পরীক্ষা ছাড়াই পাশের হারে ইংরেজির প্রভাব !

ফলাফল বিশ্লেষণ

ভূঁইয়া নজরুল »

মানবিক বিভাগের অন্যতম প্রধান নৈর্বাচনিক বিষয় অর্থনীতি। ২০১৯ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় এ বিষয়ের প্রথম পত্রে পাশের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং দ্বিতীয় পত্রে ৯০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। বিপরীতে ২০২১ সালের সীমিত সিলেবাসের পরীক্ষায় প্রথমপত্রে পাশের হার ৬৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ, দ্বিতীয় পত্রে ৭২ দশমিক ২৩ শতাংশ। এই বিভাগের অপর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমাজবিজ্ঞান প্রথম পত্রে ২০১৯ সালে পাশের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ, দ্বিতীয় পত্রে ৮৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। বিপরীতে ২০২১ সালের পরীক্ষায় প্রথম পত্রে পাশের হার ৫১ দশমিক ৯২ শতাংশ ও দ্বিতীয় পত্রে ৭০ দশমিক ১১ শতাংশ। কিন্তু সামগ্রিক ফলাফলে মানবিকে এবার পাশের হার ৮৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ, বিপরীতে ২০১৯ সালে মানবিকে পাশের হার ছিল ৪৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

ফলাফলের এই বৈপরীত্য শুধু মানবিক বিভাগে নয়। বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগেও একই চিত্র। বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পদার্থ ও রসায়ন। ২০১৯ সালের পরীক্ষায় পদার্থ বিজ্ঞান প্রথম পত্রে পাশের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং দ্বিতীয় পত্রে ছিল ৮৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। কিন্তু এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞান প্রথম পত্রে পাশের হার ৭৩ দশমিক শূন্য ৭ ও দ্বিতীয় পত্রে ৮৫ দশমিক শূন্য ২। রসায়ন বিজ্ঞান প্রথম পত্রে পাশের হার ছিল ৮৩ দশমিক ২০ শতাংশ, দ্বিতীয় পত্রে ছিল ৯০ দশমিক ১৯ শতাংশ। বিপরীতে এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় রসায়ন প্রথম পত্রে পাশের হার ৭২ দশমিত ৮৫ শতাংশ ও দ্বিতীয় পত্রে ৭৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ উভয় বিষয়ে পৃথক পৃথক পাশের হার ২০১৯ এর তুলনায় কম। একইসাথে ২০১৯ সালে বিজ্ঞানে পাশের হার ছিল ৮০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ এবং এবার পাশের হার ৯২ দশমিক ২০ শতাংশ।
অপরদিকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগেও একই চিত্র। এ বিভাগের দুই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাববিজ্ঞান ও ফিন্যান্স ব্যাংকিং। ২০১৯ সালের পরীক্ষায় হিসাববিজ্ঞান প্রথম পত্রে পাশের হার ছিল ৮৭ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং দ্বিতীয় পত্রে ৮০ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। বিপরীতে চলতি বছরের পরীক্ষায় প্রথম পত্রে পাশ করেছে ৭৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ, দ্বিতীয় পত্রে ৭৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। অপরদিকে ফিন্যান্স ব্যাংকিং প্রথম পত্রে ২০১৯ সালে পাশ করেছিল ৮৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ এবং দ্বিতীয় পত্রে ৯৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। বিপরীতে এ বছরের পরীক্ষায় প্রথম পত্রে পাশ করেছে ৬৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, দ্বিতীয় পত্রে ৮৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। অর্থাৎ উভয় বিষয়ে পৃথকভাবে ২০১৯ এর তুলনায় কম হলেও সামগ্রিক পাশের হারে এ বছর বেশি। ২০১৯ সালে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পাশের হার ছিল ৬৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং এ বছর পাশের হার ৮৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় সব বিষয়ে একই চিত্র। তারপরও বোর্ডের সামগ্রিক পাশের হার ২০১৯ সালে যেখানে ছিল ৬২ দশমিক ১৯ শতাংশ, এবার তা হয়েছে ৮৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। শুধু সামগ্রিক ফলাফল নয়, জিপিএ-৫ পাওয়ার ভিত্তিতেও এবার বেশি। করোনাকালীন হওয়ায় এ বছরের (২০২১) এইচএসসি পরীক্ষায় তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। ৫০ নম্বরের দেড় ঘণ্টার এই পরীক্ষাটি ১০০ নম্বরে পরিবর্ধন করে ফলাফল তৈরি করা হয়। একইসাথে আবশ্যিক বিষয়গুলোর নম্বর পূর্ববর্তী এসএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে সাবজেক্ট ম্যাপিং এর মাধ্যমে ফলাফল প্রস্তুত করা হয়।

শিক্ষাবিদদের বক্তব্য

সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজ এবার জিপিএ-৫ প্রাপ্তির ভিত্তিতে সবার শীর্ষে। এই কলেজের ১৭১৪ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১২৮৫ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এবারের ফলাফলে পাশের হার বেশির কারণ বলতে গিয়ে কলেজটির অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাকালীন শিক্ষার্থীরা অনলাইনে সঠিকভাবে পড়ালেখা করেছে। এছাড়া বিষয় কম হওয়ায় বেশি গুরুত্ব দিয়ে অধ্যয়ন করতে পেরেছে। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ইংরেজি বিষয় না থাকা। এই বিষয়ে পাশের হার তুলনামূলকভাবে কম থাকে। তাই হয়তো এবার পাশের হার বেড়েছে।’
একই মন্তব্য করেন সরকারি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. সুদীপা দত্ত। তিনি বলেন, ‘এবার শিক্ষার্থীরা কিছুটা শিথিলতা পেয়েছে এবং এর প্রভাব পড়েছে ফলাফলে। একইসাথে ইংরেজি বিষয় না থাকাও অন্যতম কারণ। ইংরেজি বিষয়ে পরীক্ষা হলে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পাশের হার কমে গেলে সামগ্রিকভাবে বোর্ডের পাশের হার কমে যেতো।’

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বক্তব্য

১৯৯৬ সাল থেকে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে এবারই পাশের হার সর্বোচ্চ। এর আগে ২০০৯ সালে সর্বোচ্চ ৭৬ দশমিক ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করেছিল। এবার এতো বেশি পাশের হার হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ বলেন, ‘অবশ্যই ইংরেজি ফ্যাক্টর। ইংরেজি বিষয়ে পরীক্ষা হলে পাশের হার কমে যেতো।’
কিন্তু ২০১৯ সালের তুলনায় পৃথক বিষয়ে পাশের হার কম থাকার পরও পাশের হার বাড়লো কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এবছর প্রায় আট হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষা ছাড়াই পাশ হয়ে গেছে। কারণ এসব শিক্ষার্থী শুধু আবশ্যিক বিষয়ে পূর্ববর্তী পরীক্ষাগুলোতে ফেল করেছিল। তাদের কারণেও এবার পাশের হার বেড়েছে।’
উল্লেখ্য, করোনার কারণে ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া যায়নি। সেবছর পরীক্ষায় ফরম পূরণ করা সকল শিক্ষার্থীকে উত্তীর্ণ দেয়া হয়েছিল। তবে তাদের এসএসসি পরীক্ষার প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে জিপিএ-৫ ও বিষয়ভিত্তিক নম্বর দেয়া হয়। ২০২১ সালের পরীক্ষাও করোনার কারণ যথাসময়ে নেয়া যায়নি। তাই সিলেবাস কমিয়ে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল শুধু তিনটি বিষয়ে। সেই পরীক্ষা নেয়া হয় গত ২ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে।