সৈকতে ‘খরা’,পাহাড় সরগরম

ছুটিতে পর্যটন

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ও বান্দরবান »
এবার ঈদুল আজহার টানা ছুটিতে আশানুরূপ পর্যটকের আগমন ঘটেনি কক্সবাজারে। যা হতাশ করেছে পর্যটন সংশ্লিষ্টদের। প্রায় ৫ শতাধিক হোটেল মোটেল গেস্ট হাউজগুলো নতুন আঙ্গিকে সাজানো, ৫০ শতাংশের বেশি ডিসকাউন্ট ঘোষণা করেও পর্যটকদের মন গলাতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। তবে একেবারে যে পযটক শূন্য কক্সবাজার তা কিন্তু নয়। হোটেল মোটেল মালিকেরা বলছে ৩০ শতাংশ রুমের বুকিং হয়েছে। তবে এটা তাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। অন্যান্য বছর ঈদের মাস দেড়েক আগ থেকে বুকিং হয়ে যায় হোটেল মোটেলগুলো। গত ১৫ বছরের মধ্যে এমন অবস্থা এই প্রথম বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সূত্র জানায়, ঈদের তিনদিন পর্যটকের সংখ্যা ছিলো কম। ঈদের দুদিন পর কিছুটা পর্যটক সৈকত তীরে দেখা গেলেও তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে মঙ্গলবার (১২ জুলাই) দুপুর পর্যন্ত কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলের ৮০ শতাংশ কক্ষ বুকিং হয়নি বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার।
আবুল কাসেম বলেন, ‘কক্সবাজারে পর্যটনের ইতিহাসে এমন খরা আগে কখনও হয়নি। ঈদে পর্যটক আগমনে এমন নিম্নগামিতা সর্বোচ্চ রেকর্ড করেছে। সদ্য পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ায় এবার ঈদের ছুটিতে দেশের নানা প্রান্তের মানুষ পদ্মা সেতু দেখতে ভিড় করছেন। সেই সঙ্গে ঢাকা থেকে কুয়াকাটার দূরত্ব কমে আসায় সেখানেও পর্যটকরা ছুটছেন। তবে এটা সাময়িক।’
তিনি আরো বলেন, ‘করোনার প্রকোপ ও দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির কারণে কক্সবাজারে পর্যটক আশানুরূপ হয়নি। ঈদের দ্বিতীয় দিনেও হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউসগুলোর ৮০ শতাংশ রুম ফাঁকা। তবে ৫ ও ৩ তারকা মানের হোটেলগুলোতে শতভাগ রুম বুকিং রয়েছে।’
আবুল কাসেম বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কী ঘাটতি রয়েছে এবং কক্সবাজারে পর্যটক কীভাবে বাড়ানো যায় সেই পন্থা বের করবো।’
এদিকে, সৈকতের লাবণী পয়েন্ট, সুগন্ধা পয়েন্ট এবং কলাতলী পয়েন্টে হাতে গোনা কিছু দর্শনার্থী দেখতে পাওয়া গেছে। যারা পরিবার পরিজন নিয়ে সৈকতে বেড়াতে এসেছেন।এসব পর্যটকদের ৮৫ শতাংশই স্থানীয় বাসিন্দা।
সিরাজগঞ্জের কাজীপুর থেকে আসা পর্যটক রাইসুল মিঞা বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে কক্সবাজারে আসার পরিকল্পনা ছিল অনেক আগে থেকে। এছাড়া খবরে জানলাম কক্সবাজারে পর্যটক কম। সেই সুবাধে ঝামেলা ছাড়া সুন্দর সময় কাটাতে পারবো ভেবে কক্সবাজার এলাম। বুধবার সন্ধ্যায় ফিরবো।’
নরসিংদীর মনোহরদী থেকে সপরিবারে আসা পর্যটক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মঙ্গলবার সকালে কক্সবাজারে পৌঁছেছি। হোটেলের রুম বুকিং দিয়েছি এক সপ্তাহ আগে। সৈকতে এসে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সমুদ্রে নামলাম। তবে অন্যান্য বারের চেয়ে এবার সৈকতের পরিবেশ একটু ব্যতিক্রম লাগছে। আগের বার যখন এসেছিলাম তখন পর্যটন মৌসুম ছিল। সৈকতের জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ উপভোগ করছিলাম। এবার পর্যটক কম আগের মতো ভালো লাগছে না।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বাস থেকে কলাতলী নামা মাত্র কিছু দালাল আমাদের ভালো হোটেলে নিয়ে যাবে বলে ব্যাগ ধরে টানাটানি করছিল। পরে তাদের বুঝালাম আমাদের রুম আগে থেকে বুকিং দেওয়া ছিল। ওই মুহূর্তটা খুবই বিব্রত লাগছিল।’
সুগন্ধা পয়েন্টের বার্মিজ স্টোরের মালিক রোবায়েত উল্লাহ বলেন, ‘ঈদে আমাদের যে টার্গেট ছিল তা পূরণ হয়নি। ঈদের দিন বিকেল থেকে দোকান খুলেছি। সেদিন একদম বেচা-বিক্রি হয়নি। ঈদের দ্বিতীয় দিনও আশানুরূপ বিক্রি হয়নি।’
সৈকতে ভ্রাম্যমাণ পান, ঝালমুড়ি, পানি ও চিপসের কয়েকজ বিক্রেতা জানান, তাদের অবস্থাও খারাপ যাচ্ছে। পর্যটক কম থাকায় বিক্রি কম। সারাদিন সৈকত ঘুরে ৩০০-৪০০ টাকা আয় করতে না পারার কথা জানান তারা।
কক্সবাজারে পর্যটক আসুক বা কম আসুক; তারপরও ঈদুল আজহার ছুটিতে পর্যটক নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিটি পর্যটন স্পটে কঠোর নজরদারি রেখেছে টুরিস্ট পুলিশ।
কক্সবাজার টুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম জানান, অন্য ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য যেভাবে প্রস্তুতি দরকার এবারও সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে পর্যটক আগমন বাড়বে সে চিন্তা মাথায় রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিত ও অপরাধ দমনে কয়েকটি ভাগে সাজানো হয়েছে টুরিস্ট পুলিশকে। টেকনাফ ও ইনানীসহ সব পর্যটন স্পটে টুরিস্ট পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে।
পর্যটক না আসার যেসব কারণ বলছে ব্যবসায়ীরা
১. সরকারি ছুটির সময় কম থাকায় পর্যটক না আসার অন্যতম কারণ।
ঈদের ছুটিতে কক্সবাজারকে গন্তব্য হিসেবে বেছে নেন ঢাকা বা আশপাশের এলাকার মানুষ এবার পদ্মা সেতু দেখতে গেছেন। বা পদ্মা সেতু এলাকায় ঘুরে ফিরে সময় কাটিয়েছেন।
২. সিলেটসহ দেশের ২০ জেলায় ভয়াবহ বন্যার কারণে এসব জেলার মানুষ এবার ঈদুল আজহার ছুটিতে নিজ এলাকা থেকে বাইরে যাননি।
৩. এসএসসি পরীক্ষায় পিছিয়ে দেয়ায় অভিভাবকরা সন্তানদের পড়ালেখার কথা চিন্তা করে এবার বেড়ানোর বিষয়টি বাদ দিয়েছেন।
৪. কোরবানির পশুর অধিক মূল্যও এবার অনেকের বাড়তি খরচ বাড়ায় বেড়ানো পরিহার করেছে।
এমন সব কারণ জানা গেছে পর্যটন সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে। তবে কুয়াকাটায় পর্যটক বেশি গেছে বলে কক্সবাজার পর্যটক আসেনি এমন তথ্য মানতে নারাজ পর্যটন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছে কুয়াকাটায় থাকার ও খাবার হোটেল হাতেগোনা।
বান্দরবান
ঈদের ছুটিতে পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে বান্দরবানের সব পর্যটন কেন্দ্রগুলো। ঈদের ২য় দিনে মেঘলা নীলাচল শৈলপ্রপাত চিম্বুক নীলগিরি নীল দিগন্তসহ জেলার বিভিন্ন পর্যটন স্পট ঘুরে দেখা যায় সবগুলো দশর্নীয় স্থানে পর্যটকের উপচেপড়া ভিড়। পর্যটকরা পরিবার পরিজন বন্ধু বান্ধব নিয়ে চাঁদের গাড়িতে করে ছুটে বেড়াচ্ছে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। কেউ বা ছুটে যাচ্ছে রেমাক্রী নাফাকুমের সৌন্দর্য দেখতে কেউ বা যাচ্ছে দেবতাকুমের স্বচ্ছ জলে গা ভাসাতে আবার কেউ বা যাচ্ছে সুউচ্চ পাহাড় তাজিংডং এর সৌন্দর্য দেখতে। এক কথায় সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত পর্যটকরা চষে বেড়াচ্ছে বান্দরবানের সব দর্শনীয় স্থান।
ঢাকা থেকে ঘুরতে আশা কয়েকজন পর্যটক জানান, নগর জীবনের ব্যস্ততা ছেড়ে একটু প্রশান্তি নিতে পাহাড়ে ঘুরতে আসেছি। আসলে বর্ষায় পাহাড় এতটা সুন্দর হয়, যা নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। পাহাড়, মেঘ-বৃষ্টি একসাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তারা আরও বলেন, আমরা অনেকেই ঘুরতে দেশের বাইরে ভ্রমণে যায়। অথচ আমাদের দেশে অনেক সুন্দর সুন্দর দেখার মত জায়গা রয়েছে। তাই ভ্রমণপিপাসুদের বলবো যারা এখনো বান্দরবানে আসেন নাই, তারা একবার হলেও বান্দরবানের সৌন্দর্য উপভোগ করে যান।
এদিকে বান্দরবানে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদের শুরুতে আশানুরূপ পর্যটক না আসলেও ঈদের ২য় দিনে পর্যটক আসতে শুরু করেছে। আমরা আগত পর্যটকদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। সামনের দিনগুলোতেও আরও পর্যটকের সমাগম ঘটবে বলেও আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
বান্দরবান জেলার টুরিস্ট পুলিশ সুপার আব্দুল হালিম জানান, ঈদে পর্যটদের সুবিধার্থে আমাদের টুরিস্ট পুলিশের ছুটি বাতিল করেছি। যাতে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত পর্যটকরা নির্বিঘ্নে ঘুরাফেরা করতে পারে। বান্দরবানের সবগুলো পর্যটন স্পটে আমাদের টুরিস্ট পুলিশের টহল টিম আছে। যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আমরা সর্বদা প্রস্তুত আছি বলে জানান টুরিস্ট পুলিশের এ কর্মকর্তা।
জেলায় পর্যটকদের সেবায় রয়েছে শতাধিক হোটেল মোটেল রিসোর্ট গেস্ট হাউস এছাড়াও পর্যটক পরিবহনে রয়েছে ৪ শতাধিক চাঁদের গাড়ি, সব মিলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জেলার ২০ হাজার মানুষ পর্যটন ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট।