ওরা মুক্তিযোদ্ধা

জালাল উদ্দীন ইমন :

আমি বিছানার বাঁ পাশে। আর তানিয়াকে ডানপাশে শুইয়ে মা তার দুধপান করাচ্ছেন। তানিয়ার দিকে মুখ করে মা একটু হেলে পড়েছেন। আমার ঠিক ঘুম আসছে না। মা দুধ দেওয়ার পরও তানিয়ার কান্না বন্ধ হচ্ছে না। ক্লাস ফাইভে  উঠেছি দুমাস হলো। অনেক আগে থেকেই ইশকুল বন্ধ। বাইরে গেলে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া কোনো কথা শোনা যায় না। এখন দোকানপাটও বন্ধ। রাস্তায় বেরোলে আসতে-যেতে মিলিটারির জিপগাড়ির বুম বুম শব্দ। মা বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন।

মা বারবার বলে যাচ্ছেন, ‘দেশের অবস্থা ভালো না। পাকিস্তানিগো সাথে বাঙালিদের যুদ্ধ হইতেছে।’ আমি মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করলাম ‘মা, যুদ্ধ কী?’ জবাবে তিনি বললেন, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের সবকিছু জোর করে নিয়ে যায়। মানুষকে অকারণে গুলি মারে।  এসব যেন আর না হয়। সে জন্য বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ করতে বলেছেন পাকিস্তানিদের বিপক্ষে।

এভাবে মা বলতে লাগলেন অনেক কিছু। আমার একটু একটু ঘুম ধরে আসছে। ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু।  হঠাৎ বাইরে বুম বুম শব্দ। বেড়ার ফটকে আগুনের লাল আলো দেখা যায়। দাদিজান এসে বললেন, ‘পূর্বপাড়ায় মিলিটারিরা আগুন দিয়েছে। গতকাইল ওই পাড়ায় মুক্তিবাহিনী আইছিল। খবরটা মনে হয় মিলিটারির কানে গেছে।’  মানুষের কান্নার শব্দে তানিয়া নীরব হয়ে গেলো। ও তখনও ‘যুদ্ধ’ বুঝে না। হঠাৎ সে ভয়ে  দুধপান ছেড়ে দিল এবং মাকে জড়িয়ে ধরলো। যেন মায়ের  পেটেই ঢুকে যাবে। ওটাই যেন সবচে নিরাপদ।

দাদিজান আমাকে পাশে বসালেন এবং অভয় দিতে লাগলেন। আওয়াজটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। মনে হয় আমাদের বাড়ির দিকেই আসছে। মানুষের কান্নায় গুলির শব্দ মিশে গেছে। দাদিজান আমাদের চুপ থাকতে বললেন। কে যেন দরজায় লাথি মারলো।

দাদিজান কাঁপাকণ্ঠে বললেন, ‘মিলিটারি’! আবার লাথি পড়লো বেড়ায়। তৃতীয়বার, বড় গলায় একজন ডাকলেন, ‘ওই রফিকের মা দরজা খোল  বেটি। ‘মা নীচুস্বরে বললেন, বদু রাজাকার আইছে মনে হয়’। দাদিজান দরজা খোলার আগেই বদুসহ পাঁচজন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়লো দরজা ভেঙে। তারপর বলল,

কীরে তোমহারা লেরকা রফিকে মুক্তিবাহানী যাওয়ারে?’

দাদিজান উত্তর দিতে দেরি করলেন।  কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘রফিক শহরে গেছে তার বন্ধুর ওখানে। একটা চাকুরি দরকার বলে।’ বদু রাজাকার ধমকের স্বরে বলল, মার্কেট, দোকানপাট সব তো বন্ধ। রফিক চাকুরি কই পাইবে? তোম ঝুট বোলা।’ এভাবে অনেকক্ষণ জিজ্ঞাসা করার পর ঘরের জিনিসপত্র ভাঙতে শুরু করলো পিছনের লোকগুলো। তারপর হুমকি দিয়ে চলে গেলো।

রফিক আমার বাবার নাম। হয়তো কোনোভাবে বদু রাজাকার খবর  পেয়ে গিয়েছিল বাবা যুদ্ধে গিয়েছেন।

পরদিন সকালে মাকে ফাঁকি দিয়ে বাইরে গেলাম। গতরাতে কী হয়েছিল তা দেখতে। দেখতে পেলাম, কিছুই বাকি নেই। ইশকুলের বন্ধু শিপু-জগলুসহ অনেকের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। অনেকে পালিয়ে  গেছে। আবার অনেকে শেষ সম্বলটুকু নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে না।

শিপু বললো, সে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ জানে। ইশকুলের এক বড় ভাইয়ের কাছে জেনেছে। ওনার নাম, আজমল হোসাইন। আমরা আজমল ভাইয়া বলেই ডাকি।

শিপু একবার নাকি অনেকগুলো গোলা-বারুদও মুক্তিবাহিনীর নৌকায়  পৌঁছে দিয়েছিল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাহলে তো শিপুও একজন মুক্তিযোদ্ধা। আজ থেকে জগলুও যাচ্ছে। ওরা গোয়েন্দার কাজ করবে। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের খোঁজখবর ও চিঠিপত্র আনা-নেওয়া করবে। ওদের কথা শুনে আমারও যুদ্ধে যাবার ইচ্ছে জেগে উঠেছে। কিন্তু মা ও দাদিজান এতে কখনো রাজি হবেন না।

আজমল ভাইকে ওরা আমার কথা জানালো। কিন্তু তিনিও রাজি হচ্ছেন না। আমি চলে গেলে আমাদের পরিবারটা আরো খারাপ অবস্থায় পড়বে, এই আশংকায়। শিপু, জগলু, মাহিম সবার অনুরোধে তিনি ‘হ্যাঁ’ বললেন।

কিন্তু মা, দাদিজান? ওনাদের আগে রাজি করাতে হবে। বাড়িতে গিয়ে জানালাম, বাবা আমাকে একবার দেখতে চেয়েছেন৷ আজ রাতে  গোপনে তিনি দিঘিপাড়ে আসবেন। মা বিশ্বাস করতে চাইছেন না। তার ধারণা, আমি মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি৷ এটুকু ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যাবে দাদিজান  তো ভাবতেই পারেন না। বুকটা হু হু করে ওঠে। পরে মা কী যেন ভাবতে লাগলেন এবং হুট করে বললেন, হ্যাঁ, তোকেও যেতে হবে। এই যুদ্ধ সকলের। দেশটা স্বাধীন করবি তোরাও। বিদায়কালে দাদিজান বারান্দায় বসে কাঁদতে লাগলেন, তার আর কেউ রইলো না।

শিপু, জগলু, মাহিম আর আমি আজ এক দুঃসাহসিক অভিযানে যাবো। আর ফিরে নাও আসতে পারি। কোনো অস্ত্র নেই। এখন কেউ তো অস্ত্রও দেবে না আমাদের হাতে। শিপু বলে উঠলো, ‘অস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধ হবে।’

এই বলে সে রাতে আমাদের নিয়ে গেলো মিলিটারি ক্যাম্পে। সে কী! শিপু আমাদের সাথে বেঈমানি করলো। বন্ধু হয়ে শত্রুর খাঁচায় ভরে দিবে?  মাহিম একটু ভয় পেয়ে গেলো। মিলিটারিরা ক্যাম্পে ঘরঘর নাক  ডেকে ঘুমাচ্ছে।

শিপু মিলিটারির জিপ গাড়ি থেকে অস্ত্র নামিয়ে আনছে। ওর বুদ্ধিতে বাকিরা অবাক! এতটুকু ভয় নেই৷ অস্ত্র লুট করা শেষ। আজ আর অভিযান করা হলো না। তবে অস্ত্র ঠিকমতো জোগাড় হয়েছে এবং শিপু সবাইকে অস্ত্র চালানো শিখিয়ে দিলো। ব্যারেলে বারুদ ঢুকিয়ে রাখলাম।

অস্ত্র চুরির খবর কেউ জানে না। এমনকি মুক্তিযোদ্ধারাও। কারণ, এ বিশেষ অভিযানটা আমাদের চারজনের। দিন হলো। আজমল ভাইয়ার কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কথা, কাজ ও কৌশল জানলাম। সবশেষে তিনি জানালেন, আমার মাকে ‘বদু রাজাকার’ ধরে নিয়ে গেছে। বিশ্রীভাবে টানাহেঁচড়া করে। বদু আমাদের সম্পর্কে জানতে পেরে  গেছে।

আজমল ভাইয়াও জানেন না। আমরা চারবন্ধু আজকে বদু রাজাকারকেই মারতে যাচ্ছি। অতঃপর, রাতে আমরা বদু রাজাকারের বাড়িতে হানা দিলাম। প্রহরীদের গুলি করে মারলো শিপু, মাহিম, জগলু। আমার গুলি শুধু বদু রাজাকারের জন্য খরচ করবো বলে গোঁ ধরেছি। আমি আমার বন্দুকের সব বারুদ ওই রাজাকারের বুকেই মারবো। দরজা ভেঙে তার রুমে গিয়ে দেখলাম, সে খাটের  নিচে লুকিয়ে আছে। মাহিম আর শিপু বন্দুকের বাড়ি দিয়ে বের করে আনলো। উর্দু তো দূরের কথা, কোনো কথাই তার মুখে আসছে না।

সে আমার মাকে মিলিটারির হাতে তুলে দিয়েছে। এবার তাকে একটা একটা করে গুলি করে মারবো। তাকে না মারলে শান্তি পাবো না। ‘জয় বাংলা’ সেøাগান ধরলো জগলু। আমি গুলি চালিয়ে দিলাম। মারা গেলো একজন রাজাকার।

বদু রাজাকারকে মেরে চলে যাচ্ছিলাম আস্তানায়। পথে আমার মায়ের কাটাছেঁড়া লাশ। মিলিটারিরা ফেলে গেছে। মুহুর্তের মধ্যেই আমার  চোখটা ঝাপসা হয়ে গেলো। আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারছি না। শিপু সাহসীকণ্ঠে বললো, ‘কাঁদিস না, আমরাও এখন থেকে মুক্তিযোদ্ধা।’