হেফাজতে নাটকীয় মোড়

সালাহ উদ্দিন সায়েম:
হেফাজতে ইসলামে হঠাৎ নাটকীয় মোড় নিয়েছে। সংগঠনটির আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফি ও মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী বিরোধ ভুলে একাট্টা হয়ে গেছেন। তাঁদের ঐক্যের মধ্য দিয়ে হেফাজতের সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া থমকে গেছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির দায়িত্বশীল নেতারা ।
বুধবার সকালে হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসায় আহমদ শফি ও জুনায়েদ বাবুনগরীর মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করতে বৈঠকে বসেন মাদ্রাসার শীর্ষ আলেমরা।
জানা গেছে, এ বৈঠকে জুনায়েদ বাবুনগরী ও আহমদ শফির ছেলে হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষা সচিব আনাস মাদানী একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের তীর ছুঁড়েন। মাদ্রাসা ও হেফাজতের বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনায় উভয়ে একে অপরকে দায়ী করেন। মাদ্রাসার আলেমরা তাদের বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করেন। তবে বৈঠকটি অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়। এরপর সন্ধ্যায় আহমদ শফি, জুনায়েদ বাবুনগরী ও আনাস মাদানীর মধ্যে একটি বৈঠক হয়। এই বৈঠকে কেবল তারা তিনজনই অংশ নেন।
জানা গেছে, এই বৈঠকে আহমদ শফির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন জুনায়েদ বাবুনগরী।
হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা আহমদ দিদার কাসেমী সুপ্রভাতকে জানান, সকালের বৈঠকে জুনায়েদ বাবুনগরী ও আনাস মাদানী মাদ্রাসা ও হেফাজতের বিভিন্ন ঘটনায় একে অপরকে দোষারোপ করেন। তারা একে অপরের কাছে বিভিন্ন ঘটনার প্রমাণ চান। একপর্যায়ে অমীমাংসিতভাবে বৈঠকটি শেষ হয়। এরপর সন্ধ্যায় আল্লামা শফি, জুনায়েদ বাবুনগরী ও আনাস মাদানী পৃথক একটি বৈঠকে বসেন। এতে আল্লামা শফির কাছে ক্ষমা চান বাবুনগরী। তারা এখন এক হয়ে গেছেন।
গত ১৬ মে হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার মসজিদে জোহরের নামাজ শেষে হেফাজতের কয়েকজন নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীকে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ঘোষণার পর তাঁর সাথে আহমদ শফির দূরত্ব সৃষ্টি হয়। প্রকাশ্যে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন হেফাজতের নেতাকর্মীরা। পাঁচ বছর আগে হেফাজতের সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে আহমদ শফি ও বাবুনগরীর মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল।
এই পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার ফেসবুক পেজে লাইভে আসেন আহমদ শফি, জুনায়েদ বাবুনগরী ও আনাস মাদানী। লাইভে বক্তৃতায় জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, আমি ও আনাস মাদানী একই বাপের সন্তান। মাদ্রাসা ও ওলামাদের ভেতর শৃঙ্খলা রক্ষা ও ভুল বুঝাবুঝি নিরসনের লক্ষ্যে আমরা আজকে লাইভে এসেছি। এরপর তিনি তাঁর ও আহমদ শফির পক্ষে পৃথক দুটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করতে দেন আনাস মাদানীকে।
পৃথক সংক্ষিপ্ত লিখিত বক্তব্যে আহমদ শফি ও জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, আমাদের মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই। ফেসবুকে যারা আমাদের মধ্যে কাল্পনিক দূরত্ব সৃষ্টি করার পায়তারা সৃষ্টি করছেন তারা ভুল করছেন।
গত ১৭ জুন হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালকের পদ হারান বাবুনগরী। ওই দিন মাদ্রাসার মজলিশে শূরার বৈঠকে তাঁকে এ পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় আল্লামা শেখ আহমদকে। ওই বৈঠকে শেখ আহমদকে হেফাজতের আমির নির্বাচনের প্রস্তাব রেখেছিলেন আহমদ শফি। কিন্তু শূরা সদস্যরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
আল্লামা আহমদ শফির ছেলে আনাস মাদানী শূরার বৈঠকে গিয়ে বাবুনগরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন।
হাটহাজারী মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালক থেকে জুনায়েদ বাবুনগরীকে অব্যাহতি দেওয়ার পর হেফাজত নেতাকর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন রটে, বাবুনগরীকে হেফাজতের মহাসচিবের পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হবে। এতে আনাস মাদানী ও হেফাজতের দুই সহকারী যুগ্ম মহাসচিবের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন সংগঠনটির একাংশের নেতাকর্মীরা।
নতুন মহাসচিব পদে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ সলিমুল্লাহ ও সহকারী যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহর কথা আলোচনায় আসে।
এর মধ্যে গত ২ জুলাই আনাস মাদানীর সাথে হেফাজতের এক জনৈক কর্মীর একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। ওই ফোনালাপে আনাস মাদানী দাবি করেন, জুনায়েদ বাবুনগরী জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে সহিংসতার ঘটনা ঘটায়।
ওই ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর জুনায়েদ বাবুনগরী এক বিবৃতিতে বলেন, কোনো সময়ই জামায়াতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল না।
এই ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর কওমি মাদ্রাসা ও হেফাজতে অস্থিরতা দেখা দেয়। কওমি মাদ্রাসার ও হেফাজত নেতাকর্মীদের একাংশ ফেসবুকে আহমদ শফি ও তাঁর ছেলে আনাস মাদানীর কড়া সমালোচনা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আহমদ শফি ও জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারীরা মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, হেফাজতের কমিটি পুনর্গঠনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল আহমদ শফি ও বাবুনগরীর ঐক্যের মধ্যে দিয়ে তা থেমে গেছে। শুধু কওমি মাদ্রাসার আলেমরা নন, হেফাজতের শুভাকাক্সক্ষী আরো যারা আছেন তারাও এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংগঠনটির আমির ও মহাসচিবের ঐক্য চেয়েছেন। অন্যথায় কওমি মাদ্রাসাগুলোতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠিত হয়েছিল কওমি আক্বীদাপন্থি অরাজনৈতিক ইসলামী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার প্রধান পরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে হেফাজতের আত্মপ্রকাশ হলেও সংগঠনটি দেশজুড়ে আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে ১৩ দফা দাবিতে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।