জলপাইপ্রেম

মোহাম্মদ নূরুজ্জামান :

‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই অনার্স পড়তে হবে’- অভিভাবকদের এমন কঠোর রায় মেনে নিয়ে ঘরকুনো আমি দেশের দক্ষিণ মেরুতে বনবাস গ্রহণ করি। একে তো সেশনজটে জর্জরিত বিশ্ববিদ্যালয়, তার ওপর এতিম কলা অনুষদের ছাত্র। কচ্ছপের মতো এক পা-দুপা করে এগিয়ে চলি। রয়েল সাবজেক্টের খরগোশরা যখন মাঝেমধ্যে চা স্টলে বিশ্রাম নিতে নিতে গল্প শোনায়, তখন পিনপতন মনোযোগে কান পেতে রই-

‘এক দেশে ছিল দুই বন্ধু- বাংলা ও ইতিহাস। তাহারা অনার্স মাস্টার্স করিয়া রাজ্যে রাজ্যে চাকুরি খুঁজিয়া খুঁজিয়া শেষ পর্যন্ত চিড়িয়াখানার বাঘ-সিংহ হইয়া জীবন কাটাইতে লাগিল।’

এমন গল্প শুনে গলা শুকিয়ে যাওয়া আমার বন্ধুটি আরো একবার কড়া মিষ্টি চা  খেয়ে চাঙা হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে টায়ের ধোঁয়া উড়িয়ে কবিতার চরণ মিলাই :

‘ভালোবাসা- সে তো চায়ের স্টলে হতাশার কথা শোনা,

ভালোবাসা- সে তো হৃদয় পোড়াতে সাদা-নীল ধোঁয়া টানা।’

আমাদের এই হতাশা দেখে দয়ালু হয়ে কিংবা হয়তো আর একবার চা-টা’র  লোভে রয়েলবন্ধুরা সাহস দেয় :

‘হেইম্যান, রাইজআপ। তোমাদের তো বিকালে প্র্যাকটিকেল নেই। ঐ সময়টাকে ইফেকটিভ এন্ড এনারজেটিক ব্যবহার কর- আইছ একা, হইবা দুকা, টাইমিং হলে তিনকা।’

তিন-এর নামতা পরে শিখা যাবে, আপাতত একে একে দুই হোক। দুপুরে ডাইনিং হলের স্বাস্থ্যবান ভাতের সাথে কাবাডি খেলে, ঝোলের সাগরে উঁকি  দেয়া মুরগির মাংসের পিচটার সাথে লুকোচুরি খেলা শেষ করে প্রতিদিন বেরিয়ে পড়ি। উদ্দেশ্যÑ  বিনা বেতনে একজন আত্মনিবেদিতকর্মী হিসেবে ছাত্রীহলগুলি পাহারা দেয়া। মাঝে-মধ্যে রাতের আঁধার ভেদ করে নচিকেতার  চেয়েও সুরেলা কণ্ঠে নীলাঞ্জনার গানও শোনাই। কিন্তু কী নির্মম অবহেলা! সমগ্র নারীজাতি মনে হয় যেন অন্ধ হয়ে গেছে- কানে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।

এমন অবস্থায় যদি বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়- কয়েকজন হৃদয়বান সহপাঠী যদি গরম-গরম চা-সিঙ্গারা খাওয়ানোর প্রস্তাব করে, তখন তো মনে হতেই পারে :

‘আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।’

হোক না দুটো ছোটখাটো সিঙ্গারা ও একটু চা। এটি তো আর যেখান সেখান  থেকে আনা নয়- একেবারে অন্দরমহল থেকে। বিনিময়ে ভদ্রতাটুকও দেখাতে হয়- সেই সুযোগে নিজেকেও একটু ঢোল পিটিয়ে নেয়া। নায়কোচিত স্টাইলে আমন্ত্রণ জানালাম- ‘তোমরা কী খেতে চাও? চাইলে সূর্যটাকে বেঁধে রেখে সেই আগুনে বারবিকিউ করে দেব- চাঁদটাকে ধরে এনে তন্দুরি বানিয়ে দেব।’

কিন্তু বুদ্ধিমতীরা ম্যানু নির্বাচন করতে গিয়ে সেসব চাপাবাজির ধারে-কাছেও  গেলো না। বরং বেশ সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়ে জানালো – ‘জলপাই খেতে চাই।’

তখন ছিল বর্ষাকাল। তাতে কী হয়েছে? জলপাই তো আর জলে ভেসে আসে না- গাছে ধরে। তাছাড়া, আমরা তো ম্যাজিশিয়ান নই যে, যখন-তখন জলপাই গাছে নাড়া দেব, পাতা না পড়ে টুপটুপ করে ফল পড়বে। খোঁজ নিয়ে জানলাম- জলপাই গাছের তখন রোমান্স চলছে, কিছুদিন পর বিবাহ, তারপর বাচ্চাকাচ্চা।

আমার তখন অবস্থা- ‘হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা।’ কিন্তু আমার বন্ধুটি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের শিষ্য। তার দীপ্ত উচ্চারণ : বন্ধু , ‘ম্যান মে বি  ডেস্ট্রেয়েড, বাট ক্যান নট বি ডিফিটেড।’

রণে ও… শক্তির চেয়ে বুদ্ধিও কম জয়ী নয়। দুই বন্ধু বুদ্ধির রাজ্যের পাহাড় পর্বত নদী-নালা, এমনকি খালবিলও চষে বেড়াচ্ছি। একটা বুদ্ধি চাই- শুধুমাত্র একবার। তারপর সারাজীবন বোকা হয়ে থাকতেও আপত্তি নেই। হঠাৎ করেই চিন্তার মেঘ কেটে রঙধনু উঁকি দিল। দুজনের মানিব্যাগ হাতড়ে শ দুয়েক টাকার নিশ্চয়তাও পেয়ে গেলাম। তারপর সরকারি ট্রেনে বাইশ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে অবশেষে হাতে এলো-

‘এক বয়াম জলপাই আচার।’

সান্ধ্যআইন ফাঁকি দিয়ে রাত দশটায় সেই গুপ্তধন রাজকন্যাদের দূর্গের ভিতর পাচারও করে দিলাম।

তারপর?

তারপর আর কি বলবো।

আমি কি জানতাম- টক জলপাই আচারেও কারো মিষ্টিমুখ হয়ে যাবে এবং তার হাতেই টক-ঝাল-মিষ্টি আচার খেয়ে যেতে হবে দিনের পর দিন!