কার্যাদেশ বাড়ছে : সুদিন ফেরার আশা

ফাইল ছবি

শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »
দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত হিসেবে পোশাকশিল্প খ্যাতির সঙ্গে সুনাম অর্জন করেছে বিশ্ববাজারে। কিন্তু করোনা মহামারির পর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক মন্দায় সংকটে পড়ে যায় এ শিল্প। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য খরচ বেড়েছে পরিবহন ও মজুরি খাতে। এ সংকট মোকাবেলা করে টিকে থাকা পোশাক কারখানায় বায়ারদের আনাগোনায় এ খাতে সুদিন ফেরার আশা করছে ব্যবসায়ীরা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারিত হয় ৬ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। আর অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আয় এসেছে ২ হাজার ৮৩৬ কোটি ডলার। কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণে চলতি মাসসহ আগামী পাঁচ মাসে অর্জন করতে হবে ৩ হাজার ৩৬৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ প্রতিমাসে ৬৭২ দশমিক ৮ কোটি ডলারের লক্ষ্যপূরণ করতে হবে। গত এক বছরে তৈরি পোশাকের দোকানগুলোতে বিক্রি ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এ বিক্রি ২০২৩ সালের জানুয়ারির মাসিক ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে নভেম্বরে ২১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন দোকানগুলোতে মাসিক বিক্রি হয়েছিল আনুমানিক ২৯ বিলিয়ন ডলার যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি। এ বিক্রির প্রবৃদ্ধি গড়ে তিন শতাংশ করে বাড়লেও চলতি মাস থেকে ৪ শতাংশ করে বাড়বে বলে জানিয়েছেন পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সদস্যরা জানান, ইউরোপ ও আমেরিকার মতো দেশগুলোতে অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে। এছাড়া অনলাইনে নতুন বাজার তৈরি হয়েছে। এসব দেশের পোশাক শিল্প খাতকে পুনরুজ্জীবিত করবে বলে আশা করছে ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি বিজিএমইএ-এর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসলের সহযোগিতায় ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) একটি গবেষণা করা হয়েছে।
এ গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন পোশাক বাজারের শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নে শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ ও আফ্রিকায় শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ পেতে পারে বাংলাদেশ। গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর কাছ থেকে কার্যাদেশ কম ছিল। যেহেতু কার্যাদেশ এখন বাড়ছে, আশা করা যায় আগামী এপ্রিল বা মে মাসের দিকে এটি আরও বাড়বে। রপ্তানি আগের মতো চাঙা হবে।
এ নিয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ-এর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। এ উন্নতির কারণে আমরাও আশা করছি, পোশাকশিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছি। পাশ্চাত্যে মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ায় এবং মানুষ খরচ করতে শুরু করায় আগামী মাসগুলোয় তৈরি পোশাকের চালান বাড়বে। এরমধ্যে নতুন ও পুরানো অনেক বায়ার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। তাদের গুদামে তৈরি পোশাকের স্বল্পতার কথাও আমাদের জানিয়েছে। তবে তারা যোগাযোগ বাড়ালেও কনফার্মেশন ও অর্ডার এখনও আমরা পাচ্ছি না।’
ক্রয়াদেশ বাড়াতে পোশাক মালিকরা কেমন কৌশল নিতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবহন ও মজুরি খাতে ব্যয় অনেকাংশে বেড়েছে। তাই আমরা যেমন কৌশল নিই না কেন কস্ট ম্যানেজমেন্ট (ব্যয় ব্যবস্থাপনা) ঠিক রাখতে হবে। সারাবিশ্বের খারাপ অবস্থার মধ্যে চীন তাদের শিল্প বরাবরের মতো টিকিয়ে রেখেছে। আমাদের মতো বা কাছাকাছি অবস্থায় রয়েছে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো কিছু দেশ। যেসব বায়ররা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, তারা ওইসব দেশেও খোঁজখবর নিচ্ছে। বাজার যেহেতু প্রতিযোগিতামূলক, তাই দর কষাকষিতেও প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা রাখতে হবে।’
দর ছাড়াও বায়ারদের বাংলাদেশের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে বিজিএমইএ-এর উদ্যোগ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পোশাক সরবরাহকারীরা কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রেও উন্নতি করেছে। পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের ফলে এই শিল্পখাত ও দেশের ভাবমূর্তি উভয়ই উজ্জ্বল হচ্ছে। কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব কারখানা ছাড়াও নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বেশ কাজ করা হয়েছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নতুন এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের এ পজিটিভ (ইতিবাচক) পরিবর্তনের কথা উঠে এসেছে। পাশাপাশি অনলাইন বাজার সৃষ্টি হওয়ায় সরাসরি ক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ নিয়েও কাজ করা হচ্ছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের জন্য ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নের কাজ চলছে।’
প্রসঙ্গত, ২৪ জানুয়ারি জেনেভায় আইএলও সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ‘পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধ এবং মোকাবিলা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য (ওএসএইচ) ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে শ্রম আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও মর্যাদা উন্নীত করতে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যনীতি ২০১৩ এবং গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ গঠন করেছে। শ্রম আইনের ১০৯ ধারা কর্মক্ষেত্রে নারীদের সুরক্ষা দিচ্ছে; যা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।