বাবা-মা, দাদু গেছেন বাইরে। খাদ্যের খোঁজে। পিপলু বাসায় একা। মনের সুখে পিলপিল করে হাঁটছিলো গাছের নিচে। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো একটা দৃশ্যে। গাছের মগডালে একটা মা পাখি তার ছানাদের খাওয়াচ্ছে। গাছের নিচে তীর-ধনুক নিয়ে এক  লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে নিশানা করছে, মা পাখিটাকে মারবে। পিঁপলু ভাবলো, সর্বনাশ! মা পাখিটাকে মেরে ফেললে ছানাদের কী হবে? তাদেরকে কে খাওয়াবে? সে জোরে হাঁটতে লাগল। শিকারির কাছে  গেল। যেই না শিকারি তীর-ধনুক নিশানা করেছে, অমনি তার পায়ে বসিয়ে দিলো একটা কামড়। শিকারির নিশানা হয়ে গেল বাঁকা। তীর  গেলো অন্যদিকে। মা পাখিটা ওড়ে গেল।

মা পাখিটাকে বাঁচাতে পেরে পিঁপলুর মন ভালো হয়ে গেল। তার মনে অনেক আনন্দ খেলা করতে লাগল।