স্বামী-সন্তান জিম্মি করে পর্যটককে ধর্ষণ

হোটেল ব্যবস্থাপক গ্রেফতার/মূলহোতার নেতৃত্বে ৩২ জনের অপরাধী চক্র

রিয়াজ উদ্দিন ছোটন

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »

স্বামী-সন্তানকে জিম্মি ও হত্যার ভয়  দেখিয়ে কক্সবাজার শহরের লাবণী পয়েন্ট থেকে এক গৃহবধূকে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেছে তিন যুবক। এমন অভিযোগ করেছেন কক্সবাজারে বেড়াতে আসা ওই গৃহবধূ। গত বুধবার দিনগত রাত দেড়টার দিকে কক্সবাজার হোটেল-মোটেল জোনের জিয়া গেস্ট ইন হোটেল থেকে তাকে উদ্ধার করে র‌্যাব-১৫।

এ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে গতকাল জিয়া গেস্ট ইন হোটেলের ব্যবস্থাপক রিয়াজ উদ্দিন ছোটনকে আটক করেছে র‌্যাব। এর আগে হোটেলের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে দুজনকে শনাক্ত করার কথা জানিয়েছে র‌্যাব।

র‌্যাবের ভাষ্যমতে, ওই দুই যুবক হলেন কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া এলাকার আশিকুল ইসলাম আশিক ও আব্দুল জব্বার জয়। আরেকজনের পরিচয় এখনও জানা যায়নি।

আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন র‌্যাবের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) মো. আবু সালাম চৌধুরী। বাকি দুইজনকেও আটকে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।

ভুক্তভোগী ওই নারী জানান, বুধবার সকালে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে স্বামী-সন্তানসহ কক্সবাজার বেড়াতে আসেন ওই গৃহবধূ। ওঠেন শহরের হলিডে মোড়ের একটি হোটেলে। সেখান থেকে বিকালে যান সৈকতের লাবনী পয়েন্টে। সেখানে অপরিচিত এক যুবকের সঙ্গে তার স্বামীর ধাক্কা লাগলে; কথা কাটাকাটি হয়। তারই জের ধরে সন্ধ্যার পর পর্যটন গলফ মাঠের সামনে থেকে তার আট মাসের সন্তান ও স্বামীকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে কয়েকজন তুলে নিয়ে যায়। এ সময় আরেকটি অটোরিকশায় তাকে তুলে নেয় তিন যুবক।

পর্যটন গলফ মাঠের পেছনে একটি ঝুপড়ি চায়ের দোকানের পেছনে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে তিনজন। এরপর তাকে নেয়া হয় জিয়া গেস্ট ইন নামে একটি হোটেলে।  সেখানে ইয়াবা সেবনের পর আরেকদফা তাকে ধর্ষণ করে ওই তিন যুবক। ঘটনা কাউকে জানালে সন্তান ও স্বামীকে হত্যা করা হবে জানিয়ে কক্ষ বাইরে থেকে বন্ধ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে তারা।

ওই নারী জানান, জিয়া গেস্ট ইনের তৃতীয় তলার জানালা দিয়ে এক যুবকের সহায়তায় কক্ষের দরজা খুলেন তিনি। তারপর ফোন  দেন ৯৯৯ নম্বরে। পুলিশ তাকে থানায় সাধারণ ডায়েরি করার পরামর্শ দেয়। তারপর পাশের একজনের সহযোগিতায় কল দেন র‌্যাবকে। তারা এসে তাকে উদ্ধার করে। তার স্বামী ও সন্তানকে উদ্ধার করা হয় পর্যটন গলফ মাঠ এলাকা থেকে।

ভুক্তভোগীর স্বামী জানান, সামান্য ধাক্কা লাগার কারণে তারা আমার এত বড় ক্ষতি করল। অপরিচিত বলে শহরের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেলেও, সে জায়গা ও দুর্বৃত্তদের চিনতে পারিনি। তিনি বলেন, বারবার হাতে-পায়ে ধরলেও তারা আমার স্ত্রীকে ফেরত দেয়নি। বেড়াতে এসেছিলাম বেতন পাওয়ার খুশিতে। এখন স্ত্রীর অবস্থা ভালো নয়; তাকে নিয়ে চিন্তায় আছি।

কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর সিপিসি কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান সাংবাদিকদের বলেন, খবর পেয়ে স্বামী-সন্তান ও গৃহবধূকে উদ্ধার করি। তদন্ত শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত তিনজনের মধ্যে দু’জনকে শনাক্ত করেছি। তাদের ধরতে অভিযান চলছে।

কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ অধিনায়ক  লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম সরকার সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে। বিষয়টি নিয়ে অধিকতর তদন্ত চলছে। মামলার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন বলে জানান তিনি।

মূলহোতার নেতৃত্বে ৩২ জনের অপরাধী চক্র

এদিকে বাংলা ট্রিবিউন জানায় কক্সবাজারে স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে পর্যটককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুই জনকে শনাক্ত করেছে র‌্যাব। তারা হলো কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া এলাকার আব্দুল করিমের ছেলে আরিফুল ইসলাম আশিক ও তার সহযোগী ইস্রাফিল হুদা জয়। র‌্যাব ও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, তারা ছিনতাইকারী। তবে স্থানীয়রা বলছেন, কক্সবাজারে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের মূলহোতা আশিক। তার নেতৃত্বে রয়েছে ৩২ জনের একটি অপরাধী চক্র।

শহরের বাহারছড়া এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত আরিফুল ইসলাম আশিক বড় ধরনের অপরাধী। তার রয়েছে ৩২ জনের সিন্ডিকেট। তারা একেকজন একেকভাবে বিভক্ত হয়ে আবার কখনও দুই-তিন জন দলভুক্ত হয়ে শহরের অলিগলিতে চুরি, বিচে, ছিনতাই ও খুনসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকা- করে বেড়ায়। একজন ধরা পড়লে সিন্ডিকেটের আরেকজন এগিয়ে গিয়ে রক্ষা করে। চুরি-ছিনতাইয়ের মামলায় কয়েক মাস আগে আরিফুল ইসলাম আশিক গ্রেফতার হয়। কয়েকদিন আগে জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে আশিক। মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় অপরাধ কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। সবশেষ পর্যটক ধর্ষণে জড়ায়। তাকে গ্রেফতার করলেই সব তথ্য বেরিয়ে আসবে।

পুলিশ ও র‌্যাবের তথ্য অনুযায়ী, আরিফুল ইসলাম আশিক ও তার সহযোগী ইস্রাফিল হুদা জয় ছিনতাইকারী। আশিকের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা রয়েছে। তার সহযোগীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা আছে। আশিক একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে শহরের কলাতলী এলাকার জিয়া গেস্ট ইন হোটেলের ফ্রন্ড ডেস্কে থাকা ম্যানেজার আমির হোসেন ও তামজিদ আল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘বুধবার রাতে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে আরিফুল ইসলাম আশিক ও সাথী নামে দুই জন রুম ভাড়া নেয়। এক ঘণ্টার মধ্যে রুম ছেড়ে চলে যায় তারা। হোটেলের রেজিস্ট্রেশন খাতায় তাদের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁও থানার মাইজপাড়া গ্রাম। রাতে র‌্যাব আসার পর জানতে পারি আরিফুল ইসলাম আশিকের বাড়ি বাহারছড়া এলাকায়। আশিক-ই ওই নারীকে নিয়ে হোটেলে এসেছিল। এর বেশি কিছু আমরা জানি না।’

ওই নারীর ভাষ্য অনুযায়ী, প্রথমে সৈকতের লাবণি পয়েন্টের সানি বিচ এলাকার ঝুপড়ি ঘরে তাকে ধর্ষণ করেছে তিন যুবক। বৃহস্পতিবার বিকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা, স্তব্ধ ওই এলাকা। আশপাশে লোকজন নেই।

কিছুদূর যাওয়ার পর নুরুল হক নামে স্থানীয় এক যুবকের সঙ্গে কথা হয়। নুরুল হক বলেন, ‘ধর্ষণের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে প্রতিরাতে সৈকতের বিচ ও ঝাউবাগানে গাঁজা ও জুয়াড়িদের আসর বসে। শহরের সব ছিনতাইকারী, নেশাখোর ও অপরাধীরা এখানে আড্ডা দেয়। বুধবার রাতেও এখানে তারা চেঁচামেচি করেছিল। আমরা ভয়ে বাসা থেকে বের হইনি। কারণ প্রায় দুর্ঘটনা ঘটে। আমার ধারণা, ওই সময়ে এখানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।’

স্থানীয় বাসিন্দা আবুল মঞ্জুর বলেন, ‘সন্ধ্যা হলেই লাবণি বিচ থেকে শুরু করে কবিতা চত্বর ও ডায়াবেটিক পয়েন্ট ও ঝাউবাগানের আশপাশে কোনও ধরনের নিরাপত্তা থাকে না। বলতে গেলে অপরাধীদের দখলে থাকে এসব এলাকা। ফলে এসব এলাকায় প্রতিনিয়ত কোনও না কোনও অপরাধ সংঘটিত হয়। এসব এলাকায় জেলা পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশের কোনও তৎপরতা নেই। এখানে পুলিশ নিষ্ক্রিয়। জেনেও ব্যবস্থা নেয় না তারা।’

আবুল মঞ্জুরের কথার সত্যতা মিলেছে কয়েকজন পর্যটকের সঙ্গে কথা বলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পর্যটক বলেছেন, সন্ধ্যা হলেই ভুতুড়ে এলাকা মনে হয়। কোনও লোকজন নেই। অপরাধী ও ছিনতাইকারীরা আড্ডা দেয়। জেলা পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশের তৎপরতা আমাদের চোখে পড়েনি।