স্মরণ : জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী »

জহুর আহমদ চৌধুরীর বহু পরিচয় যেমন তিনি আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা, পথিকৃৎ শ্রমিক নেতা, ভাষাসৈনিক, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি (কমিশনার-চট্টগ্রাম পৌরসভা-৫২, এমএলএ/৫৪, এমপিএ/৭০, এমপি/৭৩), মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক (চেয়ারম্যান লিবারেশন কাউন্সিল-ইস্টার্ন জোন/ জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল, সাউথ ইস্ট জোন-২), বঙ্গবন্ধু’র মন্ত্রিসভার সদস্য; কিন্তু এসব পরিচয় একটি সূত্রে গাঁথা, সেটি হলো রাজনীতি। এটাই তাঁর আদি এবং অকৃত্রিম পরিচয়। রাজনীতির সূত্রেই তাঁর যত প্রাপ্তি।

তিনি একজন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ, অস্থি-মজ্জায়, অন্তরে-বাহিরে, আপাদমস্তক রাজনীতিক। তাঁর জীবনটাই যেন রাজনীতির ধাতুতে গড়া ছিলো। রাজনীতির সাথে তিনি নিজেকে এমনভাবে মিশিয়ে দিয়েছিলেন যে, রাজনীতির বাইরে তাঁর অন্য কোনো জীবন ছিলো না। রাজনীতির জন্য এমন নিষ্ঠা, একাগ্রতা, আন্তরিকতা, পরিশ্রম এবং সর্বস্ব ত্যাগের দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল।

জহুর আহমদ চৌধুরী আদর্শিক রাজনীতির এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৪৯ সালে জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত  হয়ে চট্টগ্রাম শহরে এই দলকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন; স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন এবং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনরত অবস্থায় যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ১৯৭৪ সালে, তখনো তিনি আওয়ামী লীগেরই কেন্দ্রীয় নেতা। দল ও আদর্শের প্রতি এই অবিচল নিষ্ঠাই তাঁর জীবনকে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুতে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত শোক বিবৃতিতে সংসদ নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে (জহুর আহমদ চৌধুরী) আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠৃাতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

এই বিপ্লবী কাট্টলীতেই ১৯১৫সালে জহুর আহমদ চৌধুরীর জন্ম। বৈপ্লবিক পরিবেশেই তাঁর বেড়ে ওঠা, মানস গঠন। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন চট্টগ্রামে তেমন সাংগঠনিক রূপ না পেলেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ, ছাত্র ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বামপন্থি প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, নাট্যকর্মীসহ সর্বস্তরের সংস্কৃতি কর্মীরা ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। সংগঠন হিসেবে তমদ্দুন মজলিশের সক্রিয়তা ছিলো বেশি। এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী বিরোধী দলীয় যেকোনো আন্দোলনের পুরোভাগে থাকতেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে মুসলিম লীগ নেতা রফিউদ্দিন সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষাধিক জনতার এ সভায় জহুর আহমদ চৌধুরী, এ কে খান, এমএ আজিজ, শেখ মোজাফফর আহমদ, চৌধুরী হারুনুর রশিদ, আজিজুর রহমান বক্তব্য রাখেন। পাকিস্তান আমলে বিশেষত আইয়ুব খানের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলের সাথে ইস্যুর ভিত্তিতে জোট গঠন করে। যেমন সোহরাওয়ার্দী বেঁচে থাকতে এনডিএফ তাঁর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে ‘কপ’ ও ‘ডাক’ প্রভৃতি জোটে শরিক হয়ে আওয়ামী লীগ আইয়ুবের একনায়কত্বের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই ক্রমশ জোরদার করে তোলে। চট্টগ্রামে এসব জোটভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে জহুর আহমদ চৌধুরীর সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা প্রকাশ পায়। কেন্দ্রে যখন যেমন যে দলের সাথে আওয়ামী লীগের সমঝোতা হয়েছে ও জোট গঠিত হয়েছে, চট্টগ্রামেও সে সব দলের স্থানীয় নেতাদেরকে নিয়ে জোটের শাখা গঠন করার সময় জহুর আহমদ চৌধুরীকেই সবাই নেতা হিসেবে মেনে নেন। জোটের সভায় প্রায় সময় তিনিই সভাপতি পদে ব্রত হন। অন্যান্য দলের কাছে তিনিই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নেতা ছিলেন।

১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে ৬ দফা ঘোষণার পর সরকার পাইকারি হারে আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার শুরু করে। ধরপাকড়ের প্রথম পর্যায়ে ৮ মে জহুর আহমদ চৌধুরী গ্রেফতার হন। এমএ আজিজও এদিন গ্রেফতার হন।

২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘির বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ঘোষণার জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জহুর আহমদ চৌধুরী। প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, এমএ আজিজ, আবদুল্লাহ আল হারুন প্রমুখ। জহুর আহমদ চৌধুরীর নির্দেশে জনসভার প্রস্তাব আগেই লিখে রেখেছিলেন ইদরিস আলম।

পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন জহুর আহমদ চৌধুরী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, ’৪৮ সাল থেকে সেই যে আন্দোলন তিনি শুরু করেন, একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে তাকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের চব্বিশ বছর মেয়াদে তিনি আট বছর কারাগারে ছিলেন। খাদ্য আন্দোলনে, পুলিশের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনে, ভাষা আন্দোলনে, ৫৪ সালে ৯২ ‘ক’ ধারায়, ৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক আইনে, ৬ দফা আন্দোলনে তিনি গ্রেফতার হন। কারাগারে নির্যাতনে তাঁর একটি কানের শ্রবণ শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। আইয়ুব সামরিক শাসন জারি করে ৫ বছরের জন্য তাঁর শ্রমিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেয়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর চট্টগ্রামে প্রথম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে গিয়ে জহুর আহমদ চৌধুরী গ্রেফতার হন। এ সময় তাঁর সঙ্গে আরো গ্রেফতার হন এমএ আজিজ ও সাইফুদ্দিন সিদ্দিকী।

১মার্চ ১৯৭১ ইয়াহিয়ার পূর্ব নির্ধারিত সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার প্রতিবাদে গোটা বাংলাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তখনো বাংলাদেশ হয়নি, কিন্তু বাঙালির ঐক্যবদ্ধ বজ্রনির্ঘোষে পূর্ব পাকিস্তান সেই একটি দিনে বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়ে যায়। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে সেদিনই শুরু হয়।

অসহযোগ আন্দোলনের সময় চট্টগ্রাম জেলার পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এমআর সিদ্দিকী ও জহুর আহমদ চৌধুরী যুগ্ম আহ্বায়ক, এমএ হান্নান, এমএ মান্নান এবং অধ্যাপক মো. খালেদ সদস্য ছিলেন।

এই সংগ্রাম পরিষদই ছিলো, চট্টগ্রামের অসহযোগ আন্দোলন ও যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রধান চালিকা শক্তি। ২৫ মার্চের ভয়ংকর কালরাতে সাড়ে এগারটার সময় বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়ে, সেই ঘোষণা দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে জানানোর গুরু দায়িত্ব কাকে দেয়া যায়, এ কথা যখন ভাবছিলেন, তখন একটি মুখই তাঁর মানসপটে ভেসে উঠেছিলো, আর সেই মুখ হলো তাঁর দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু ও পরম বিশ্বস্ত সহচর জহুর আহমদ চৌধুরীর। তিনি নিশ্চিত হয়ে নিকটতম প্রতিবেশির মাধ্যমে ঘোষণাটি টেলিফোনে পাঠিয়ে দিলেন জহুর আহমদ চৌধুরীর দামপাড়ার বাসায়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা জহুর আহমদ চৌধুরী দলীয় কর্মীদের সহায়তায় সাইক্লোস্টাইল করে হাজার হাজার কপি শহর ও উপজেলায় বিলির ব্যবস্থা করেন।

মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে চট্টগ্রামের তিন আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধিকে নিয়ে যেমন জহুর আহমদ চৌধুরী ভারতের সাথে প্রথম যোগাযোগ করেন, তেমনি প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনেরও উদ্যোগ নেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রথম প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং এ লক্ষ্যে গঠন করেন ইস্টার্ন লিবারেশন কাউন্সিল। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে যেসব এমএনএ ও এমপিএ আগরতলায় এসে পৌঁছেছেন, তাদেরকে নিয়ে জহুর আহমদ চৌধুরী ত্রিপুরার এমএলএ হোস্টেলে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে সর্বপ্রথম একটি সরকার গঠনের জন্য প্রস্তাব নেয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধে পূর্বাঞ্চলই ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ অঞ্চল। এখানে সাফল্যের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করা জহুর আহমদ চৌধুরীর জন্য একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিলো। পূর্বাঞ্চলেই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবীর সমাবেশ সর্বাধিক ছিলÑ ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার। এই অঞ্চলই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করে ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে।

এখানেই যুব শিবিরের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ। জহুর আহমদ চৌধুরী এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শতভাগ সফল হয়। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় যেমন, সমাপ্তিতেও নায়ক জহুর আহমদ চৌদুরী। মুক্ত স্বদেশ ভূমিতে তিনিই প্রথম ফিরে এসেছিলেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন বিজয়ের বার্তাও প্রথম ঘোষণা করেছিলেন। তিনি কসবা থানায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন নভেম্বরের ২৬ তারিখ।

মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভা কলকাতা থেকে ঢাকায় আসে ২২ ডিসেম্বর ’৭১। ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন জহুর আহমদ চৌধুরী। ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা গঠনের পর মুক্ত স¦দেশে এই প্রথম মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করা হয়।

জহুর আহমদ চৌধুরী চারটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পানÑস্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।

শ্রম, সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, চারটি মন্ত্রণালয়ই গুরুত্বপূর্ণ, যুদ্ধের ক্ষত কোথায় নেই। এখন ভাঙাচোরা বিধ্বস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সারিয়ে তুলে সেখানে আবার স্বাভাবিক কর্মপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে দিনরাত পরিশ্রম করে যেতে লাগলেন। তাঁর স্বাস্থ্য কোন সময়ই ভালো ছিলো না, সেই ভঙ্গুর স্বাস্থ্য যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর দেশ পুনর্গঠনে আরো ক্ষয়ে গেল এবং অবশেষে তার দম ফুরিয়ে এলো। ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই ঢাকায় পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মহাপ্রস্থান করলেন মহাপ্রাণ জহুর আহমদ চৌধুরী। জহুর আহমদ চৌধুরী কেবল চট্টগ্রামেরই নেতা নন, সমগ্র দেশে শ্রমিক আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর পরিচয় ১৯৪৩ সালে কোলকাতায়। সেই থেকে আন্দোলনে, রাজপথে, তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই মৃত্যু পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব অটুট ছিলো। প্রিয় বন্ধুকে শেষ বিদায় জানাতে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে এসেছিলেন এবং তাঁর জানাজায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।

 

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক

(জহুর আহমদ চৌধুরী : পুরোগামী জননেতা জন্মশতবর্ষ’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)