আজ অপরাজেয় নারী চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলোর জন্মদিন

হুমাইরা তাজরিন »

বিশ্বব্যাপী নারী চিত্রশিল্পীদের কথা স্মরণ করলে সবার আগে মনে পড়ে ফ্রিদা কাহলোর নাম। শারীরিক অসুস্থতা, সড়ক দুর্ঘটনা, ৩০ এর অধিক অস্ত্রোপচার এবং সর্বশেষ দুটো পা হারানোর পরও যাকে দমিয়ে রাখা যায়নি তিনিই ফ্রিদা কাহলো। আজ ৬ জুলাই তাঁর জন্মদিন।

ফ্রিদা কাহলো ডি রিভেরা মেক্সিকোর কাইয়কান অঞ্চলে বাবা গুইলেরমো এবং মা মাতিলদা ক্যালদেরন ই গঞ্জালেজ এর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ফ্রিদার বাবা ছিলেন একজন জার্মান ইহুদী বংশোদ্ভুত মেক্সিকান আলোকচিত্রী। চার ভাইবোনের মধ্যে ফ্রিদা ছিলেন তৃতীয়। শৈশবের বেশিরভাগ সময় ফ্রিদার কেটেছে ‘ লা কাসা আজুল’ বা ‘নীল ঘর’ ন্মক বাড়িটিতে। বাবার সাথে সখ্য বেশি হওয়ায় আলোকচিত্রের প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিলো ফ্রিদার। সেই সাথে বাবার বন্ধু প্রিন্টমেকার র্ফানান্দো র্ফানান্দেজের কাছ থেকে আঁকার হাতেখড়ি নেন। কিন্তু ৬ বছর বয়স থেকে তাঁর জীবনে প্রতিকূলতা দেখা দিতে শুরু করে। তিনি আক্রান্ত হন পোলিওতে যার ফলে তার ডান পা বাম পায়ের চেয়ে সরু হয়ে যায়।

তারপর কিছুবছর যেতে না যেতেই ১৯২৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রেমিক আলেজান্দ্রো গমেজ আরিয়াসের সাথে স্কুল থেকে ফেরার পথে একটি বাস দূর্ঘটনায় তিনি মারাত্বকভাবে আহত হন। সেই দুর্ঘটনায় ফ্রিদার পাজর ,পা এবং ঘাড়ের উপরের হাড় ভেঙে যায়। তিনি ২মাস হাসপাতালে অতিবাহিত করেন।

জানা যায়, তার ৩টি কশেরুকা নড়ে যায়। এই দুর্ঘটনার ফলে বাকি জীবন তাকে বেশ ভুগতে হয়। ১৯২৭ সালে কিছুটা সুস্থ হলে পুরোনো বন্ধুদের নিয়ে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন। যোগ দেন মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টিতে।

১৯২৮ সালে মোডোটির একটি পার্টিতে ফ্রিদার পরিচয় হয় মেক্সিকান ভাস্কর দিয়াগো রিভেরার সাথে। ১৯২৯ সালে পরিবারের অমতে বিয়ে করেন রিভেরাকে। বিয়ের সময় ফ্রিদার বয়স ছিলো ২২ বছর এবং দিয়াগো রিভেরার বয়স ছিলো ৪২ বছর। ফ্রিদা ছিলেন রিভেরার তৃতীয় স্ত্রী। ফ্রিদার সাথে রিভেরার ১৯৩০ সালে ফ্রিদার আঁকা ‘ফ্রিদা এন্ড দিয়াগো রিভেরা’। রিভেরার সাথে বিয়ের পর ফ্রিদা মেক্সিকান সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। যার ফলে তিনি তাঁর ছবিতে ব্যবহার করতেন উজ্জ্বল রং এবং নাটকীয় প্রতীকবাদ। পরিধান করতেন তিহুয়ানা পোশাক, ফুলের পাগড়ি, ঢোলা ব্লাউজ, স্বর্ণালংকার এবং দীর্ঘ স্কার্ট। বস্তুত সাজতে ভালোবাসতেন ফ্রিদা। তাঁর প্রতিকৃতিতে তাঁকে রঙিন প্রসাধনীতে সজ্জিত দেখা যায়। তবে তিনি তথাকথিত খুঁতগুলোকে আড়াল না করে তাঁর আত্মপ্রতিকৃতিতে সেগুলোকে করেছেন স্পষ্ট। ফলে ফ্রিদার কথা স্মরণ করলে তাঁর স্পষ্ট ঘন জোড়া ভ্রু যুগল এবং পুরুষালি গোঁফের ছবি মস্তিষ্কে সর্বপ্রথম ভেসে উঠে।

দুর্ঘটনা পরবর্তীতে ফ্রিদা প্রায় অসুস্থ থাকায় রিভেরার সাথে সম্পর্কে টানাপোড়ন শুরু হতে থাকে। বহুগামিতা, ফিদ্রার ছোটবানের সাথে রিভেরার সম্পর্ক এবং ফ্রিদার সাথে লিয়ন ত্রটস্কিসহ অনেক চিত্রশিল্পীর সম্পর্কের কারণে ১৯৩৯ সালে রিভেরার সাথে বিচ্ছেদ ঘটে। এসময় ফ্রিদা একা থাকতে পছন্দ করতেন। ‘দ্য টু ফ্রিদা’ ছবিতে নিজের দ্বৈত সত্তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন ফ্রিদা। যার একটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন রিভেরা।

শারীরিক অসুস্থতার কারণে মা হতে পারবেন না জেনেও তিনি বারবার অন্তঃসত্ত্বা হন এবং মা হতে ব্যর্থ হন। ‘হেনরি কোর্ড হসপিটাল’ নামের ১৯৩২ সালের ছবিতে তিনি অনুর্বর উষর ভূমি আঁকেন। একই বছর আঁকা ‘মাই বাথ’ ছবিতে তিনি নারীর সন্তান জন্মদানের চিত্র ফুটিয়ে তুলেন।

১৯৩৮ সালে ‘দ্য ফ্রেম’ ছবিটি ল্যুভর মিউজিয়াম কিনে নেয়। পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের প্রধান আঁদ্রে ব্রেটন প্রিদার কাজকে ‘রিবন অ্যারাউন্ড এ বোম্ব’ আখ্যায়িত করেন। কিন্তু ফ্রিদা সেই আখ্যা অস্বীকার করেন বলেন, ‘আমি পরাবাস্তবতার নয় আমার জীবন বাস্তবতার ছবিই একেঁছি’। ১৯৪০ সালে রিভেরা এবং ফ্রিদা পুনরায় একত্র হন। ১৯৪৬ সালে ফ্রিদার আঁকা ‘দ্যা ওয়ান্ডার ডিয়ারে’ দেখা যায় ৯টি তীরে বিদ্ধ এক হরিণীকে। যেখানে হরিণীর মুখাবয়ব চিত্রিত হয়েছে ফ্রিদার মুখের আদলে। জীবনের উপর্যুপরি আঘাতকে হয়তো এভাবেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন ফ্রিদা।

১৯৫০ সালের ফিদ্রা বেশিরভাগ সময় মেক্সিকান সিটি হাসপাতালে কাটিয়েছেন। সেখানে তাঁর মেরুদ-ের একটি হাঁড়ের গ্রাফ্ট সার্জারি হয়েছিলো। এসময় বেশিরভাগ সময় হুইল চেয়ারে বসে কাটান।

১৯৫৩ সালে তাঁর দুটো পা কেটে ফেলতে হয়। যার ফলে তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে তিনি দিনাতিপাত করেন। তবে বিছানায় শুয়ে তার মায়ের তৈরি খোঁপের মতো স্ট্যান্ডের সাহায্যে তিনি ছবি আঁকা অব্যাহত রাখেন। এ সময় তিনি আত্মপ্রতিকৃতিমূলক ছবিগুলোই বেশি একেঁছেন।

মারা যাওয়ার কয়েকদিন তিনি ডায়রিতে লেখেন, ‘আমি আশা করছি প্রস্থান আনন্দের হোক, আমি প্রত্যাবর্তনের আশা করছি না।’ জানা যায়, চিকিৎসকের দেওয়া নির্ধারিত ওষুধের দ্বিগুণ ওষুধ সেবনে ১৯৫৪ সালে ১৩ জুলাই ফ্রিদার মৃত্যু হয়।