বিজয়ের স্মৃতি

জিয়াউল করিম মাইনু :

 

 

সাইরেন বাজানোর পরপরই যুদ্ধবিমানগুলো যেন আমাদের মাথার ওপর বোমা ফেলে চলে গেল। লোকজন যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। যেন নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারলেই বাঁচে সবাই। বোমার বিকট শব্দে ঘরের দরজা-জানালাগুলো কেঁপে-কেঁপে উঠছে। তবুও সাহস করে জানালা দিয়ে দু-একবার আকাশে তাকিয়ে বোমারু বিমানগুলো দেখার চেষ্টা করছি। এক সাথে অনেকগুলো যুদ্ধবিমান যেন বাতাস ভেদ করে সেকেন্ডের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার দেখছি, বিমানগুলো খানিকটা জমিনের দিকে নেমে পেট থেকে এক সাথে কয়েকটা বোমা ফেলে  মুহূর্তেই দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে। ওগুলো চলে যাবার পর পাড়ার লোকজন মৃত্যুভয় জয় করে কোনটা শত্রুবাহিনীর আর কোনটা মিত্রবাহিনীর এ নিয়ে তর্কে লিপ্ত হলো। আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বাসার ছাদে ওঠে অন্যদের মতো আমিও বিমানযুদ্ধ দেখি। শুনতে পেলাম পাকিস্তানের আহ্বানে আমেরিকা সপ্তম নৌবহর পাঠাচ্ছে বাঙালিদের শায়েস্তা করতে।

ডিসেম্বরের ১২/১৩ তারিখ হবে। সকাল ১২টার দিকে আব্বা অফিস থেকে বাসায় ফিরেই সবাইকে তৈরি হতে বললেন। জানালেন আলকরনের বাসা ছেড়ে দাদা-দাদি, বড়ফুফু, মেজফুফুদের পরিবার আর দিলু ফুফু ও ছোট চাচ্চুসহ সদরঘাট রোডে হোটেল শাহজাহানের পেছনে একটা ভাড়া বাসায় উঠেছেন। সেখানে আমাদেরকেও আসতে বলা হয়েছে।  পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে। কোর্ট হিলের ওপর আলকরনের দিকে পাকিস্তানি আর্মি কামানবহর বসিয়েছে। ওরা নাকি ওখান থেকে কামানের গোলা নিক্ষেপ করে পুরো শহর নিশ্চিহ্ন করে দেবে। শুনতে পাচ্ছি, মিত্রবাহিনী যুদ্ধে যোগ দেবার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা দিশেহারা। দেশের বিভিন্ন যুদ্ধফ্রন্টে মুক্তিবাহিনীর সাথে সম্মুখসমরে পাকিস্তানি হানাদারদের বিপর্যয় ঘটছে। এদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা হামলায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। নিয়াজি হুংকার দিচ্ছে. বাঙালিদের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। মার্চের পর আবার শহরের লোকজন সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। তাই দাদা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আলকরন থেকে আপাতত সরে এসে কিছুদিন এদিকে নিরাপদ অবস্থানে থাকবেন। আব্বা আম্মাকে বুঝিয়ে আমাদের সবাইকে নিয়ে ছুটলেন নতুন গন্তব্যে। ওখানে গিয়ে দেখি, ঘরভর্তি মানুষ। ফুফুরা সবাই রান্নাঘরে ব্যস্ত। আম্মা এসে তাদের সাথে হাত লাগালেন। মুরুব্বিদের মধ্যে উৎকণ্ঠা থাকলেও কেমন যেন একটু স্বস্তির ভাবও ছিল। নানারকম কথাও শোনা যাচ্ছে। চারদিক থেকে বিজয়ের খবর আসছে। ছোট চাচ্চু চট্টগ্রাম কলেজের আইএসসি পরীক্ষার্থী। তিনি বললেন, রেডিওতে শোনা যাচ্ছে মুক্তিরা বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত করছে।

এসবের মাঝেই রাত গড়িয়ে  সকাল হলো। একটা বেবিট্যাক্সি  বাসার সামনে এসে দাঁড়াতেই অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করলাম, ট্যাক্সির সামনের গ্লাসের একাংশজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সাঁটা। আরেক পাশে একটা লম্বা শিকের ওপর উড়ছে সবুজের ওপর লাল পটভূমিতে বংলাদেশের পতাকা। ট্যাক্সি ড্রাইভার কাকে যেন বলছে, দেশ স্বাধীন  হইছে। ‘স্বাধীন হইছে’ কথাটার পুরোপুরি অর্থ বুঝতে আমার আরো ঘণ্টাখানেক সময় লাগলো। দৌড়ে বাসার ভেতরে ঢুকতেই দেখি, সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে রেডিও শুনছেন। সেখান  থেকে শোনা যাচ্ছে, ‘বাংলাদেশ ইজ ফ্রি, বাংলাদেশ ইজ ফ্রি’। ছোটচাচাকে বললাম, স্বাধীন হইছে মানে কি। তিনি বুঝিয়ে বললেন পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের কাছে পরাজিত হয়েছে।

আব্বা দুটো রিকশা ডেকে আমাদের নিয়ে বাসায় রওনা দিলেন। সদরঘাট রোডে এসে দেখলাম, অভূতপূর্ব এক দৃশ্য। পুরো রাস্তা তরুণ-যুবকদের পদচারণায় মুখরিত। সবার কাঁধে-হাতে অস্ত্র। রাইফেল আর স্টেনগান উঁচু করে তারা আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ছে। গুলির সাথে আগুনের ফুলকি। সবার মাথায় লম্বা চুল আর দাড়ি-গোঁফ। আব্বা বললেন, ওরাই মুক্তিযাদ্ধা, শহরে থেকে যুদ্ধ করেছিল। দারুণ পুলকিত হলাম। দু-একজন দেখলাম, আব্বাকে সালাম করলেন। আমাদের ভীষণ আনন্দ লাগছে। হুডখোলা একটা জিপে দুজন লোককে হাত-চোখ বেঁধে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, দেখলাম। আব্বার বললেন ওরা রাজাকার। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ওদের ধরে শাস্তি দিতে নিয়ে যাচ্ছে। একটা সেøাগানই শোনা যাচ্ছিল সর্বত্র ‘জয় বাংলা’। মাইকে গান বাজছে, ‘কোটি প্রাণ এক সাথে জেগেছে অন্ধরাতে/ নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়…।

এ গান তো শুনেছি যুদ্ধ চলাকালে! এখন আমার আর বুঝতে বাকি থাকলো না ‘দেশ স্বাধীন হইছে’ কথাটার মানে কি।