অনাবাদি জমি চাষাবাদে প্রশাসনের উদ্যোগ

রাউজানে ভুয়া কৃষকই কৃষিঋণ পায়

শফিউল আলম, রাউজান »

রাউজান উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় একসময়ে শুষ্ক মৌসুমে বোরা ধান, বর্ষা মৌসুমে আমন ধান ও আউশ ধানের চাষাবাদ হতো প্রচুর। ফসলি জমির মালিকেরা তাদের জমিতে চাষাবাদ করতে গোয়ালঘরে গরু লালন-পালন করতো। কাঠের তৈরি লাঙল-জোয়ালে গরু দিয়ে জমি চষতো কৃষকেরা। জমির মালিক ছাড়াও এলাকার লোকজন যার বাড়তি জমি আছে সেই জমির মালিক থেকে জমি বর্গা নিয়ে চষাবাদ করতো।

শুষ্ক মৌসুমে রাউজানে বোরো ধানের চাষাবাদ করা ছাড়াও সবজিখেতের চাষাবাদ হতো বিপুল পরিমাণ জমিতে। কৃষকেরা ফসলি জমিতে চাষাবাদ করে জমি থেকে উৎপাদিত ধান ও সবজি নিজ পরিবারের জন্য রেখে অবশিষ্ট ফসল বা সবজি বাজারে বিক্রয় করে যে টাকা পেতো তা দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বছন্দ্যে জীবনযাপন করতো। কৃষকেরা জমিতে চাষ করে উৎপাদিত ফসল বাজারে বিক্রয় করে আয়ের টাকা দিয়ে তাদের ছেলে মেয়েদের ওলখাপড়াও করাতো। তবে আগের সেই জৌলুশ একন আর নেই। হারিয়ে গেছে কাঠের লাঙল-জোয়াল, বাঁশের মই। বের হয়েছে জমিতে চাষাবাদের জন্য পাওয়ারটিলার। এই যন্ত্রে জমিতে চাষা দিয়ে রোপণ করা হচ্ছে ধানচারা, বিভিন্ন জাতের সবজি। নেই আগের মতো বিপুল পরিমাণ জমির চাষাবাদ। জমির মালিক থেকে জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে ধান উৎপাদন করার পর জমির মালিককে ধান পরিশোধ করে পরিমান ধান থাকে ঐ ধানের বাজারমূল্য অনুসারে যে দাম পাওয়া যায় তা দিয়ে কৃষকের উৎপাদন খরচ ওঠে আসে না। জমিতে ধানখেতের চাষাবাদ করতে গিয়ে কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারাচাষাবাদ ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। ফলে রাউজানের বিভিন্ন এলাকায় ফসলি অথচ অনাবাদি জমির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সরকার কৃষকদের জমিতে চাষাবাদ করতে স্বল্পসুদে কৃষিঋণ দেওয়ার নিয়ম চালু করলেও কৃষকেরা কৃষিঋণ পেতে ব্যাংকে গেলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কৃষকের কাছে জমির দলিল চায়।

বর্গাজমি নিয়ে চাষাবাদকারী প্রকৃত কৃষকের কোন জমি না থাকায় কৃষিঋণ পায়নি বলে জানান কলমপতি এলাকার কৃষক সেলিম। রাউজানের বিভিন্ন এলাকায় কৃষিকার্ড বানিয়ে ব্যাংক থেকে কৃষিঋণ নিয়েছে যারা তাদের অধিকাংশই কৃষক নয়। তারা জমিতে কোনোদিন চাষাবাদ করে না। রাউজানে অনাবাদি ফসলি জমি চাষাবাদের আওতায় আনতে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এমপি উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর নির্দেশে অনাবাদি জমি চাষাবাদের আওতায় আনার জন্য মাঠে নেমেছে উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা কৃষি বিভাগ, কৃষক লীগ নেতৃবৃন্দ। গহিরা ইউনিয়নে অনাবাদি জমি চাষাবাদের আওতায় আনতে কৃষকদের সাথে মতবিনিময় সভা করেছে উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা কৃষিবিভাগ, কৃষক লীগ নেতৃবৃন্দ। কৃষকের সাথে মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন গহিরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আবছার বাঁশি।

মতবিনিময় সভায় কৃষক ও জমির মালিকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন রাউজান উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুস সামাদ শিকদার, রাউজান উপজেলা কৃষি অফিসার ইমরান হোসাইন, উপজেলা কৃষক লীগ সভাপতি পৌর কাউন্সিলর আলমগীর আলী, সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক চৌধুরী সুমন, রাউজান পৌর কৃষক লীগ সভাপতি আলী আজগর চৌধুরী। রাউজান উপজেলা কৃষি অফিসার ইমরান হোসাইন বলেন, এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এমপির নির্দেশে অনাবাদি জমি চাষাবাদের আওতায় আনতে কৃষক ও জমির মালিকদের সাথে মতবিনিময় করে তাদের সচেতন করা হচ্ছে। অনাবাদি জমি চাষাবাদের আওতায় আনতে কৃষকদের সকল প্রকার সহায়তা প্রদান করবে উপজেলা কৃষি বিভাগ। রাউজানে মোট ফসলি জমি রয়েছে ১৩ হাজার ৮ হেক্টর। তার মধ্যে আমন মৌসুমে ৮শ ৭৪ হেক্টর জমি অনবাদি রয়েছে। অবশিষ্ট জমিতে আমান চাষাবাদ করা হয়েছে। ১৩ হাজার ৮ হেক্টর ফসলি জমির মধ্যে বোরা ধানের চাষাবাদের মৌসুমে ৫ হাজার ৬৬ হেক্টর জমি অনাবাদি ছিল। আউশ মৌসুমে ১৩ হাজার ৮ হেক্টর ফসলি জমির মধ্যে ১০ হাজার ৩শ ২৪ হেক্টর জমি অনাবাদি থাকে। রাউজানে শুষ্ক মৌসুমসহ সারা বছরে ২ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজিখেতে চাষাবাদ করে কৃষকেরা। চাষাবাদের সাথে জড়িত নয় এমন অনেকে ভুয়া কৃষক সেজে কৃষিকার্ড বানিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় গুটিকয়েক ব্যক্তি। এ অবস্থায় অফনেক প্রকৃত কৃষক কৃষিঋণ পায়নি।

এ প্রসঙ্গে রাউজান উপজেলা কৃষি অফিসার ইমরান হোসাইন বলেন, আমার আসার আগে ভুয়া কৃষকেরা কৃষিকার্ড বানিয়ে গোপনে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সাথে আঁতাত করে কৃষিঋণ নিলেও নিতে পারে। আমি আসার পর থেকে কৃষি অফিসের উপসহকারী কৃষি অফিসার মাঠ থেকে প্রকৃত কৃষকের তালিকা করে আমার প্রত্যয়ন পত্র নিয়ে প্রতি মাসে একবার কৃষিঋণ প্রদান কমিটির সভা করে ব্যাংক ম্যানেজারদের নিয়ে। সভায় প্রকৃত কৃষকদের কৃি ঋণ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গোপনে কৃষিবিভাগকে না জানিয়ে কোনো ব্যক্তিকে কৃষিঋন বিতরণ করলে তার জন্য কৃষিবিভাগ দায়ী নয়। রাউজানের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এবং কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভুয়া কৃষক সেজে কৃষিকার্ড বানিয়ে কৃষিঋণ যারা নিয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই ঋণ পরিশোধ করেনি। খেলাপি কৃষিঋণ পরিশোধের মেয়াদ শেষ হলে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে গোপন আঁতাত করে পুনরায় নতুন করে কৃষিঋণ নিয়েছে বলে দেখানো হয় ।