খসড়া শৈশব

আকিব শিকদার

মাইক বাজিয়ে এসেছেন আইসক্রিমওয়ালা, তার বেসুরা গলা। সুপারির বিনিময়ে, কাঁচাধানের বিনিময়ে রাখছি নারকেলি আইসক্রিম। ফেরিওয়ালা ডাক দিলো ‘চুরি-আলতা’। তাকে ঘিরে পাড়ার মেয়েদের ভিড়।
একটা কলার ভেলায় আমরা তিনজন পানিতে ভাসছি, ঢেউ তুলে হাসছি। সাঁতরে সাঁতরে পুকুরে ঝুঁকতে থাকা কদমের ডাল ধরে বানরঝোলা ঝুলে গাছে ওঠার চেষ্টা করছি আমি কাইয়ুম আর আজহার। নষ্ট টায়ার ছোট লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সারাদিন ওটার পিছু ছুটছি, যেন আমার মোটরসাইকেল। স্কুলে যাইনি বলে মা ঝাড়– হাতে পিটাতে এলে পালিয়ে বাঁচা। বয়স তখন কাঁচা।
আমার ফেলে আসা শৈশব, বন্ধুরা কই সব? স্কুলে যাবার পথে মেহেগুনির বিচি আকাশের দিকে ছুড়ে মারি। ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে পড়ে, যেন চরকি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব সারি। অলি আর আলমাস ছুটে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘নুনু দেখে ফেলেছি’। ওরা আমার সহপাঠী, শয়তানের ঘাঁটি। তাড়াহুড়ো করে প্যান্ট সামলাতে নুনুতে চেইন এঁটে গেল। যন্ত্রণায় দিলাম তীব্র চিৎকার। আকাশ-বাতাস পার।
কাকিমা কুলা হাতে ধান ঝাড়ছে, পাশে কবুতর। নতুন ধানের উৎসব। আমিন কাকা আর সালিম কাকা ধান মাড়াই কলে। বাতাসে উড়ছে খড়, নতুন খড়ের কাঁচাগন্ধ। কে বলবে মন্দ!
চড়ুইভাতি খেলবো। খেত সেচে ছোটমাছ ধরেছি। খিচুড়ি রান্না শেষ, ডিম ভাজা হচ্ছে। চোখ বেঁধে ঝুমি আপা আমাদের ধরতে চাইছেন। আমরা তার শরীর ছুঁয়ে পালিয়ে যাই কাছাকাছি, কানামাছি।
নানার বাড়িতে গেলে সারা শরীরে কাদা মেখে ফুটবল খেলি। শরীর ও মুখের কাদায় চিনতে না পারা দশা। যেন আমরা কাদামাটির মূর্তি। কি যে ফূর্তি। শ্যালোকলে পানি উঠেছে আর আমরা ড্রেনে গোসলে নেমেছি। পানির ঝাপটা আমাদের ভাসিয়ে নিচ্ছে। তাসলিমা, আকলিমা, হিমেল আর আমি। দিনগুলো সত্যিই ছিল খুব দামি।
স্কুলে যাই ছোট সাইকেলে। আমার সাইকেলে একত্রে চারজন চড়লো। স্যারেরা উঁচু থেকে সুতো বেঁধে বিস্কুট ঝুলিয়েছেন। আমাদের হাত পেছনে বাঁধা। লাফিয়ে লাফিয়ে খেতে হবে, বিস্কুট লাফ খেলা। আনন্দ মেলা।
ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চারপাশে দেয়াল তোলা স্কুলের পেছনের ছোট গেট টপকে পালিয়ে যাচ্ছি আমি, নুরু, সুমন, আবদুল। স্কুলব্যাগ এঁটে গেছে গ্রিলে। মুসিবত আছে কপালে, স্যার তেড়ে আসছেন।
কত স্মৃতি, কত স্মৃতি। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে স্কুলে এসেম্বলি করি। জাতীয় সংগীত গাই। পতাকাকে সালাম জানাই। ভালো মানুষ হয়ে দেশগড়ার শপথ করি। আমরা কি হতে পেরেছি শপথের মতো যথার্থ ভালো মানুষ?
মনে পড়ে, জলছবির মতো কতো স্মৃতি, মনে পড়ে। অর্ধেক মাথা কামাতেই চুল কাটবে না বলে কান্না জুড়েছে আমার ছোটভাই। তাকে লাগছে তাই তোফাজ্জল দাদার মতন টাক পড়া। ছোটবোনকে সাইকেলে তুলে ঠেলে ঠেলে চালাচ্ছি। আমার হাফপেন্ট গেল খুলে। না পারছি সাইকেল সামলাতে, না পারছি খোলা প্যান্ট ঠিক করতে। পারিবারিক অ্যালবামে একটা ছবি আছে আমার চুল কামানো, গায়ে জামা নেই, পা থেকে মাথাঅব্দি একেবারে এক কালার।
এইসব দিন কোনদিন ফিরবে না আর।