সূর্যোদয়

শিরিন শবনম »

বাড়িতে অনেক মেহমান এসেছে। অনেক আত্মীয়স্বজনও এসেছে। যাদের কোনোদিন দেখিনি, তারাও এসেছেন। তাদের দেখে ভাবছি, আমার এত আত্মীয়স্বজন তারা এতদিন কই ছিল। ভাবছি আর হাসছি। তবে হ্যাঁ, সবাইকে একসাথে দেখে অনেক খুশিও লাগছিল। এবার তাদের আসার কারণ বলি। সবাই এসেছেন আমার বিয়েতে। কাল আমার গায়েহলুদ আর পরশু বিয়ে। এমন এক খুশির দিনে সবাই আছে দেখে খুব ভালো লাগছে। কিন্তু সবার মাঝে শুধু একজন ছিলেন না, আর তিনি আমার বাবা। আজ বাবাকে খুব মনে পড়ছে, সঙ্গে অতীতের সব কথাও। আমার শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনকালের যেটুকু সময় পার করেছি, সেসব সময়ের কথা।
আমি শবনম, গ্রামের এক রাজপ্রসাদে জন্ম। বাবা ছিলেন আমার জীবনের নায়ক। তিনি ছিলেন অসাধারণ। পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী। আর মা গৃহিণী। বাবা-মায়ের প্রথম ভালোবাসার চিহ্ন আমার বড় বোন। খুবই গুছালো এবং সুন্দর এক পরিবার। আর্থিক অবস্থা বেশ ভালোই ছিল। রাজপ্রসাদের মতো একটি বাড়ি ছিল আমাদের। সামনে বিশাল এক উঠান। হরেকরকম ফুল আর ফলের গাছে পরিপূর্ণ ছিল আমাদের রাজপ্রসাদ। বাড়ির পেছনে ছোট্ট একটি পুকুর ছিল, সাথে পুকুরে নামার সিঁড়িও। সিঁড়ির ঠিক পাশেই ছিল একটি কদমফুলের গাছ। উফ, বর্ষায় কি যে ভালো লাগতো। বাড়ির দেয়ালের চারপাশে ছিল বেলির ছড়াছড়ি। বেলি রজনীগন্ধা কদম গোলাপ জবা আরও কত কী। আর আর সবজির কথা না হয় নাই বললাম। কুমড়োর ভারে আমাদের প্রাসাদের চাল দেবে যেত। আমা-জাম কাঠাল পেঁপে পেয়ারা জলপাই আরো কত। বর্ষায় যখন বাড়ির উঠোনে পানি জমে যেত তখন আমাদের দুইবোনের কতই যে আনন্দ। দাদি কাগজ দিয়ে নৌকা বানিয়ে দিত আর আমরা দুজন তা উঠানের জমে থাকা পানিতে ভাসাতাম।
এমনভাবেই আমাদের সময় যেতে লাগলো। বাড়িতে নতুন সদস্য এলো, আমার ছোটভাই। হঠাৎ একদিন তার সাথে খেলতে গিয়ে মায়ের কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। কাছে গিয়ে আপু আর আমি ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম। দেখতে পেলাম পাড়ার এক ভাই এসে বলছে, বাজারে নাকি আগুন লেগেছে, সব দোকান পুড়ে শেষ। সাথে আমার বাবার দোকানও। বয়স তখন আট। বোঝার তেমন বয়স হয়নি। কিন্তু তাতেও মন খারাপ হলো এই ভেবে যে, বাবা আমার জন্য সিঙ্গারা কেমনে আনবে। যাক আমার বাবা অনেক শক্তমনের মানুষ। বাবা দোকান পুড়ার পরে ভেঙে পড়েছিলেন কিনা জানি না, হয়তো পড়েছিলেন। কিন্তু কাউকে তা বুঝতে দেননি। এরপর থেকে আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসতে শুরু করলো।
বাবা পরপর দুবার ঋণ নিয়ে ব্যবসাটা নতুন করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু হলো না। এর ফলে দিন দিন ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকলো এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙখ্যাও কমতে থাকলো। সবাই আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সময় যেতে যেতে এমন এক সময় আসলো যখন আমাদের দুবেলা খেয়ে বেঁচে থাকাটাই মুশকিল হলো। আমারা দুবোন শাক কুড়িয়ে এনে মাকে দিতাম আর মা তা রান্না করে আমাদের খাওয়াতেন। মাঝেমধ্যে এমনও সময় যেতো যেদিন ভাত চোখে দেখতাম না। যে মানুষটা অসহায় মানুষদের মাসে মাসে চালের বস্তা কিনে দিতেন সেই মানুষটাকে ১/ ২ কেজি চাল আনতে দেখেছি। খেতে পাই আর না পাই বাবা আমাদের লেখাপড়া বন্ধ করেননি। তিনি সব সময় বলতেন, আমি দুনিয়াতে না থাকলেও মানুষ যাতে আমার নাম মনে রাখে। আর আমি চাই, তোমরাই আমার নাম রাখবে। আমার স্বপ্নপূরণ করবে।
এভাবে খেয়ে, না-খেয়ে আমাদের সময় যেতে থাকলো। দেখতে দেখতে আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ও চলে এলো। মা অসুস্থ ছিল বিধায় বাবাকে রাগ করে বললাম, পরীক্ষার সময় সবার বাবা না হয় মা যাবে, আমার সাথে কে যাবে। বাবা হেসে বললো, আরে কি বলে আমার মেয়েটা, আমি আছি না। আমি যাবো আমার মেয়ের সাথে। চিন্তার কিছু নেই। বাবার কথায় একটু চিন্তামুক্ত হয়ে পড়তে বসলাম। পরীক্ষার ঠিক ১০ দিন আগে বাবার হঠাৎ শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে উঠলো। পড়াশোনা বাদ দিয়ে বাবাকে নিয়ে মেডিকেলে ছুটলাম। সারাদিন মেডিকেল ছিলাম। অনেক গল্পও করলাম। বাবা কত কথাই না বললো। কত স্বপ্ন দেখালো। বললো, মা জানো, তোমরা আমার মেয়ে না। তোমরা দুজন হলে আমার বড় ছেলে। তোমাদের অনেক বড় হতে হবে মা। তোমাদের এমন হতে হবে যাতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সবাই বলে দেখ, দেখ সাদেকের মেয়ে যাচ্ছে। এমন বলে বাবা আমার মাথাটা টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো। একদিন বাবার স্বপ্নপূরণ করবো কথা দিলাম।
রাত ঠিক ১১. ৪৫ বাবা হঠাৎ কেমন জানি করতে থাকলো। এমন করতে করতে হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলেন। মনে হলো শীত পরম আদরে তার চাদর দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে নিয়েছে। সেদিন আমি প্রথম আমার মাকে মাটিতে শুয়ে কান্না করতে দেখেছি। এবং আমিও সেদিন প্রথমবারের মতো এত কান্না করেছি। সেদিন আমাদের এত কান্না দেখেও বাবা ঘুমিয়েছিলেন। অন্য সময়ের মতো আমাদের বলেননি, সাহসীদের কাদঁতে নেই। আমি বারবার চেয়ে দেখছিলাম বাবা চোখ মেলে কিনা। কিন্তু বাবা আর চোখ মেলেনি।
১০ দিন পর পরীক্ষা দিতে গেলাম। বের হয়ে যখন দেখতাম সবার বাবা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখন আমি সব বাবার মাঝখানে আমার বাবাকে খুঁজতাম। হ্যাঁ, আমি খুঁজে পেতাম। কারণ বাবা সব সময় আমার সাথে ছিলেন এবং আছেন। মন খারাপ হলেও হতে দিতাম না। কারণ আমরা বাবার সাহসী মেয়ে। আমাদের মানুষ হতে হবে। বাবার স্বপ্নপূরণ করতে হবে। এরপর শুরু হলো আমাদের জীবনযুদ্ধ। কিছুদিন পর বড়বোনের বিয়ে ঠিক হলো। ভালো ছেলে হওয়াতে মা আর না করতে পারেননি আর তেমন খরচও হয়নি। বিয়েটা হয়ে গেল। আর এদিকে আমি আমার স্বপ্ন নিয়ে আছি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। কিন্তু ভাগ্য আমার তা চায়নি। ইচ্ছে ছিল আইন বিভাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো। সেদিন দ্বিতীয়বারের মতো কান্না করতে হলো। কি আর করা। সিদ্ধান্ত নিলাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়বো। জানি টাকা নেই, কিন্তু আছে স্বপ্ন আর ইচ্ছে। পড়ার জন্য শহরে চলে আসলাম। কিন্তু শহরের জীবন এত সহজ ছিল না। ছেলেমেয়ে পড়িয়ে টাকার ব্যবস্থা করবো ভেবেছিলাম। কিন্তু একটার বেশি টিউশন পাচ্ছিলাম না। পরে একজনের সাহায্যে একটা কাপড়ের দোকানে পার্টটাইম চাকরি পেলাম। সেখানে আমার মতো আরো অনেক মেয়ে কাজ করতো। এমনকি আমার দোকানের মালিকও ছিল মেয়ে। থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার খরচ ওখান থেকেই হয়ে যেত।
তারপর শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ ধনী পরিবারের সন্তান। নিজেকে বিরানির মাঝে এলাচির মতো মনে হচ্ছিল। কিছুদিন যাবার পর আমার অনেক বন্ধুবান্ধব হলো। কয়েকজন হয়ে উঠলো আমার খুব ভালো বন্ধু। যারা সবসময় আমাকে সাহায্য করতো এবং যাদের সাথে সব কথা মন খুলে বলা যেতো। কয়েক মাস যেতে না যেতে কেন জানি নিজের এই সাদাকালো জীবনটাকে একটু রঙিন মনে হচ্ছিল। আর এই রঙ লাগিয়েছিল আবিত। তার সাথে প্রথম দেখা সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় এক ধাক্কা লাগার মাধ্যমে। সে ছিল আমার ভালো বন্ধুদের একজন। কেন জানি আমার আবিতকে অন্যসব বন্ধুদের চাইতে একটু বেশি ভালো লাগতো। কোন সময় যে এই ভালোলাগাটা ভালোবাসায় রূপ নিল নিজেও বুঝতে পারিনি। অজান্তেই আমি তাকে আমার মনের সবচেয়ে সুন্দর এবং আলাদা এক জায়গায় বসিয়েছি। যতদিন যেতে লাগলো আমার ভালো লাগাটা তত বেশি প্রেমে পরিণত হতে লাগলো। আর এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম প্রেম। এক সময় তাকে নিয়ে আমি আমার কল্পনার জগত সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তাকে দূর থেকে দেখতাম আর হাসতাম। তার ছোঁয়া ৫ টাকা দামের কলমটাও ছিল আমার কাছে অমূল্য। কিন্তু আমার এত অনুভূতি সম্পর্কে সে জানতো না। কখনো জানবে কিনা তাও জানি না। তাকে লুকিয়ে ভালোবাসতাম। আর এই লুকিয়ে ভালোবাসার অনুভূতিটা বলে বোঝানের মতো না। সে সব সময় ভালো বন্ধু হিসেবে আমার অনেক যত্ন নিত আর তার এই যত্মগুলো আমার সকল যুদ্ধ এবং কষ্টের কথা ভুলিয়ে দিত। কারণ সে ছিল আমার স্বপ্নের রাজকুমার। আর ভাবতাম যতদিন সে তার জীবনে অন্য কোন রমণীকে স্থান দিচ্ছে না আমি ততদিন হাল ছাড়ছি না। তার অপেক্ষায় থাকবো।
এমন করতে করতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ৩টা বছর পার করলাম। এর মধ্যে আরো অনেক টিউশন হলো। তাতে বাড়িতেও কিছু টাকা দিতে পারি। ছোটভাই মাধ্যমিক পাস করলো। আর মা সেলাই কাজ করে পরিবার চালাতে লাগলো। তার মধ্যে বড়বোনের সরকারি চাকরি হয়ে গেল। এসব দেখে ভাবতে লাগলাম, দীর্ঘ এক রাতের শেষে বোধ হয় এবার সূর্যোদয় হতে লাগলো। আর এদিকে আমি আমার পড়াশোনা, বাবার স্বপ্ন আর আবিতকে নিয়ে ব্যস্ত। পাশাপাশি চাকরির জন্যও পড়াশোনা করছি। হঠাৎ একদিন ক্যাম্পাসে রায়হান আমার পাশে এসে বসলো। রায়হান হলো আমার বন্ধুদের একজন, খুবই ভালো এবং ভদ্র ছেলে। দেখতেও বেশ ভালো। সে আবিতের ভালো বন্ধু। তারও অধিক ভাই বললেই চলে। তারা একজন অন্যজনকে ছাড়া থাকতে পারে না। ক্যাম্পাসে প্রায় সবাই তাদের এই বন্ধুত্বের কথা জানে। রায়হান হঠাৎ এসে বললো, শবনম, তোর সাথে কিছু কথা বলার ছিল। আমি ভাবলাম, আবিতের কোনো নতুন প্রেমের সংবাদ দিতে আসলো নাকি। তারপর সে চোখ বন্ধ করে বললো, আমি তোকে ভালোবাসি, শবনম। ক্যাম্পাসে আমি যেদিন তোকে প্রথম দেখি সেদিন থেকেই আমি তোকে ভালোবাসি। ওর কথা শুনে কিছুটা অবাক হলাম। তাকে কিভাবে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। কারণ আমিও যে একজনের প্রেমে দিশেহারা। মাঝেমধ্যে ভাবি, আবিত যদি আমাকে না করে তখন আমার কেমন লাগবে। রায়হানের কথার উত্তর দেবো ঠিক তখনি সেখানে আবিত চলে এলো। তারপর রায়হান আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর আমি আর কিছু বলতে পারলাম না …
কাল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষদিন। আবিত এক সময় আমাকে তার ভালো বন্ধু হিসেবে একটি শাড়ি উপহার দিয়েছিল। তার প্রিয় রঙ নীল আর শাড়িটাও ছিল নীল। ভাবছি, কাল সেই শাড়ি পরে তার সামনে যাবো। তার সামনে গিয়ে বলবো, তুই কি আমার হাতটা ধরবি আবিত, আমি তোর হাত ধরে অনেক পথ চলতে চাই। ধরবি আমার হাত? সব কথা গোছানোর পরেও অগোছালো হয়ে যাচ্ছিল সব। কেমন জানি অস্থির লাগছিল। মনে হচ্ছে জীবনের সবচাইতে বড় কাজটা করতে যাচ্ছি।
আমি বাগানে অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, আবিত আমার দিকে আসছে। তাকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। আজ সে আমার দেয়া নীল পানজাবিটা পরেছে। আর রায়হান পরেছে আমার দেয়া ৫০০ টাকা দামের পানজাবিটা। আমি মনে মনে খুশি হলাম এই ভেবে যে, আবিতও বোধ হয় আমাকে ভালোবাসে। সে হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার অনুভূতি। সেও হয়তো আজকের দিনের অপেক্ষায় ছিল। আবিত কাছে এসে বললো, শবনম তোর জন্য একটা উপহার আছে, যা আমি তোকে আজকে দেবো বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। আমিও বললাম, আমারও তোকে কিছু দেবার আছে আবিত। তারপর সে বললো, না আমি আগে দেবো। চল আমার সাথে। তারপর আমাকে ক্যাম্পাসের চায়ের দোকানে বসিয়ে রেখে তার উপহার আনতে গেল। তারপর সে আমায় এমন এক উপহার দিল যা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় এবং দামিউপহার। যে উপহারের কথা আমি মৃত্যুর আগেও ভুলবো না। আমি প্রথমবার তার চোখেমুখে এতো আনন্দ দেখেছি। দেখেছি তার মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি যেন। তার উপহারটি হলো নীলিমা। যে ছিল আমাদের জুনিয়র। তাকে দেখে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। সে বললো, তোদের ভাবি। তুই আমার সবচাইতে কাছের বন্ধু। তাই সুখবরটা আগে তোকেই দিলাম। আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঠোঁটে হাসি নিয়ে আমার ভালোবাসা দেখছিলাম। ভাবছিলাম, এই বুঝি ভালোবাসা। ভালোবাসার মানুষটার হাসি যদি তোমাকে হাসাতে না পাওে, তাহলে এ কেমন ভালোবাসা। আমি শুধু আমার আবিতকে ভালো দেখতে চাই। আমি সব সময় তার হাসিটাই দেখতে চাই। আমি চাই আমার ভালোবাসা সব সময় ভালো থাকুক। সেটা আমার সাথে হোক বা অন্য কারো সাথে। সে আমায় জিজ্ঞেস করলো, কিরে তুই কিছু বলছিস না যে, খুশি হসনি বুঝি। আমি বললাম, মানুষ কতটা খুশি হলে চোখে পানি আসতে পাওে, বল। দেখ, আমার চোখে পানি। এবার ভেবে নে আমি কত খুশি হয়েছি। সেদিন আমি তৃতীয়বারের মতো কান্না করেছিলাম। সেদিন নিজের কাছে নিজে কথা দিলাম চতুর্থবারের কান্নাটা হবে আমার সফলতার কান্না। এরপর আবিত যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেদিনি ছিল তার সাথে আমার শেষ দেখা। হয়তো সে কখনো আমার না বলা কথাটা জানবে না। কিন্তু তাও আমি তাকে ভালোবাসি।
এরপর আমার জীবন আবার সাদাকালো হয়ে গেল। বারবার মনে হতে লাগলো, এ বোধ হয় আমার জীবনের আরেক সূর্যাস্ত। আবার সূর্যোদয় কবে হবে? তারপর সময় কাটাতে থাকলাম পড়াশোনা এবং টিউশন নিয়ে। এর মধ্যে রায়হানও অনেকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমি করিনি। একবার খুব পাগলামি করায় তাকে বলছিলাম, যদি বিচারক হতে না পারিস তাহলে আমার সামনে আসবি না এবং যোগাযোগের চেষ্টাও করবি না। তাকে এই শর্ত দেয়ার কারণ হলো, আমি জানতাম সে পারবে না। সে পড়াশোনায় অনেক দুর্বল। আমি চাই না অন্য কেউ আমার আবিতের জায়গা দখল করুক। এরপর সে আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি আর।
আজ বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করলো। রেজাল্ট দেখতে যাবার সাহস হচ্ছিল না। পরে অনেক সাহস করে রেজাল্ট দেখলাম। চতুর্থবারের মতো কাদঁলাম। আর সেদিনের কান্না ছিল আমার বাবার স্বপ্নপূরণের কান্না। এত কাঁদলাম যে সবাই মনে করেছিল আমি আসিনি। তারপর সোজা গ্রামের পথে ছুটলাম। বাড়ি যাবার আগে প্রথমে গেলাম আমার বাবার সাথে দেখা করতে। বাবার কবরের সামনে গিয়ে বললাম, আব্বু ওঠো, দেখো, কে এসেছে। তোমার শবনম। সাদেকের মেয়ে শবনম। আমি এখন একজন বিচারক আব্বু। পেরেছি আব্বু, আমি পেরেছি। এরপর আমার আর কথা বলার শক্তি ছিল না। এত বেশি কান্না করতে লাগলাম যেমনটা আব্বুকে হারিয়ে কেঁদেছি। একটু পর ইমাম সাহেব এসে বললো, মা শবনম, এমনভাবে কাদঁতে নেই, মা। তুমি না তোমার বাবার সাহসী মেয়ে। তুমি কাঁদলে সাদেক ভাই কষ্ট পাবেন। সাদেক ভাই হয়তো আজ অনেক খুশি যা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। দোয়া করো বাবার জন্য। তারপর ইমাম সাহেব আর আমি বাড়ি গেলাম। বাড়িতে ঢুকেই ভাইয়ের হাতে মিষ্টি দিয়ে মাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলাম যা এর আগে কখনো ধরিনি। তারপর মাকে বললাম, আমাদের কষ্টের সময় শেষ মা। এখন শুধু তোমার সুখের সময়। এখন আমাদের সব আত্মীয়দের আবার আগমন ঘটবে। যাদের এক কথায় বলা যায় সুখের পায়রা। একটু পর রায়হান আমাকে ফোন করলো দেখে একটু অবাক হলাম। কারণ অনেকদিন হলো তার কোনো খবর নেই। ফোনটা ধরলাম, ধরার পর সে বললো, কেমন আছিস শবনম। কেন জানি ওর আওয়াজটা আমার খুবই পরিচিত মনে হলো। মনে হচ্ছিল এই আওয়াজ শোনার জন্য এবং এই প্রশ্নের জন্যই আমি এতদিন অপেক্ষায় ছিলাম। একটু চুপ থেকে বললাম, আছি, ভালোই আছি। তারপর সে বললো, তোর সাথে দেখা করতে চাই। কথা আছে, শহরে আসলে জানাস। এই বলে ফোনটা রেখে দিল।
রায়হানের সাথে বসে আছি। একটু পর সে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে একটি কাগজ দিয়ে বললো, তুই কি আমার হাতটা ধরবি, শবনম। আমি তোর হাত ধরে অনেক পথ চলতে চাই। ধরবি আমার হাত?’। অবাক হলাম। এটা তো আবিতকে বলার কথা ছিল আমার। নিজের অজান্তে চোখে পানি চলে আসলো। তার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে দেখলাম, রায়হানের রেজাল্ট। সেও এখন বিচারক। ভাবলাম ভালোবাসা কিনা করতে পারে। অমনোযোগী এক সাধারণ ছাত্রকে বানাতে পারে অসাধারণ এবং রায়হানকে বানাতে পারে বিচারক। আগে কখনো তাকে নিয়ে ভাবিনি। আমার প্রতি তার যত্নগুলো খেয়াল করা হয়নি। হয়নি তার সৌন্দর্য দেখা। কিছুক্ষণ ভাবলাম কি করা যায়। আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পেল না বলে অন্যের ভালোবাসাও যে অপূর্ণ থাকবে এমন চাওয়াটা ঠিক হবে না। ভাবলাম, একটা ভালোবাসার না হয় জয় হোক।
বিয়ের কনে শবনম আর বর রায়হান। নবীন বিচারক দম্পতি। এই হলো আমার পৃথিবীতে কাটানো কিছু সময়ের গল্প। মা এসে আমায় নিয়ে গেল বিয়ের গহনা দেখতে। আমি আর রায়হান একসাথে দাঁড়িয়ে আছি। সব বন্ধুরা এসেছে। সবাই বলছে, তোদের অনেক মানিয়েছে। লাভ বার্ড। কত মানুষ আর কত গিফট।কিন্তু সবার মাঝে আমি খুঁজছিলাম একজনকে। হঠাৎ রায়হান আমাকে বললো, তোর জন্য একটা উপহার আছে। চোখ বন্ধ কর।তার কথা মতো বন্ধ করলাম। একটু পর চোখ খেলে দেখি আবিত। আবিত এসেই রায়হানকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। রায়হান বললো, কিরে শালা কই ছিলি এতদিন। ছাড় এবার শুধু জড়িয়ে ধরলে হবে? আমার উপহার কই? আবিত আমার দিকে চেয়ে হেসে বললো, দিলাম তো। আমার জীবনের সবচাইতে দামি জিনিসটা। কথাটা আমি বুঝতে পারলাম না। তারপর সে আমার কাছে আসলো। জিজ্ঞেস করলাম, নীলিমা আসেনি? সে আমার কথার উত্তর না দিয়ে বললো, কেমন আছিস? তোকে দেখতে আজ খুব সুন্দর লাগছে।তারপর সে আমার হাতে একটি খাম ধরিয়ে দিয়ে বললো, কাল সকালে খুলবি। তারপর সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কালরাতের অর্ধেকটা সময় আমি খামটা সম্পর্কে ভাবছিলাম। তাই সকাল সকাল ওঠেই দেরি না করে খামটা খুললাম। খুলে দেখতে পেলাম একটা শুকনো গোলাপ আর একটা চিঠি।
আবিতের লেখা আমি দেখেই চিনে ফেললাম। তারপর পড়া শুরু করলাম, শবনম…. আমার শবনম। তোর মনে আছে, তোর সাথে আমার আলাপটা কেমন করে হয়। সেদিন আমাদের প্রথম ক্লাস ছিল। ক্লাস শেষে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে তোর সাথে ধাক্কা খেয়ে একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, দেখে চলতে পারেন না। তখন তুই আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলি, দুঃখিত ভাইয়া। চোখদুটো পেছনে রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। জানিস, সেদিন প্রথম আমি এতো মায়াবী চোখ দেখেছি এবং তখন ভেবে নিয়েছিলাম এই বুঝি আমার প্রেয়সী। আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা। ভালোবেসে ফেলেছিলাম। খুউব বেশি। তারপর বছর তিনেক যাবার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, মনের কথাটা আজ তোকে বলেই ফেলবো। আসার পথে একটি গোলাপ নিয়ে ভাবতে ভাবতে আসছিলাম কীভাবে আমার মনের কথাটা তোকে জানানো যায়। ভাবতে ভাবতে ঠিক করলাম, তোর সামনে গিয়ে বলবো, তুই কি আমার হাতটা ধরবি শবনম? আমি তোর হাত ধরে অনেক পথ চলতে চাই, ধরবি আমার হাত? তারপর ক্যাম্পাসে গিয়ে তোর অপেক্ষায় রইলাম আর ভাবছিলাম রায়হানকেও ব্যাপারটা জানাবো। তখন হঠাৎ দেখি রায়হান আমার সামনে এসে হাজির। তাকে আজ খুব বেশি খুশি লাগছে। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এই খুশির কারণ কি? তখন সে উত্তর দিল, শবনম।শুনে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলাম। সে বললো, আমি প্রেমে পড়েছি বন্ধু, শবনমের প্রেমে। তখন মনে হলো আকাশটা ভেঙে আমার মাথায় পড়েছে। তারপর আর আমার কথাটা তাকে বলা হয়নি। সে ভাবছিল, কীভাবে তোর সাথে এই বিষয়ে কথা বলবে। তখন আমি তাকে বললাম ওর সামনে গিয়ে বলবি, তুই কি আমার হাতটা ধরবি শবনম, আমি তোর হাত ধরে অনেক পথ চলতে চাই,ধরবি আমার হাত? তারপর সে আমায় জড়িয়ে ধরে বললো, তোর মতো বন্ধু পাওয়াটা আমার জীবনের সবচাইতে সৌভাগ্যের বিষয়। তারপর সে তোর কাছে গেল। যখন তুই আর রায়হান কথা বলেছিলি তখন আমি দূর থেকে দেখছিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ দেখতে পারছিলাম না। কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিল। তাই তোদের কথার মাঝখানে ঢুক পড়েছিলাম। কারণ ভয় হচ্ছিল, তুই যদি হ্যাঁ বলে দিস। কিন্তু পারলাম কই বল। বন্ধুকে ভলোবাসা পাইয়ে দিতে এবং বন্ধুত্বের ভালোবাসার প্রমাণ দিতে আমার ভালোবাসাকে অপূর্ণ রাখলাম। জানিস শবনম, কিছু জিনিস অপূর্ণতাতেই সুন্দর। যেমন ভলোবাসা। তোকে না পাওয়াতে তোর প্রতি ভালোবাসাটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এইজন্য নিজেকে আমার কখনো ব্যর্থ মনে হয় না। কারণ আমার ভলোবাসার জয় হয়েছে। হ্যাঁ, চাইলে আমি সেদিন রায়হানকে আমার মনের কথাটা জানাতে পারতাম। কিন্তু জানাইনি। কারণ আমি চাইনি আমার জন্য একটা সত্যিকার ভালোবাসা অপূর্ণ থাকুক। পরে বুঝতে পারলাম, তুইও আমার প্রতি কিছুটা দুর্বল। তাই বন্ধুর ভালোবাসা পাইয়ে দেয়ার জন্য নীলিমার সাথে সেদিনের নাটকটা করেছিলাম। আমি চাই, আমার ভালোবাসার মানুষগুলো ভালো থাক। তোরা ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকবো। এটা ভেবে কষ্ট পাস না যে, আমি একা। আমি একা না রে, তুই সব সময় আমার সাথে আছিস। আর সারাজীবন থাকবি। কাল আমি চলে যাচ্ছি জাপান। দেশে আর ফেরার ইচ্ছে নেই। তাই কাল আমার দুই ভালোবাসাকে শেষবারের মতো দেখে আসলাম। আমাকে কখনো দেখার ইচ্ছে হলে রায়হানের ভালোবাসার মাঝে আমায় খুঁজে নিস, শবনম। আর কখনো কষ্ট পাস না, কারণ, তুই ভালো না থাকলে আমিও ভালো থাকবো না। ফুলটি সেদিন দিতে পারিনি, তাই আজ তোদের বিয়ের উপহার হিসেবে দিলাম। ভালো থাকিস শবনম, আমার শবনম ….
হঠাৎ রায়হান পেছন থেকে এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো। আমি কাগজটা সরিয়ে তার হাত ধরে বললাম, আমায় সারা জীবন ভালোবাসবি তো? সে উত্তর দিলো, আমার শেষনিশ্বাস অব্দি বেসে যাবো। ভালোবাসা কতই না সুন্দর তাই না? তার চাইতে বেশি সুন্দর অপূর্ণতা। অপূর্ণতায় এক ধরনের মোলায়েম স্নিগ্ধতা ও সৌন্দর্য্য থাকে, যা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি পূর্ণতাতেও না। অপূর্ণতা প্রেমকে বড় ও গভীর করে তোলে। লাইলি-মজনু কিংবা রোমিও-জুলিয়েটের প্রেম এত বিখ্যাত হয়ে আছে, কারণ সেসব প্রেম ছিল অপূর্ণ। ঠিক যেমনটা আবিত আর আমার প্রেম। তোর ভালোবাসার জয় হয়েছে আবিত। ডায়রিতে গোলাপটি যত্ন করে রেখে দিলাম।
পরদিন আমি আর রায়হান খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে গেলাম। সূর্যোদয় দেখবো বলে। রায়হানের বুকে মাথা রেখে সূর্যোদয় দেখছি
আর ভাবছি। জীবনের আরও একটি সূর্যোদয় হলো। এদিনের সূর্যাস্ত যেন আমার শেষনিশ্বাস ত্যাগের মধ্য দিয়ে হয়, এর আগে না।