নাইল্যা ক্ষেত

নূর নবী আহমেদ

প্রমিত বাংলায় বলা হয় পাট যা বিগত কয়েক দশক পূর্বেও এই দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল। এই পাটের আঞ্চলিক নাম নাইল্যা। যেটি অত্র অঞ্চলে সবার কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত। আদমজী জুট মিল ছিল সারাবিশ^ তথা এশিয়ার সবচেয়ে বড় জুট মিল, বর্তমানে এই জুট মিল না থাকলেও নাইল্যা এখনো এই অঞ্চলের আনাচে-কানাচে চাষ হয়ে থাকে। নাইল্যা খুবই সুস্বাদু একটি শাক ও তরকারি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বড় নাইল্যার পাতা শুকিয়ে কাচের বোতলে রেখে দেয়া হয়। পরে শুকনো মরিচের ভর্তা করে ভাতের সাথে খুবই মজাদার পদ বানিয়ে খায় এই অঞ্চলের অনেক মানুষ।
কচি নাইল্যার সবজি, নাইল্যা পাতার গুঁড়া এখন এই এলাকার উপাদেয় খাবার কিন্তু অর্থকরী ফসল হিসেবে নাইল্যা তার মর্যাদা অনেক আগেই হারিয়েছে। শেখ বাড়ির মানুষেরাও তাই নাইল্যা বা পাটবিক্রির টাকা আগের মতো পায় না বিধায় তারা আর আগের মতো আর্থিকভাবে সচ্ছল না। তারপরেও বর্তমানে যা আছে তা দিয়ে মোটামুটি চলে যায় মাত্র।
পাঁচ বোন ও তিন ভাইদের মধ্যে পৈতৃক জায়গা জমি বণ্টনের পর আলাই মিয়ার কপালে যা জুটেছে তাতে বছরের ছয় থেকে সাত মাসের খোরাকি জুটে। বাকি মাসগুলো তালিজোড়া দিয়ে চলে তার সংসার। সম্পদ ভাগ-বণ্টনের সাথে বৃদ্ধ মায়ের ভরণ- পোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্বই নিজের কাঁধে নিয়েছে আলাই মিয়া। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, দুটি ফুটফুটে ছোট মেয়ে নিয়ে তার আনন্দের সংসার। আর্থিক টানাহেঁচড়া থাকলেও সংসারে সুখ প্রতিদিনই উপচে পড়ে। আলাই মিয়া তাই দৃঢ়ভাবে দিন গুনে আগামী বছর থেকে চিটাগাং আর ঢাকার আবদুল্লাহপুরে কামলা দিতে যাবে। এতে সারাবছরই তার সংসারে ছুতরা পাতা হয়ে সচ্ছলতা ও সুখ লেগেই থাকবে।
আবদুল্লাহপুরে প্রায় দুমাস কামলা দেওয়ার পর আলাই মিয়ার উপার্জন ভালোই হলো। বন্ধক দেওয়া সাড়ে ছয় কাঠা ধানিজমির মধ্যে এক কাঠা এক কুচি জমি বন্ধকমুক্ত করে নিজের হাতে আনে। বড় মেয়ে লিলিকে প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করানো হবে পরের বছর আর ছোট মেয়ে এখনো হাম্পুর দেয় বাড়ির উঠোনে। কয়েকটা পয়সা তার হাতে আসার সাথে-সাথে অলসতাও শরীরে এসে ভর করে। অলসতার দাপটে সে নিজেকে এক ধরনের নবাব মনে করতে থাকে।
‘ হুন বাপ তুই রুবেলদের লগে চিটাগাং যা।’
‘আম্মা বারি চারা বাল্লাগে না।’
‘কইঢা দিন কষ্ট কইরা জমিঢি চুঢা। হের পরে আর যাওন লাগতো না।’
‘আইচ্ছা দেহি কিতা করন যায়?’
‘দেহি না বাবা, আর কয়ঢা দিন কষ্ট কর।’
মায়ের কথাগুলো তার মনোজগতে প্রবেশ করে আর শান্ত একটা ঘুম দুই চোখে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে কখন তার চোখ দুটি বন্ধ হবে, আর ঘুমদেবতা সেখানে রাজত্ব করবে। কাঁথাটা টান দিয়ে শীতের এই অসময় বিকেলে চৌকিতে নিজের দেহ সমর্পণ করে আলাই মিয়া।
চিটাগাংয়ের হাটহাজারীতে এসে সর্বপ্রথম আলাই মিয়া যে সমস্যার সম্মুখীন হয় তা হলো চিটাগাংয়ের আঞ্চলিক ভাষা সে কিছুই বুঝতে পারে না। তবুও গড়দুয়ারার জমির সওদাগরের বাড়িতে জুয়াইল্যা কামলা হিসেবে সে ভালোই আছে। বাড়ির প্রায় প্রতি ঘর থেকেই কেউ না কেউ দুবাইয়ে থাকে। গড়দুয়ারা গ্রামের প্রায় প্রতি ঘর থেকেই এক বা একাধিক প্রবাসী আছে। গড়দুয়ারা একটি গ্রাম হওয়া সত্ত্বেও তার অবকাঠামোগত উন্নয়ন আলাই মিয়ার নিজ জেলা শহর থেকেও বেশি। আলাই মিয়ার কাছে মনে হয়, আহা তার গ্রাম মল্লিকপুর যদি গড়দুয়ারার দশ ভাগের এক ভাগ উন্নত হত তাহলে কত ভালোই না লাগত তার। আলাই মিয়ার গ্রামের ঘর হচ্ছে ছনের, বাইশ্যা মাসে কখনো-কখনো তার ঘরে উষ্যিলাও পড়ে। আলাই মিয়ার সরলতা, কাজের প্রতি সততা সবকিছু মিলে সওদাগর বাড়ির আজম সওদাগরের স্ত্রী মনোয়ারার কাছে তাকে খুব ভালো লাগে। মনোয়ারার স্বামী দুবাই প্রবাসী। মনোয়ারা অতি সন্তর্পণে তাকে দুবাই যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। দুবাইয়ে আজমের নিজস্ব দুটি গ্যারেজ আছে। যদি আলাই মিয়া যেতে চায় তো সবকিছুর ব্যবস্থা করবে মনোয়ারা।
আলাই মিয়ার স্ত্রী শোভার পোয়াতি হিসেবে আটমাস অতিক্রম করেছে। তার মা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে প্রতিনিয়তই দোয়া করছে এবার যেন শোভা ছ্যারা বা ছেলে সন্তান পয়দা করে। কারণ এই বাড়িতে আলাই মিয়ার খুঁটি তেমন শক্ত না, খুব নড়বড়ে। অন্য ভাইদের ছেলে সন্তানদের সংখ্যা বেশি আর আলাই মিয়া এখনো ছেলের মুখ দেখেনি। যদি তার ছেলে নাতি না হয় তো আলাই মিয়ার বাতি নিবে যাবে। শোভা প্রতিদিন সন্ধ্যা করে চিটাগাংয়ে কল দেয়, স্বামী যেনো তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে আসে। তাছাড়া শরীরটা বেশ নরম। যদি উপজেলা শহরের হাসপাতালে একটু বড় ডাক্তার দেখানো যায়, তবে ভালো হয়। এলাকার ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা অবশ্য নিজ দায়িত্বেই শোভার কানে ভনভন করে বলছে, যেনো কোনো পুরুষ ডাক্তার না দেখায়। এতে শোভার কবিরাগুনাহ হবে।
চিটাগাং থেকে মোহনগঞ্জ আসার একমাত্র বাস হচ্ছে পালকি। মাত্র ২০০ টাকা বাঁচানোর জন্য আলাই মিয়াকে সিট না নিয়ে টুলে বসে বাড়ির দিকে রওনা হয়। এতে তার খরচ হয় ৫০০ টাকার জায়গায় ৩০০ টাকা। অনেকটা কষ্ট হলেও ২০০ টাকা তো তার সঞ্চয় হয়েছে। এতে খুব ভালো করে দুদিন চলতে পারবে তার সংসারের সবাই।
‘আল্লার উপ্রে বরসা ট্যাহ্যা যেইঢি লইয়া আইচচ হেইঢি দিয়া আগে জমিনঢি চুঢা। এরপরে অইন্য হিসাব।’
‘আম্মা, শোভারে ডাক্তার দেহাইবাম। চেলে বা মেয়ে কিচু একটা অওনের পর যদি ট্যাহা তাহে, তাইলে জমিন চুডাইবাম। আগে মানুষ হরে জমিন।’
‘তুই আমার চুঢো হুত, ক আমার মুকের উপ্রে কতা ক।’
আলাই মিয়া আর কোন কথা না বলে মাঝঘর থেকে রাগে বের হয়ে যায়।
শেখবাড়ির অন্যান্য ধর্মান্ধ মুরব্বিরাও শোভাকে হাসপাতালে নিতে নিষেধ করায় বাড়িতেই দাই এসে ডেলিভারি করে শোভার। সন্ধ্যার পর থেকে প্রসবব্যথা ওঠে শোভার। এশার আযানের পরপরেই সবার কানে কানে খবর যায়, তা হলো এই, শেখ বাড়ির আলাই মিয়ার স্ত্রী মৃত মেয়ে জন্ম দিয়ে সাথে সাথে সেও মৃত্যুর দুনিয়ায় চলে গেছে।
বাড়ির মাঝখানে উঠোনের সামনে ক্রদ্ধ হয়ে চিৎকার করতে থাকে আলাই মিয়া ‘আমি কইচলাম হাসপাতালো নিতে আমার মাসহ তোমরা বেহেই আমারে আটকাইচো। তোমরা ইচ্চা কইরা মারচো আমার বউ আর চেরিরে।’ দূর থেকে ওপরের আকাশ আরো গাঢ়তর অন্ধকার হতে থাকে। যেন আলাই মিয়ার কষ্টগুলো বহন করে।
পাশাপাশি যে পাঁচটি নাইল্যা ক্ষেত আছে আলাই মিয়ার, একবারে সড়কের পাশে লাগানো সর্বশেষ ক্ষেতটি, যেটি এখনো বন্ধক অন্যের কাছে, সেখানেই কবর হয় শোভার।
‘ওরে হুত বউয়ের হায়াত আচিন্ন্যা এর লাইগা আল্লাই নিচে গা। আমার উপ্রে রাগ কইরা তো এক বচর গেলো। অন্তত ছেরি দুইঢার দিকে চাইয়া অইলোও আরেকটা বিয়া কর। আমি বুড়া মানুষ রানদাবারা আর কত্তা হারি না।’
‘তুমি যাও এইনতো। আমার বউয়ের দরহার নাই। রানদাবারা আমি কইরা তোমারে দিয়ামনে।’
শেখবাড়ির সব মুরব্বি যখন বুঝাতে সমর্থ হয়, ঠিক তখনই দ্বিতীয়বিয়ে করে শেখ আলাই মিয়া। আলোকদিয়ার ভিক্ষুক সাবেকুনের একমাত্র মেয়ে সুইটিকে বউ করে ঘরে তোলে আলাই মিয়া। বিয়ের পর আবারো চিটাগাং গেলে মনোয়ারা ও তার স্বামীর সহযোগিতায় মাস পাঁচেক পর পাসপোর্ট-ভিসার কাজ সম্পন্ন করে দুবাইয়ে যাত্রা করে আলাই মিয়া।
সুইটির কোনো সন্তান হয়নি। তবুও স্বামীর আগের ঘরের মেয়ে দুটি ও শাশুড়িকে নিয়ে সে ভালোই আছে। যতটুকু জমি বন্ধক ছিল অন্যের কাছে, সবটুকু ছুটানো হয়েছে প্রবাসের টাকায়। কামলা দিয়ে এসব জমি চাষ করায় শাশুড়ি ও সুইটি।
ছয়-সাত বছর হলো আলাই মিয়া দুবাইয়ে থিতু হয়েছে। টাকা পাঠায় আর মোবাইলে যোগাযোগ হয় সবার সাথে। সুইটির যে সন্তান প্রয়োজন তা তার শাশুড়ি ইচ্ছে করেই মনে করায় না।
সুইটির কাছে নাইল্যা ক্ষেতগুলো হলো এক ধরনের বৃন্দাবন। যেখানে রাধা সুইটি ও কৃষ্ণ রবিন রাতবিরাতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর হাত ও কোমর নাড়াচাড়া করে কৃষ্ণলীলায় মেতে ওঠে।
আলাই মিয়া দুবাই যাওয়ার ঠিক ৯ বছরের কিছু বেশি সময় পরে প্রবাসী মন্ত্রণালয় থেকে একদল মানুষ সাথে করে একটি এম্বুলেন্স নিয়ে আসে। অনেক পুলিশও আসে তাদের সাথে। প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের সচিব অত্র ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে আলাই মিয়ার লাশ হস্তান্তর করে। দুবাইয়ে কয়েক দিন আগে ঘটে যাওয়া একটি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯ জন বাংলাদেশিনিহত হয়। তাদের মধ্যে শেখ আলাই মিয়াও একজন।
গ্রামবাসীদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে শেখ আলাই মিয়ার ২য় স্ত্রী সুইটি তো কিছুই পায়নি। সুইটির বাচ্চা নেই। ওর তো জীবন ও যৌবন দুটোই বৃথা গেলো। সুইটির যৌবন যে বৃথা যায়নি তা গ্রামবাসী জানে না। তা জানে কেবল সুইটি পাশের বাড়ির কামলা রবিন ও ছালেক আর আলাই মিয়ার বাড়ির পাশের নাইল্যা ক্ষেত।