কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতু কবে!

রূপন কান্তি সেনগুপ্ত »

ছয়মাস আগে রেলমন্ত্রী কালুরঘাট সেতু পরিদর্শনে এসে কর্ণফুলী রেল সেতু কাম-সড়ক সেতু হবে মর্মে জনগণকে আশ্বস্ত করেছিলেন-প্রায় ৬ মাস হয়ে গেলো, এখনো এই গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণের ব্যাপারে কোনোরূপ অগ্রগতির খবর গণমাধ্যমে আসেনি। এদিকে বোয়ালখালীবাসীর দুর্ভোগ করোনাকালের লকডাউনে আরো বেড়েছে। বলা যেতে পারে এই উপজেলার সাথে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য- কোর্ট-কাচারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ মানুষ দিনে দিনে সারেন, এটা ব্রিটিশ আমল থেকে হয়ে আসছে কিন্তু এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে বোয়ালখালীর অধিবাসীদের কষ্ট কিভাবে আঞ্চলিক অর্থনীতি তথা একটি বিশেষ উপজেলার মানুষের জীবনকে ভোগান্তিতে ফেলছে তা বলার মতো নয়। দোহাজারীÑকক্সবাজার রেলপথের কাজ এগিয়ে চলেছে অথচ যে সেতুটির ওপর দিয়ে ট্রেন যাবে সেই সেতুটির জীর্ণদশা এখনো কাটলো না। এখন কর্ণফুলীর ওপর রেল সেতু কাম সড়ক সেতু কাজ দ্রুত শুরু করা না গেলে জাতীয় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প দোহাজারী কক্সবাজার সেতুটি কিভাবে পুর্ণোদ্যমে চালু হবে? বোয়ালখালীর মানুষ সুদূর অতীত থেকেই কর্ণফুলী নদীকে আশ্রয় করে যোগাযোগ, ব্যবসাÑবাণিজ্য গড়ে তুলেছে। বোয়ালখালী তথা চট্টগ্রামের মানুষকে পুষ্ট করেছে এই নদী। ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশ অংশে প্রায় দুইশ পঁচাত্তর কি.মি. পথ পেরিয়ে আঁকাবাঁকাভাবে বোয়ালখালীর পাশ দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে কর্ণফুলী নদী। এই নদী আমাদের শৈশবের নদী। বোয়ালখালী তথা দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান জেলার মানুষের জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে মিশে আছে কর্ণফুলী। অতি নিবিড়ভাবে ও সংগোপনে। সাম্পানের “ক্যা কোরত” শব্দে, কখনো প্রবল ¯্রােতে, কখনো মায়াবী ঢেউয়ে, বন্দরের জাহাজের শিকল ঘেঁষে এগিয়ে চলা, এসব আমাদের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার ছিল। ‘লুসাই পাহাড় উত্তুন নামিয়েরে যারগুই কর্ণফুলী’ এইরকম আবেগতাড়িত গান জড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় কর্ণফুলীকে নিয়ে। কর্ণফুলী কখনোই হোয়াংহোর মত সর্বনাশা ছিল না। বরং এর দুকূলের মানুষকে দুহাত ভরে দিয়েছে এই নদী। তাদের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রাকে বদলে দিয়েছে। অনেকের ভাগ্যের চাবিকাঠি ঘুরিয়ে দিয়েছে। কর্ণফুলীর দুই তীরের প্রাকৃতিক দৃশ্য এক কথায় অসাধারণ। কর্ণফুলীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত চট্টগ্রাম শহর, বন্দর, সার কারখানা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেরিন একাডেমি, বিমানবন্দর সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এই কর্ণফুলীর ওপর নির্ভর করে আছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাখো মানুষ।
কিন্তু অবহেলিত রয়ে গেছে কর্ণফুলীর তীরবর্তী উপজেলার বোয়ালখালীবাসী। এই যেন দেশের ভেতর এক অন্য দ্বীপ। ইংরেজ শাসনামলে প্রথম বিশ^যুদ্ধের সময় ১৯৩০ সালে বার্মা ফ্রন্টের সেনা পরিচালনায় কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল চলাচলের উপযোগী করে আপদকালীন কালুরঘাট সেতু নির্মিত হয়। দুই অ্যাবটমেন্ট, ছয় ব্রিক পিলার, ১২টি স্টিল পিলার ও ১৯টি স্প্যানের সমন্বয়ে নির্মিত ৭০০ গজ লম্বা এ সেতু উদ্বোধন করা হয় ১৯৩০ সালের ৪ঠা জুন। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে রেল লাইনসহ সড়ক সেতুতে রূপান্তর করে একমুখী যানচলাচলের উপযোগী করা হয়। নদীপথ ও রেলপথের সাথে সড়কপথেও যোগাযোগের সংযোগ স্থাপিত হয় দুকূলের। কিন্তু কালের বিবর্তনে ঐতিহাসিক এ সেতু জরাজীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঙালির ইতিহাসের সাক্ষী এ সেতুতেই কেটে গেল স্বাধীনতার ৫০ বছর। বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে ৯০ বছরের বার্ধক্য কুরে কুরে খাচ্ছে সেতুটিকে। বয়সের ভারে আজ এ সেতু এখন আর ভার সইতে পারছে না। বাস্তবতা বিবেচনায় এ সেতু যেন বোয়ালখালীবাসীর জন্য বিষফোঁড়া। এই ফোঁড়া যেন ধীরে ধীরে ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। সেতু প্রতিষ্ঠার আগে মানুষ সাম্পান দিয়ে নগরে যাতায়াত করত। কর্ণফুলী নদীর গতি-প্রকৃতি বিবেচনায় নৌপথে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন অনেক নিরাপদ, সুবিধাজনক ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। মানুষ কি তাহলে সেই যুগেই ভালো ছিল? আধুনিকতার স্পর্শ ‘কালুরঘাট সেতু’ কি আমরা বোয়ালখালীবাসীর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো? এই জরাজীর্ণ সেতুই কি আরেকটি নতুন সেতু তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা?
চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণকেন্দ্র নিউমার্কেট থেকে বোয়ালখালী সদরের দূরত্ব ১০-১২ কি.মি.। ৪৫ মিনিটে পৌঁছানো সম্ভব এই দূরত্বে পৌঁছাতে বোয়ালখালীবাসীর সময় লাগে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা, যে সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব। নিউমার্কেট থেকে চট্টগ্রামের শেষ প্রান্তের উপজেলা বাঁশখালী সদরের দূরত্ব ৪৬ কি.মি.। শাহ আমানত সেতু ধরে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগে মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা। ১২৬ বর্গ কি: মি: আয়তনের এই উপজেলা ১টি পৌরসভা ও ৮ টি ইউনিয়ন (পূর্ব গোমদন্ডীর সম্পূর্ণ অংশ বর্তমানে বোয়ালখালী পৌরসভা ও পশ্চিম গোমদন্ডী ইউনিয়নের প্রশাসনিক কার্যক্রম চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কর্ণফুলী থানার আওতাধীন) নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ২৮৫ নং আসন চট্টগ্রাম-৮ আসনটি চট্টগ্রাম সিটির ৩ নং পাঁচলাইশ, ৪ নং চান্দগাঁও, ৫ নং মোহরা, ৬ নং পূর্ব ষোলশহর ও ৭ নং পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড, বোয়ালখালী পৌরসভা ও উপজেলার শ্রীপুর খরনদ্বীপ ইউনিয়ন ছাড়া বাকি সব ইউনিয়ন নিয়ে এই সংসদীয় এলাকা।
বোয়ালখালী উপজেলার ইউনিয়ন শ্রীপুর- খরনদ্বীপ এলাকার বাসিন্দারা চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) সংসদীয় আসনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। ৩টি সংসদীয় এলাকায় বিভক্ত হওয়াই কি বোয়ালখালীবাসীর বিড়ম্বনার কারণ?
২০০১ সালে এই সেতুকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ২০১১ সালে চুয়েট গবেষকরাও এটিকে পুনরায় ঝুঁকিপূর্ণ সেতু হিসেবে ঘোষণা দেয়। কিন্তু হাস্যকর ব্যাপার হলো ঝুঁকিপূর্ণ এই সেতু ইজারা দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ। আবার সেতুর পূর্বপাশে দুটি সাইনবোর্ড টানানো আছে। একটিতে লেখা ‘১০ টনের অধিক মালামাল পরিবহন নিষেধ’, অপরটিতে লেখা আছে, ‘এই সেতুর উপর দিয়ে সাধারণ মানুষের চলাচল নিষেধ।’ ‘আদেশ অমান্যকারীকে ফৌজদারিতে সোপর্দ করা হবে।’ প্রতি বছর ইজারা দিয়ে ভালোই আয় হয় রাষ্ট্রের। তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু তৈরি হওয়ার আগে পর্যন্ত দূরপাল্লার বাসসমূহ বান্দরবান ও কক্সবাজার যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল এই সেতু। এখনো শাহ আমানত সেতু সড়কের বিকল্প পথ হিসেবে ব্যবহার করা হয় আরাকান রোড ও কালুরঘাট সেতু। টানা তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য প্রয়াত মঈন উদ্দিন খান বাদল বারবার একটি নতুন সড়ক সেতুর দাবি তুলে বক্তব্য রেখেছেন জাতীয় সংসদে।
৭ ই অক্টোবর ২০২০ সালে রেলমন্ত্রী কালুরঘাট সেতু পরিদর্শনে এসে বলেন। “দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থায়নে ২০২১ ইং সালের জানুয়ারি-মার্চের মধ্যে সেতুর দৃশ্যমান কাজ শুরু হবে। নকশা সংক্রান্ত জটিলতায় সেতুর কাজ শুরুতে বিঘœ ঘটে। সেতুর কাজ শুরু করে ২০২২ সালের মধ্যে যাতে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করা যায় সে চেষ্টা আমরা করব।” এই কথা শুনে বোয়ালখালীবাসী আশায় বুক বাঁধল। এই কার্যক্রমে নবনির্বাচিত মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব মোছলেম উদ্দিন আহমেদের আন্তরিক তৎপরতা ও প্রচেষ্টা খুবই প্রশংসার দাবি রাখে। মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। কর্ণফুলী নদীর উপর কালুরঘাট প্রান্তে একটি সড়ক সেতু হবে এই স্বপ্ন বাস্তবতার মুখ দেখবে এই আশায় বুক বেঁধে আছে বোয়ালখালীবাসী। কোন জটিলতায় আটকে যাবে না সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়া।
উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। বোয়ালখালী কেন এই মহাসড়কে উঠবে না? ১২.২ মিটার উচ্চতায় কালুরঘাটে নতুন রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণ করতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার কোটি টাকা। সেতুটির নকশা পরিবর্তন করে বর্ধিত টাকা অর্থায়নে সম্মতি চেয়ে দক্ষিণ কোরিয় দাতা সংস্থা ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড কর্তৃপক্ষের নিকট চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই চিঠির উত্তর ইতিবাচক কিনা সে বিষয়ে দেশের জনগণ অবগত নয়।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়, নতুন নকশায় বর্ধিত অর্থায়নে দক্ষিণ কোরিয় দাতা সংস্থা যদি রাজি না হয় তবে কেমন হবে সেতু নির্মাণের ভবিষ্যৎ? আবার কি আটকে যাবে বোয়ালখালীর স্বপ্ন? অর্থায়নের জন্য দাতা খোঁজার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় কি চাপা পড়ে যাবে আমজনতার স্বপ্ন? নাকি বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করবে?
লেখক : কলামিস্ট