জঙ্গল সলিমপুরে ফের সংঘর্ষ

সুপ্রভাত রিপোর্ট »

চট্টগ্রামের জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় ‍অভিযানে যাওয়া প্রশাসনের কর্মকর্তার ওপর হামলা করেছে স্থানীয়রা, পুলিশের সঙ্গে জড়িয়েছে সংঘর্ষে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই সংঘর্ষের মধ্যে গুরুতর আহত এক ব্যক্তিকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসন পরিচালিত এই উচ্ছেদ অভিযানে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর , সিটি কর্পোরেশন এবং কর্ণফুলী গ্যাসের প্রতিনিধিগনও উপস্থিত ছিলেন। উচ্ছেদ অভিযানের সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে অবৈধ দখলদারদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে আহত কয়েকজন হলেন আমেনা বেগম (৩০), মো. আলী রাজ হাসান সাগর (২৪), আনসার সদস্য বাবুল ম-ল ( আইডি নং ৫৬৭০০), আমেনা বেগম (৫০), মো. বাবুল (৩৫) ও মো. পারভেজ (২৩)।

বার্তা সংস্থা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানায়, আগের ঘোষণা অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকালে সলিমপুরের বায়েজিদ লিংক রোডের দুপাশের ফুটপাত, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউসন কোম্পানির পাইপ লাইনের উপর নির্মিত ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা এবং ফুটপাত ও পাইপলাইন সংলগ্ন এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযানে যায় জেলা প্রশাসন।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে লিংক রোডের বায়েজিদ অংশের শুরুর দিক থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সড়কের দুপাশের ফুটপাত ও ফুটপাত ঘেঁষে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেয় প্রশাসন। এসময় পুলিশ সদস্যরা ছিলেন।

পরে প্রশাসনের কর্মকর্তারা সলিমপুরের পাহাড়ের শেষের অংশে থাকা আলী নগরের দিকে অগ্রসর হন। এ অবস্থায় প্রবেশ পথের দুপাশের পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে স্থানীয়রা তাদের উপর ঢিল ছোড়েন।

বেলা ১টার দিকে পুলিশ পাল্টা রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে। এ সময় পাহাড়ি পথের বেশ কিছু দূর এগিয়ে যাওয়া পুলিশ ও প্রশাসনের সদস্যদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি ঢিল ছোড়ে স্থানীয়রা।

এ পরিস্থিতিতে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়তে ছুড়তে পাহাড়ি রাস্তা ধরে সলিমপুর থেকে বেরিয়ে যায়; পরে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে বায়েজিদ লিংক রোডে অবস্থান নেয় পুলিশ। বিকাল পৌনে ৪টা পর্যন্ত পুলিশ ও প্রশাসনের সদস্যরা সেখানে অবস্থান করেন।

সীতাকু-ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহাদাত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকে সলিমপুরে আমাদের উচ্ছেদ ছিল না। সড়ক ও সড়কের আশেপাশে ফুটপাত ও গ্যাসলাইন ঝুঁকিমুক্ত করার অভিযান ছিল। এরপর আলী নগর এলাকায় পরিদর্শনে যাই আমরা।

“তখনই ইট-পাটকেল ছুড়তে ছুড়তে হামলা করা হয়। রাবার বুলেট ছুড়ে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কয়েকজন আহত হয়েছে। তবে এখনই নির্দিষ্ট করে কতজন আহত তা বলতে পারছি না।”

ঘটনাস্থলে কমপক্ষে দুজন পুলিশ সদস্যকে মাথায় ও হাতে আঘাত নিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় সলিমপুর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেছে। এছাড়া কয়েকজন বাসিন্দাকে আহত অবস্থায় সেখান থেকে বের করে আনতে দেখা যায়।

তাদের মধ্যে মো. আলী রাজা হাসান সাগর (২৪) নামের একজন রাবার বুলেটে গুরুতর আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভর্তি হয়েছেন বলে পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাদেকুর রহমান জানান।

ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে সীতাকু- থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক বলেন, “আমাদের চারটি দল ভিন্ন পথে সলিমপুরের ভেতরে গিয়েছিল। এর মধ্যে তিনটি দলের উপর বেশি ঢিল ছোড়া হয়।

“আমরা এখন লিংক রোড এলাকায় আছি। কয়জন আহত হয়েছেন সেটা এখনই নিশ্চিত বলতে পারছি না।”

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেকটর মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “আমাদের সাথে থাকা একজন আনসার সদস্য এবং জেলা প্রশাসনের চারজন কর্মচারী আহত হয়েছেন। এছাড়া চার জন পুলিশ সদস্যও আহত হন।

ফুটপাত ও পাইপলাইন সংলগ্ন এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে পূর্ব নির্ধারিত অভিযান ছিল জেলা প্রশাসনের।

“১২ সেপ্টেম্বর সলিমপুর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সভা আহ্বান করা হয়েছে। তাই আজ আমরা সেখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি আলী নগরে এখনও পাহাড় কাটা অব্যাহত আছে। সেখানে দিনে ৩০-৪০টি নতুন ঘর তোলা হচ্ছে।”

মো. তৌহিদুল বলেন, “পাহাড় কাটা ও অবৈধ স্থাপনা তৈরির সাথে যেসব দুষ্কৃতকারী জড়িত তারাই লোকজন দিয়ে আজ হামলা চালিয়েছে।
“আলীনগরে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরিতে তারা জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে লোহা এনে ব্যবহার করে। এসব লোহা ও পাথর দিয়ে তারা হামলা করে।”

যেভাবে শুরু

গত ১ জুলাই জঙ্গল সলিমপুরে পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে থাকা খাস জমিতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, স্পোর্টস ভিলেজ, ক্রিকেট স্টেডিয়াম, আইকনিক মসজিদ ও ইকো পার্কসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান।

সেদিন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, সলিমপুরে বসতি স্থাপনকারী ১৫ হাজার পরিবারকে সেখানেই পুনর্বাসন করে সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হবে।

ওই এলাকায় মোট ৩১০০ একর জমির মধ্যে ৮৮ একর অবৈধ দখলদারদের হাতে থাকার কথা সেদিন জানিয়েছিল জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
স্থানীয়দের দাবি, কম টাকায় ‘জমি কিনে’ সেখানে বসতি স্থাপন করেছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ছিন্নমূল মানুষ।

প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক সমীক্ষার অংশ হিসেবে ১৫ জুলাই সলিমুপরে যাওয়া প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে থাকা ইউপি সদস্য মো. আরিফকে আটকে রেখে মারধর করে স্থানীয়রা।

ওই ঘটনায় আরিফের করা মামলায় ১৮ জুলাই মো. ইয়াসিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ইয়াসিন (৫০) সীতাকু-ের জঙ্গল সলিমপুরের আলী নগরে একটি বাহিনী গড়ে তুলেছেন এবং সেখানে চাঁদাবাজি, পাহাড় দখলসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত বলে পুলিশের ভাষ্য।

এরপর ২২ জুলাই সলিমপুরে অভিযান শুরু করে প্রশাসন। সেদিন পাহাড় কাটার কাজে দুটি স্কেভেটর, সাতটি ড্রাম ট্রাকসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। এছাড়া পাহাড় কাটার অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তর দুটি মামলা করে।

২৪ জুলাই ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জান চৌধুরী জাবেদ জঙ্গল সলিমপুরে পরিদর্শনে গিয়ে জানান, সেখানে বসবাসকারী সকল প্রকৃত ভূমিহীনদের পুনর্বাসন করা হবে। পাশাপাশি তিনি আলী নগরের শেষ প্রান্তের মসজিদ পর্যন্ত বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ রেখে অবৈধ সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করতে নির্দেশ দেন।
এরপর থেকে প্রশাসন অবৈধ সংযোগ চিহ্নিত করা শুরু করে। টানা অভিযানে ১৭০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে প্রায় ৭০০ একর জমি দখলমুক্ত করা হয়।

এরপর ২৩ অগাস্ট বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগের দাবিতে ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি মোড়ের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে ছয় ঘণ্টা অবস্থান করে সলিমপুর ও আলী নগরের বাসিন্দারা।

পরে পুলিশ তাদের সরাতে গেলে সেদিনও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার পরদিন পুলিশ ছয়টি মামলা করেছিল।

এরপরই প্রশাসনের পক্ষ থেকে সলিমপুর ও আলী নগরে ‘অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের’ সরে যেতে ৩০ অগাস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
প্রশাসনিক কাঠামোতে জঙ্গল সলিমপুরের অবস্থান সীতাকু- উপজেলার আওতায় হলেও সেখানে যেতে হয় নগরীর বায়েজিদ থানার বাংলাবাজার এলাকা দিয়ে। প্রায় দুই দশক ধরে সেখানে পাহাড় কেটে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা গড়ে তোলে ‘চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন। পাঁচ বছর আগে এই সমিতির সদস্য সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার।

সমিতির নেতারা তখন জানিয়েছিলেন, সেখানে আট হাজার পরিবারের প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসবাস করতেন। এদের অধিকাংশ রিকশাচালক, ঠেলাগাড়ি চালক, দিনমজুর, হোটেল বয় ও গার্মেন্টম শ্রমিক।