উপশহর হচ্ছে জঙ্গল সলিমপুর

বদলে যাবে জীবনযাত্রা-অর্থনীতি

সুপ্রভাত ডেস্ক »

একসময়ে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত সীতাকু-ের জঙ্গল সলিমপুরে উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। সেখানে স্পোর্টস ভিলেজ থেকে শুরু করে হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালসহ কেন্দ্রীয় কারাগারের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠান জঙ্গল সলিমপুরে হলে চাপ কমবে শহরের ওপর। তৈরি হবে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে। সেইসঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যবদল হবে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘জঙ্গল সলিমপুরকে ঘিরে যে মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে এটি স্মার্ট সিটি কিংবা উপশহর হিসেবে গড়ে উঠবে। এখানে সরকারি অনেকগুলো অফিস ও ভবন হবে। এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে চট্টগ্রাম শহরে চাপ কমবে। চট্টগ্রামে উন্মুক্ত কোনও পার্ক নেই। সলিমপুরে ইকোপার্ক ও নাইট সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠার কথা চলছে। এখানে কারাগার হবে। যেটি হবে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার-২। এই কারাগার হলে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে বন্দির চাপ কমবে। সেইসঙ্গে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠার প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তবে এর আগে পুরো জমি সরকারের আয়ত্তে নিতে হবে। এরপর সার্ভে করে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে হবে।’ খবর বাংলা ট্রিবিউনের

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাহাড়বেষ্টিত সলিমপুরে গত তিন দশকে শতাধিক একর পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় হাজার হাজার বাড়িঘর। বিভিন্ন সমিতি ও ব্যক্তির নামে এসব পাহাড় কাটা হয়েছে। প্রভাবশালী মহল এসব পাহাড় কেটে ৩০০ টাকার নন–জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লাখ লাখ টাকায় জমির মালিকানা বিক্রি করছে।

স্থানীয়রা বলছেন, সলিমপুর ও আলীনগরে একসময় বহিরাগত কেউ প্রবেশ করতে পারতো না। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালাতে গিয়ে হামলার শিকার হতো। ওই এলাকায় বসবাসকারীদের নিজস্ব আইডিকার্ড আছে। যা সলিমপুরে প্রবেশ ও বের হওয়ার পাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে এটি এখন কিছুটা শিথিল হয়েছে।

সলিমপুরে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস। সভায় তিনি সলিমপুরে অবৈধভাবে পাহাড় কাটা ও সরকারি খাস জমি দখলের উৎসব বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেন। খাস জমি উদ্ধারের পাশাপাশি সলিমপুরে সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য কমাতে র‌্যাব-পুলিশকে নির্দেশ দেন তিনি।

জেলা প্রশাসনের কার্যালয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে জঙ্গল সলিমপুরের অবস্থান। এখানে পাঁচটি মৌজায় খাস জমির পরিমাণ তিন হাজার ১০০ একর। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ পাহাড় কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। সলিমপুরের পূর্ব ও উত্তরে রয়েছে চট্টগ্রাম সেনানিবাস ও বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর ও দক্ষিণে চট্টগ্রাম শহর। গত তিন-চার বছরে এখানে পাহাড়ধসে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত জঙ্গল সলিমপুরে ৪০০ একর পাহাড় কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসন জানায়, সলিমপুরে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে উচ্ছেদে গেলে বাধার মুখে পড়ে জেলা প্রশাসন। সেখানকার প্রভাবশালী দখলদাররা রাস্তায় নারীদের দিয়ে মানববন্ধন করিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সেখানে প্রবেশে বাধা দেয়। গত ১৪ মে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস সলিমপুর পরিদর্শনে গেলে নারীদের দিয়ে আবারও মানববন্ধন করানো হয়। গত ১৫ জুলাই জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা সলিমপুরে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে গেলে গাড়িবহর থেকে স্থানীয় ইউপি সদস্যকে নামিয়ে মারধর করা হয়। এ হামলায় নেতৃত্ব দেন সলিমপুরের স্বঘোষিত সম্রাট হিসেবে পরিচিত মো. ইয়াসীন। এ ঘটনায় ১৬ জুলাই সীতাকু- থানায় মামলা করা হয়। ১৮ জুলাই কোতোয়ালী থানার আদালত ভবন এলাকা থেকে ইয়াসীনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

এরই মধ্যে কয়েকদিন আগে জঙ্গল সলিমপুর এলাকা পরিদর্শন করেছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সলিমপুর এবং এর ভেতরে থাকা জঙ্গল লতিফপুরসহ আশপাশের সরকারি খাস জমি দখলে নিতে ১৫টি সমবায় সমিতির নামে হাউজিং সোসাইটি খোলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৩টি সমবায় সমিতি তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে জঙ্গল সলিমপুরে। সমিতিগুলো হলো আলী নগর ভূমিহীন সমবায় সমিতি, ছিন্নমূল বহুমুখী সমবায় সমিতি, একতা ভূমিহীন সমবায় সমিতি, নুর নবী শাহ হাউজিং সমবায় সমিতি, জঙ্গল সলিমপুর জনকল্যাণ কর্মজীবী সমবায় সমিতি, গোলপাহাড়া ভূমিহীন সমবায় সমিতি, আল মদিনা সমবায় সমিতি, মায়ের আঁচল সমবায় সমিতি, ভিত্তিহীন সমবায় সমিতি, চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল সংগ্রামী বস্তিবাসী সমন্বয় পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা হাউজিং সমবায় সমিতি, নবী নগর বহুমুখী সমবায় সমিতি এবং আলী নগর বহুমুখী সমবায় সমিতি। এসব সমিতির নামে চলছে সরকারি জমি দখল। পাহাড় কেটে প্লট বাণিজ্য। ইতোমধ্যে ১৫টি সমিতির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।

সমবায় সমিতি এবং বিভিন্ন ব্যক্তির নামে সলিমপুরে পাহাড় কাটায় জড়িতরা ৩০০ টাকার নন–জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সরকারি জমি দখল বিক্রি করে। ২০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত দখলকৃত জমি বিক্রি হচ্ছে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, ‘সীতাকু-ের জঙ্গল সলিমপুর নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাস্টারপ্ল্যান আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েটি সরকারি সংস্থা এখানে প্রতিষ্ঠান করার জন্য জমি চেয়ে আবেদন করেছে। যার মধ্যে আছে স্পোর্টস ভিলেজ, হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, সাফারি পার্ক, ইকোপার্কসহ বিনোদনকেন্দ্র, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, উচ্চক্ষমতার বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রশিক্ষণকেন্দ্র, কাস্টমস ডাম্পিং হাউজ, ভূমিহীনদের পুনর্বাসন, সবুজ শিল্প এলাকা, আনসার ভিডিপি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে। সেইসঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে।’