হুমায়ূন আহমেদ : কথাসাহিত্যের আকাশে ভিন্ন তারা

আহমেদ মনসুর »

‘যদি মন কাঁদে/ তুমি চলে এসো…/ চলে এসো…/ এক বরষায়…’ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ মন থেকে চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুটা যেন চাঁদনি পসর রাতে হয়। একটি গানের কথায় তিনি তা অত্যন্ত করুণস্বরে ব্যক্তও করেছিলেন। কিšুÍ তা হয়নি। তিনি দেহত্যাগ করেছিলেন ঘোর বর্ষায়। বর্ষা নিয়েও তাঁর একটি খুব জনপ্রিয় গান আছে। লেখার শীর্ষভাগে উল্লিখিত কথাগুলো বর্ষা নিয়ে লেখা তাঁর জনপ্রিয় গানটিরই অংশবিশেষ। গানটি এখনও মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। হুমায়ূন আহমেদ কবি কিংবা গীতিকার ছিলেন না। তিনি ছিলেন সফল কথাশিল্পী। বাংলা ভাষার কথাসাহিত্যে তিনি নতুন একটি ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। যা নাড়া দিতে পেরেছিল মধ্যবিত্ত চিত্তকে আর বিশেষ করে তরুণপ্রজন্মকে।

মানুষের মুখের কথাকে তিনি গল্পের ভাষায় ব্যবহার করে সাহিত্যে নতুন একটি মাত্রা যোগ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন শুধু নয়, বর্ষাবিলাস, বৃষ্টিবিলাস, জোছনাবিলাস, সমুদ্রবিলাস এসবের মাধ্যমে তরুণপ্রজন্মকে ভাবুক আর প্রেমিকপ্রজন্মে পরিণত করেছিলেন। একধরনের মোহে আচ্ছন্ন করার মতো অলৌকিক গুণ ছিল তাঁর রচনায়।

কবি কিংবা গীতিকার না-হলেও তিনি অনেকগুলো গান রচনা করেছেন বিভিন্ন সময়ে তাঁর নাটকের প্রয়োজনে কিংবা নিতান্ত শখের বশে। তারপরও ওই গানগুলোকে কোনোভাবে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। যেকটি গান তিনি লিখেছেন নানা সময়ে ওগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সাহিত্যরচনার পাশাপাশি তিনি নাটক ও সিনেমা বানাতেন। সেসব নাটক-সিনেমার প্রয়োজনেই মূলত তিনি গানরচনা করতেন।

ঘুমায়ূ আহমেদ-এর সাহিত্যের ভাষা অত্যন্ত সরল আর সাবলীল। বাঙালির মুখের ভাষাকে তিনি অত্যন্ত যত্নসহকারে সাহিত্যে ব্যবহার করেছিলেন। শুরুর দিকে যদিও সেটাকে সাহিত্যবোদ্ধারা ভালোভাবে নিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল মহাত্মা আহমদ ছফার আন্তরিক প্রচেষ্টায় হুমায়ূ আহমেদ-এর নতুনধারার সাহিত্য সুধীসমাজে স্থান পায়। সেই থেকে তাঁর সাহিত্যচর্চা আর থেমে থাকেনি। এক কথায় দুই হাতেই তিনি সাহিত্যরচনা করেছেন।

সাহিত্যসৃষ্টির মাধ্যমে এদেশে যশ-খ্যাতি অর্জন করা গেলেও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায় না। এটাকে পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে নেয়া যায় না। ঝুঁকি থেকেই যায়। তারপরও সেই ঝুঁকিকে আবাহন করে সাহিত্যকার্যকে হুমায়ূন আহমেদ পেশা হিসেবে গ্রহণ করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মতো পেশাকে ত্যাগ করে তিনি সাহিত্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। একমাত্র হুমায়ূন আহমেদ-এর পক্ষেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। এটা আর করো পক্ষে সম্ভব নয়। আত্মজীবনীমূলক কোনো একটি উপন্যাসে তিনি লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার মানে চিৎকারক, আর সাহিত্যিকের জীবন কুকুরের জীবন, আমি চিৎকারকের পেশা ছেড়ে দিয়ে স্বচ্ছন্দে কুকুরের জীবন গ্রহণ করেছি। হুমায়ূন আহমেদ-এর সেন্স অব হিউমায় ছিল অত্যন্ত উঁচুমানের। যেকোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে তিনি মজা করতে পারতেন সহজেই। এটা ছিল তাঁর অসংখ্য গুণাবলির একটি। তাঁর খুব সহজাত গুণ। মৃত্যুর মতো কঠিন একটি বিষয় নিয়েও তিনি মজা করতে ছাড়েননি।

হুমায়ূন আহমেদ অত্যন্ত আয়েশ করেই লিখতেন। জলচৌকিতে প্রতিদিন নিয়ম করে তিনি লিখতে বসতেন। অল্প কতদূর লিখে তিনি উঠে দীর্ঘক্ষণ ধরে হাঁটতেন আর ভাবতেন। তারপর আবার লিখতে বসতেন। একবার তাঁর ছেলে তাঁকে বলেছিল, বাবা, আমি কখনো লেখক হবো না। কারণ হিসেবে বলেছিল লিখতে হলে যে হাঁটতে হয়, অত হাঁটাহাঁটি আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বাবাকে দেখে তাঁর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল লেখালেখি মানেই হন্টনকর্ম। হুমায়ূন আহমেদ তাই লেখালেখিকে হন্টনকর্ম বলে অ্যখ্যায়িত করেছিলেন।

এ থেকে বলা যায়, হুমায়ূন আহমেদ একজন পুরোদ¯ুÍর লেখক ছিলেন। লেখালেখির পুরোপুরি আবহ তৈরি করার মানসেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন নুহাশপল্লী। সেখানে বসে তিনি টানা লিখতেন আর জোছনা উদযাপন করতেন। নাটকের শ্যুটিং করার কাজেও তিনি নুহাশপল্লীকে ব্যবহার করতেন। সাহিত্যিক জীবনে নুহাশপল্লী তাঁর অনন্য একটা কর্ম। যেখানে তিনি এখন শুয়ে আছেন চিরনিদ্রায়।

ঘুমায়ূন আহমেদ একটা সময় খুব সিগারেট খেতেন। যদিও একটা পর্যায়ে এসে তাঁকে সেটা ছেড়ে দিতে হয়। এ নিয়ে তিনি এক জায়গায় লেখেন, তাড়াতাড়ি মারা যাবো এ ভয়ে নয়, আমি সিগারেট ছেড়েছি আমার শিশুপুত্রদের কথা ভেবে। মৃৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। পরে যদিও ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তাঁর পক্ষে আর সিগারেট খাওয়া সম্ভব ছিল না।

ঘুমায়ূন আহমেদ গল্প-উপন্যাস লেখার পাশাপাশি আরও একটি কাজ অত্যন্ত যত্ন নিয়ে করতেন। আর সেটি হলো নিভৃতে ছবি আঁকা। শিল্পের এই শাখাটিতে তিনি বিচরণ করেছিলেন বীরদর্পে। জীবদ্দশায় অনেকগুলো ছবি এঁকেছিনে এবং সেগুলো নিয়ে প্রদর্শনীও হয়েছিল।

ঘুমায়ূন আহমেদ-এর সাহিত্য নিয়ে নানামুখী সমালোচনাও আছে। সাহিত্য সমালোচকদের দৃষ্টিতে তাঁর রচনাগুলো অগভীর আর শিল্পশৈলীতে সমৃদ্ধ নয়। তবে পাঠকসৃষ্টিতে তাঁর যে বিশাল অবদান, তা স্বীকার করেন সকলেই। বিশেষ করে তরুণপ্রজন্মকে বইমুখী করার ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে বিশেষ ভূমিকা।

ঘুমায়ূণ আহমেদ-এর পরিবারটি ছিল আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাঁর বাবা মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ। রত্নাগর্ভা মা আয়শা ফয়েজও একটি বই রচনা করেছিলেন। তাঁর তিন সন্তান। তিন জনই প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদ-এর যেভাবে রয়েছে সাহিত্যখ্যাতি, তেমনি মেজছেলে মুহম্মদ জাফর ইকবালও বিখ্যাত একজন লেখক আর ছোট ভাই আহসান হাবীবও একজন প্রথিতযশা কার্টুনিস্ট এবং রম্যলেখক। আয়শা ফয়েজের বইতে মহাত্মা আহমদ ছফার সাথে তাঁর পরিবারের যে সম্পর্ক তা উল্লেখ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবার হিসেবে বসবাসের জন্য সরকারি যে বাসস্থানটি বরাদ্দ পেয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ-এর পরিবার মুক্তিযুদ্ধের অববহিত পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে নবগঠিত রক্ষিবাহিনীর জন্য ওই বাসস্থানটি একোয়ার করে তাঁদের বাসাটি ছেড়ে দিতে বলা হলে মহাত্মা আহমদ ছফা এ নির্দেশের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ করেন। গায়ে কেরোসিন ঢেলে শহীদ মিনারের পাদদেশে নিজেকে পুড়িয়ে মারবেন, ছফা এমন ঘোষণা দিলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা আমলে নেন আর হুমায়ূন আহমেদ-এর পরিবারকে ওই বাসা আর ছেড়ে যেতে হয়নি।

‘হিমু’ আর ‘মিশির আলী’ হুমায়ুন আহমেদ-এর সৃষ্ট দু’টি উল্লেখযোগ্য চরিত্র। চরিত্র দুটির মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর মনের কোণে জমা হওয়া কল্পনাগুলোকে প্রকাশ করেছেন। এই চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকেই প্রকাশ করতেন বলে মাঝেমাঝে পাঠকের ভ্রম হতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে তিনি ভিন্ন মত দিয়েছেন। সমাজ থেকে লব্ধ জ্ঞান আর আপন কল্পনার সংমিশ্রণে যা কিছু ব্যতিক্রমী ভাবনা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খায় তাই তিনি সূক্ষ্ম রসবোধের মাধ্যমে চরিত্র দু’টির ভেতর দিয়ে ফুটিয়ে তুলতেন। পাঠক অনেক সময় নিজেদের খুঁজে পান এখানে। অনেক সময় চলে যান ভাবনার জগতে।

বাংলা সাহিত্যের আকাশে হুমায়ুন আহমেদ তারা হয়ে উদিত হবার পর থেকেই তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে অনেককেই এখন দেখা যায় দুকলম লেখার প্রেরণা পান। এর আগ পর্যন্ত মুখের কথা যে সাহিত্য হতে পারে তা কেউ ভাবতে পারত না। কাজেই জটিল আর গুরুগম্ভীর সাহিত্যরচনা কিংবা অধ্যয়নে অনেকেই এক পা এগুলে একধরনের ভয় থেকে তারা দু’পা পিছিয়ে যেতেন। সেই ধারণা হুমায়ূন আহমেদ ভেঙে দিলেন। সাহিত্যে তিনি যোগ করলেন নতুন দ্যোতনা। এর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন অনেকেই। এ থেকে বাঙালি অনেক ভালো মানের সাহিত্যিক না পেলেও কিছু পাঠক তো অন্তত পেয়েছে, যারা বইমুখী হলো। বইমেলার প্রতি কৌত’হলী হলো। যারা বই কেনে, পড়ে, উপহার দেয়, আলোচনা করে। তাও আমাদের জ্ঞানবিমুখ সমাজের জন্য কম কিসে?