আজমল সাহেবের দেরি হলো যে-কারণে

ইলিয়াস বাবর

হাজিরা খাতা জিবি স্যারের প্রশস্ত টেবিলে নেই। তার মানে, কোন এমসিজির হাত ধরে খাতাটি এখন ম্যানেজার স্যারের চেম্বারে এসির ঠান্ডা হাওয়া গায়ে মাখছে। দোনোমনা ভাব নিয়ে আজমল সাহেব নিজের ডেস্কে গিয়ে বসেন। আশপাশের পরিবেশ সাক্ষ্য দেয়, সময় কিছুটা বেশিই হয়ে গেল আজ! স্যারের চেম্বারে গিয়ে এখন স্বাক্ষর করবে, সে ভাবনায় পাত্তা দেয় না আজমল আলী। যা হবার হোক, দুপুরে নামাজ আর লাঞ্চের জন্য উঠলে খচখচ করে সাইনটা মেরে দেবে, এটাই সাজিয়ে রাখে। তার ডেস্কটাই এ রকম, দুপুরের ওয়াক্ত পেকে ঝুনা না হলে ওঠা যায় না। ততক্ষণে জোহরের সময় থাকে সামান্য, পেটে সিগনাল দিতে দিতে খিদেটাও মরে যায় বেখেয়ালে। পাশের ডেস্ক থেকে বেলায়েত ভাই বলে ওঠেন, কিয়ো স্যার, আজ বুঝি গাড়ি পাননি? কম্পিউটার অন করে লগইন করতে করতে বেলায়েত ভাইয়ের দিকে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আজমল আলী বুঝিয়ে দেয়, ঘটনা অনেকটা তা-ই।
এমনিতে মেজাজ আছে চরমে, ইশারায় কাজ সারাই শ্রেয়, ভাবেন আজমল। দীর্ঘ চাকরিজীবনে কত স্যার হ্যান্ডেল করা হলো, কত কাস্টমার হ্যান্ডেল করা হলো। এখন হুট করে চটে না ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার আজমল আলী। সাথের অনেকেই আজ হেড অফিসের বড় স্যার। রেঙ্কে তার অনেক ওপরে। বেতন পায় তার কয়েক গুণ বেশি। তবুও দুঃখ নেই আজমলের। মাসশেষে যা ঢুকে স্টাফ একাউন্টে তা মন্দ না।
ইন্টারকম বেজে ওঠে। রিসিভ করে সালাম দিতেই ম্যানেজার স্যারের ঝাঁজালো কণ্ঠ, এদিকে আসেন আজমল সাহেব! চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায় আজমল আলী। বেচারা এই বয়সেও মিস দেন না কোন সপ্তাহ। ঝড়-বৃষ্টি যাই হোক প্রতি বৃহস্পতিবার আসরের নামাজ সেরে সোজা বের হয়ে যান অফিস থেকে। চলতি পথে পাওয়া ডাইরেক্ট যেকোন গাড়িতে ওঠে পড়েন অতঃপর। চট্টগ্রাম শহরে ব্যাংকের লোনে করেছেন বিল্ডিং আরো অনেক কলিগযোগে। ভাগে পেয়েছেন দুটো করে ফ্ল্যাট। একটাতে বউ-বাচ্চা নিয়ে নিজে থাকেন, বাকিটা ভাড়া। দুদিন পরিবারের সাথে কাটিয়ে রোববার ভোরে বের হন শহরের বাসা থেকে। অফিস টাইমের আগে নামেন নোয়াখালির চৌমুহনিতে। এই নিয়মে আজমল আলীর হেরফের নেই। নতুন আসা দুষ্টু অনেকে আজমল সাহেবের প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাওয়া নিয়ে আড়ালে মজা করে, হাসাহাসির উপলক্ষ খোঁজে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আজমল আলী ম্যানেজার স্যারের চেম্বারে ঢোকে সালাম দিয়ে। স্যার তখন ব্যস্ত আইপিফোনের কথায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। কথার ভেতরে স্যার একবার তার দিকে তাকান আগুনচোখে।
রিসিভার রেখেই স্যারের তীব্র প্রশ্ন, আজমল সাহেব, আপনি সিনিয়র লোক, এত দেরিতে অফিসে আসলে হবে? আপনাদের দেখেই তো শিখবে বাকিরা। বলেন, কেন দেরি হলো আজ?
স্যারের এ রকম কড়াভাব আগে তেমনটা দেখেননি আজমল আলী। নিশ্চয়ই হেড অফিস বা জোনাল অফিসের কোন কড়া ফোন পেয়েছেন। হেড অফিস তো বটে জোনাল অফিসও বসে আছে ব্রাঞ্চগুলোর দোষ ধরতে। তিলকে তাল করতে ওস্তাদ ওরা। ওপর থেকে ছোট বাঁশ আসলে সেটা নিচের দিকে বড় বাঁশ হয়ে যায়। মুরুব্বিরা বলেন, এটাই নিয়ম।
আমতা-আমতা করেন আজমল সাহেব। স্যার, মানে, গাড়িঘোড়ার পথ, সব সময়ই এক রকম হয় না স্যার।
অফিস এসব মানবে না আজমল সাহেব, স্যারের যুক্তি। কোন গাড়িতে আসেন আপনি, আজ কিসে আসলেন?
অনেক গাড়িই তো আছে স্যার, যখন যেটা পাই।
আপনাকে বলছি, আজ কোনটাতে এলেন? আজমল আলীর মুখে কোন কথা নেই।
স্যারের প্রশ্নের উত্তর না দেয়া অন্যায়, সেটা বোঝেন তিনি, তবুও নীরব।
ঠিকাছে আপনি যান ডেস্কে। মেমো রেডি করবো আপনার নামে। টের পাবেন।
চেম্বার থেকে বের হয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে সকালের সময়টা ভাবেন আজমল আলী। তিনি তখন অন্য রোববারের মতো এ কে খান মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন গাড়ির অপেক্ষায়। একটা বাস তার সামনে এসে থামে। গাড়ির রং দেখে মনে হয়, এই রুটে বুঝি নতুন। গাড়ির গায়ে বড় করে লেখা কোম্পানির নাম। পেসেঞ্জার ডাকার স্টাইলও সুন্দর, ভদ্রগোছের। কিছু কথা সেরে আজমল আলী ওঠে পড়েন নয়া বাসে। দেখেন তার মতো আরো অনেকেই আছেন ঘুমভরা চোখে। না, গাড়ির টান কাবিল না। লোকাল করার চেষ্টা করে। ফলে নির্ধারিত সময়ের প্রায় আধঘণ্টাা বেশি গেছে। যাত্রীরা অবশ্য ভদ্রভাষায় গালিগালাজ যে করেনি, তা নয়। কিন্তু মাঝপথে নেমে বিপদে পড়বে কে? গাড়ির নামটাও অন্যরকম, শুনলে হাসি পায়।
ম্যানেজার স্যারকে আজমল আলী কিভাবে বলবেন, তিনি যে ‘বালেশ্বর’ নামের বাসে এসেছেন!
এমন নাম শুনলে স্যার মাইন্ড করবেন না?