হজ্ব ও কুরবানীর এ মাস

হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »

মহান ¯্রষ্টা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনই সমস্ত প্রশংসার একমাত্র মালিক, যে মালিকানা একচ্ছত্র, নিরঙ্কুশ। তিনি আমাদেরকে এবং সৃষ্টিজগতের সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন ও সবাইকে রিয্ক দিয়ে থাকেন। তাঁর পবিত্রতা, যিনি বান্দার বন্দেগী কবুল করার জন্য পবিত্রতার শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। আর হালাল’র সমার্থক শব্দ হিসাবে ‘ত্বায়্যিবাত’ শব্দের প্রয়োগ করেছেন পবিত্র কুরআনে। আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়। তিনি লাÑশরীক। তাঁর কোন সমকক্ষ নেই। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। এ কথার সাথে আরও স্বাক্ষ্য দেই যে, আমাদের কর্ণধার ও কা-ারী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁর রাসূল, যিনি আমাদেরকে ইবাদতের সঠিক তা’লীম দিয়েও ঋণী করেছেন।
মাহে যিলহজ্বের চাঁদ উদিত হয়েছে। হিজরী বর্ষের সর্বশেষ মাসটি আমাদের মাঝে সমাগত। এটি হজ্বের চূড়ান্ত মাস। হজ্বের কয়েকটি সুবিদিত মাসের মধ্যে এটিই মুখ্য। কারণ, এ মাসের নবম দিবস আরাফাতের দিন। যেদিন হজ্বের প্রধান আনুষ্ঠানিক পর্ব আরাফাতের ময়দানে বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে আগত মুমিন নরÑনারীর উপস্থিতিতে সম্মিলিত ফরযটি সম্পন্ন হয়। বাকি দু’ ফরয ইহ্রাম ও ত্বাওয়াফে যিয়ারাহ যার যার নিজস্ব দায়িত্বে নিজ পছন্দ ও অবকাশ অনুযায়ী আদায় করা যায়; কিন্তু ওকূফে আরাফার জন্য স্থান ও সময়কাল সুনির্দিষ্ট। শওয়াল ও যুলক’দ মাস হজ্বের ইহরাম নেওয়া যায় বলে ‘হজ্বের মাস’ বলা হয়। আর হজ্বের আনুষ্ঠানিক ও সমবেত হজ্বের ফরয এ মাসেই সম্পন্ন করা হয় বলে এর নাম যুলহজ্ব। মহান আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘ওয়াল ফাজরি, ওয়া লায়াÑলিন আশরিন, ওয়াশ্ শাফ্ই ওয়াল ওয়াত্রি’। অর্থাৎ ফজর বা প্রভাতের শপথ। আর শপথ দশ রাত্রির। জোড় ও বিজোড়’র শপথ। সুরায়ে ‘আল ফাজর’ নামের সুরাটির প্রথম চার আয়াতে পাঁচটি বিশেষ বিষয়ের শপথ করা হয়েছে। প্রভাত’র ক্ষণ, দশটি রাত, জোড় ও বিজোড় এবং সাধারণ রাত’র, যখন তা ধাবমান হয়। এরপর প্রজ্ঞাময় প্রভুর মন্তব্য, ‘এর মধ্যে জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য শপথ আছে’।
আল্লাহ্ তাআলার প্রতিটি উক্তিই সন্দেহাতীত সত্য, যাতে সংশয়ের লেশমাত্র নেই। পবিত্র কুরআনের প্রথমদিকে তিনি নিজেই তা বলে দিয়েছেন, ‘লাÑরাইবা ফীহি’। সন্দেহকারীদের বিরুদ্ধে মহান প্রভুর উদাত্ত চ্যালেঞ্জ চিরদিনের জন্য। তবে, শপথ কেন? এটা তাঁর শাশ্বত সত্যÑদীপ্তির দৃঢ়তা বুঝাবার জন্য বিশ্বাসীদের প্রত্যয়কে আরো ইস্পাতদৃঢ় করার জন্য, আর শপথের বস্তুগুলোর গুরুত্ব বুঝানোর জন্য। পাঁচ শপথকৃত বিষয়াদির মধ্যে প্রথমোক্ত দু’টিই আজকের আলোচ্য। অর্থাৎ প্রভাতের ক্ষণ এবং দশরাত্রি, যেগুলোর শপথ করলেন স্বয়ং ¯্রষ্টা রাব্বুল আলামীন। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞ তাফসীর প্রণেতাগণের বিবিধ মতামত আছে। ফজরের শপথের প্রসঙ্গে দু’টি মত। এক, প্রভাত মানে প্রত্যেক দিনের প্রভাত বা ভোর বেলা। সুবহে সাদিক দিনের এক বিশেষ মুহূর্ত। রাতের আঁধার বিদীর্ণ করে দিনে আলোর সূচনা, ঘুমন্ত পৃথিবীর মৃত্যুপুরী যেন সহসা জাগ্রত প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত হয়ে ওঠে, জেগে ওঠে নিদ্রামগ্ন পৃথিবী। বিশ্ব প্রকৃতিতে আনে অপূর্ব বিপ্লব! এ মতের পক্ষে যাঁরা, তাঁদের মধ্যে মাওলা আলী শেরে খোদা (রাদ্বি.) মুফাসসিরÑকুলÑ শ্রেষ্ঠ সায়্যিদুনা ইবনে আব্বাস ইবনে যুবাইর (রাদ্বি.) প্রমুখ’র নাম উল্লেখযোগ্য। হযরত কাতাদাহ্সহ অনেক সাহাবীÑতাবেয়ীর মতে এখানে বিশেষ দিনের প্রভাতকাল বুঝানো হয়েছে। বিশেষ দিন বলতে কারো মতে মুহাররমের প্রথম দিনের প্রভাত, যা চান্দ্র বর্ষের সূচনা করে। কারো মতে যিলহজ্বের প্রথম দিন, যার সাথে বিশেষ দশ রাত সংযুক্ত। কারো মতে ঈদুল আযহার প্রভাত’র কথাই বলা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে শপথ ব্যক্ত হয়েছে দশ রাতের। সেই দশরাত সম্পর্কেও আছে নানা মুনির নানা মত। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাদ্বি.), কাতাদাহ্ ও মুজাহিদ (রহ.) প্রমুখের মতে যিলহজ্বের প্রথম দশদিন। হযরত জাবের (রাদ্বি.) বর্ণনা করেন, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (দ.)ই তাফসীর করেছেন, এতে যিলহজ্বের প্রথম দশরাত বুঝানো হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রাদ্বি.) বলেন, আল্লাহ্ তাআলা হযরত মুসা (আ.)র তাওরাত গ্রহণের জন্য ত্রিশরাত অবস্থানের পর যে দশরাত অতিরিক্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাও ছিল যিলহজ্বের প্রথম দশরাত। এখানে সেই রাতগুলোর শপথই উদ্দিষ্ট। এক বর্ণনা মতে, এ দশরাতের ইবাদত শবে কদরের ইবাদতের সমতুল্য সওয়াব। তাফসীরে মাযহারীর এ বর্ণনা রাতগুলোর মহিমাকে আরো সমুজ্জ্বল করেছে।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, এ যিলহজ্ব মাসেই দশ তারিখে পালিত হয় পবিত্র কুরবানীর ঈদ। যা মুসলিম বিশ্বে ঈদুল আযহা নামে সমাদৃত। মুসলমানদের পবিত্র দু’টি আনন্দের দিন দুই ঈদের দিন। পহেলা শওয়াল ঈদুল ফিৎর এবং দশ যিলহজ্ব ঈদুল আদ্বহা’র দিন। এ দিনের কর্মসূচি ঈদের নামায আর কুরবানী করা। কুরবানী, নহ্র প্রভৃতি শব্দে কুরআন ও হাদীসে আল্লাহ্র পথে উৎসর্গের এ প্রক্রিয়ার কথা বর্ণিত। যেমন, পবিত্র কুরআনের সুরা মায়েদার ২৭ থেকে ৩১ আয়াতগুলোতে আদমÑহাওয়া (আ.)র দু’সন্তান হাবীল ও ক্বাÑবীলের ঘটনাসূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া ইতোপূর্বে সুরা আÑলে ইমরানের ১৮৩তম আয়াতে কুরবানীর প্রথার কথা উল্লেখ হয়েছে।
সুরা মায়েদাতে মহা প্রজ্ঞাবান আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আপনি তাদেরকে আদম’র পুত্রদ্বয়ের সত্য সংবাদ শোনায়ে দিন, যখন তারা উভয়ে নিজ নিজ কুরবানী (বা উৎসর্গের নযরানা) উপস্থাপন করেছিল। তখন তাঁদের একজনের কুরবানী কবুল হয়েছিল, অপরজনের কাছ হতে কবুল হয়নি। সে বলল, ‘আমি তো তোমাকে হত্যা করবোই’। অন্যজন বলল, আল্লাহ্ তো মুত্তাকী (খোদাভীরু) বান্দাদের পক্ষ থেকেই (কুরবানী) কবুল করেন। হাবীলÑকাবীল’র মধ্যেকার ঘটনা পৃথিবীতে প্রথম ভ্রাতৃঘাতি ঘটনা, প্রথম কুরবানী প্রথা, প্রথম হত্যাকা-, হিংসাÑবিদ্বেষ’র রক্তক্ষয়ী পরিণতি, কাকের মাধ্যমে মৃত দাফনের প্রথার উন্মেষÑইত্যাদির সূত্রপাত। ‘সুরা কাওসার’র দ্বিতীয় আয়াতে স্বীয় হাবীব (দ.)র প্রতি দয়াময় প্রভুর নির্দেশ, ‘ফাসাল্লি লিরাব্বিকা ওয়ানহার’, অর্থাৎ অতএব, আপনি নিজ পালনকর্তার জন্য নাযাম পড়–ন এবং কুরবানী করুন’। এখানে কুরবানীর অর্থে ‘নাহ্র’ শব্দ প্রয়োগ হয়েছে। এছাড়া এ অর্থে পবিত্র কুরআনে ‘নুসুক’, ‘মানসাক’ শব্দেরও প্রয়োগ রযেছে। (সুরা আনআমÑ১৬২, সুরা হাজ্বÑ৩৪ দ্র.) সুরা কাওসার’র আয়াতে এসেছে নাহ্র, যা বিশেষত উট যবাইয়ের জন্য কণ্ঠ ছেদন’র দ্বারা করা হয়। আরবীয় প্রথম হিসাবে শব্দটির প্রয়োগ হলেও তা কুরবানীর অর্থে প্রচলিত হয়। এ আয়াতের ভিত্তিতেই পবিত্র ঈদুল আদ্বহার নামায এবং কুরবানীর প্রথা প্রিয়নবীর উম্মতের মধ্যে প্রচলন ঘটে। এখানে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা অপরিহার্য। অর্থাৎ আগে নামায, অতঃপর কুরবানী।
হযরত ইবরাহীম (আ.) ‘খলীলুল্লাহ্’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ্র বন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন। আল্লাহ্র পবিত্র কুরআনে রয়েছে, আল্লাহ্ ইবরাহীমকে ‘খলীল’ বানিয়ে নিয়েছেন। তিনি সেই আল্লাহ্র প্রেমে অন্তরায় না হবার জন্য, তাঁর সন্তুষ্টিকে অবধারিত করতে, স্বদেশ ত্যাগ করেছেন, নমরূদের অগ্নিকু-ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, স্ত্রীÑপুত্রকে নির্বাসন দিয়েছেন। এমনকি তাঁর নির্দেশে প্রিয় সন্তান ইসমাঈল (আ.) কে কুরবানীও দিয়েছেন। তেমনিভাবে নবীপুত্র ইসমাঈল (আ.) যিনি নিজেও নবী, হাসিমুখে আত্মোৎসর্গের জন্য সম্মত হয়ে অসির নিচে স্বীয় সত্তা কুরবানী দিতে শুয়ে পড়েছেন। প্রসঙ্গটি সুরা আসসাÑফ্ফাত’র ১০২ থেকে ১১১ পর্যন্ত আয়াতগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। এখানেই আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নিঃসন্দেহে এটা এক স্পষ্ট পরীক্ষা, আমি তাঁর পরিবর্তে যবেহ্ করার জন্য মহান প্রাণি বদলা দিলাম। আমি তাঁর আদর্শের ওপর এ (কুরবানীর) বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি’। তাফসীরের গ্রন্থাদিতে আছে যে, ইসমাঈল (আ.)র পরিবর্তে যেসখানে এক বেহেশতী ভেড়া (বা দুম্বা) যবেহ্ হয়ে আছে। ইবরাহীম (আ.) তা কুরবানী করেছিলেন। সে সুন্নাত আমাদের নবীর শরীয়তেও প্রবর্তিত হয়।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন, ‘তোমরা পিতা ইবরাহীম’র মিল্লাতে কায়েম থেকো’। (২২:৭৮) আমাদের নবী হযরত ইসমাঈল (আ.)র বংশধারার একমাত্র নবী, তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ (রা.) কে ফিদইয়ার মাধ্যমে কুরবানী দেয়া হয়, তাই নবীজি বলেছেন, ‘আমি দুই যবীহ্’র পুত্র।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।