পরিবেশের ক্ষতি করে কোনো উন্নয়ন নয়

দেশের সরকার প্রধান প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছেন পরিবেশের ক্ষতি করে যেন কোনো ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা না হয়। কিন্তু বাস্তবে তার কতটা প্রতিফলন ঘটছে তা ভাববার বিষয়। চট্টগ্রামের সবচেয়ে সুন্দর দোতলা সড়কের সৌন্দর্যহানী করে, গাছ কেটে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণের প্রতিবাদে যখন নগরবাসী সোচ্চার তখনই শোনা গেল আরেকটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কথা।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় কর্ণফুলী নদীতে জেগে ওঠা চর বাকলিয়ায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্ল্যান্ট বসাতে চায়। নদীর মাঝখানে বিদ্যুৎপ্ল্যান্ট তা-ও আবার বর্জ্য থেকে এমন আজব সিদ্ধান্তের কথা শুনে যেকোনো সুস্থ মানুষ মর্মাহত হবেন নিঃসন্দেহে।
স্বাভাবিকভাবে চর বাকলিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপন নিয়ে আপত্তি আছে পরিবেশবাদীসহ চট্টগ্রামের সচেতন মহলের। কারণ, চর বাকলিয়া উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে ভরপুর। একটি জরিপ থেকে জানা গেছে, এখানে রয়েছে স্বর্ণলতাসহ বিরল ১১৩টি ঔষধিসহ ১৫৫ প্রজাতির উদ্ভিদ। বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট হলে তা ধ্বংস হয়ে যাবে। একইসঙ্গে এ চর হচ্ছে নানা প্রজাতির পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল। বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়ন (ইকো) ২০২২ সালে তাদের একটি গবেষণায় চর বাকলিয়ার উদ্ভিদবৈচিত্র্য তুলে ধরে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে সেই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। গবেষণায় চর বাকলিয়ায় মোট ১৫৫ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করে। যার মধ্যে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ, ২০ প্রজাতির বিরুৎ, ৫৭ প্রজাতির গুল্ম, ১২ প্রজাতির লতানো উদ্ভিদ ও পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের সংখ্যা ছিল ২টি। ১৫৫টি উদ্ভিদের ভিতর ১১৩টি ঔষধি গাছ বিদ্যমান। প্ল্যান্ট হলে সেসব নষ্ট হবে। এছাড়া এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, চট্টগ্রাম শহর থেকে বর্জ্য আনা–নেওয়ার ক্ষেত্রে তা নদীতে পড়বেই। সেক্ষেত্রে দূষিত হবে দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী কর্ণফুলী। হালদা নদীর মোহনার কাছে হওয়ায় এতে দূষণের শিকার হবে হালদা, যেখান থেকে ওয়াসা পানি সংগ্রহ করে নগরের পানির চাহিদা পূরণ করে।
এরই মধ্যে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে বেশকিছু সংগঠন। চর বাকলিয়ায় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার দাবি জানিয়ে ‘কর্ণফুলী রক্ষায় জনগণের মঞ্চ’ এর ব্যানারে পরিবেশকর্মীরা আন্দোলন করে আসছেন। তারা চর বাকলিয়ায় গিয়ে মানববন্ধন করেন। সংবাদ সম্মেলন করে তারা আল্টিমেটামও দিয়েছে। সর্বশেষ ১ এপ্রিল জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছে এই সংগঠন।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন, চরের আশেপাশের স্থানীয়রা প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা এইসব ঔষধি গাছের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। কারণ দিন দিন লোকালয় থেকে অনেক উদ্ভিদই হারিয়ে যাচ্ছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে এই চরের গাছপালাকে বাড়তে দিলে এ চর ঔষধি গাছের সুবিশাল উৎসে রূপান্তরিত হবে। ঔষধি গাছসহ এ চরের দুর্লভ সমস্ত উদ্ভিদরাজিকে রক্ষা অতীব জরুরি। নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা এই চরের গাছপালার ওপর পশু–পাখি অনেকটা নির্ভরশীল তাদের খাবারের জন্য।
আমরাও মনে করি, চর বাকলিয়া যেন প্রাকৃতিকভাবে আরও সমৃদ্ধ হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নানাবিধ ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত এবং সেই সাথে নদীর মাঝখানে সবুজে ঘেরা এ চরকে হত্যা করে ডাম্পিং স্টেশন তৈরির চিন্তা থেকে যেন কর্তৃপক্ষ সরে আসে।