সুলতান : যাঁর শিল্পকর্ম জীবনের চিরায়ত দৃশ্যকাব্য

রতন কুমার তুরী

আসল নাম শেখ মুহাম্মদ সুলতান (এসএম সুলতান)। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১০ আগস্ট ১৯২৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের বাংলাদেশ অংশের নড়াইলে। দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া সুলতান গ্রামীণ জীবন এবং কৃষিকাজের মধ্যেই তাঁর জীবনছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন। আর তাই তিনি তাঁর প্রতিটি শিল্পকর্মে কৃষকদের সুখ-দুঃখের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। মুলত সুলতানের আঁকা ছবিগুলো বিশ্বদরবারে বাংলার আবহমানকালের বৈচিত্র্যময় গ্রামীণ জীবনের প্রতিনিধিত্ব করছে যুগ-যুগ ধরে। সুলতান একজন সুরসাধকও ছিলেন। তিনি যখন বাঁশি বাজাতেন তখন দর্শক-শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতেন। সুলতানের শিল্পকর্মে গ্রামীণ জীবনের পরিপূর্ণতা এবং প্রাচুর্যের পাশাপাশি শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্রও ফুটে উঠেছে। গ্রামনির্ভর শিল্পকর্ম এবং সুরসাধনার জন্য ১৯৮২ সালে তিনি তিনটি সম্মানে ভূষিত হনÑ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান ‘ম্যান অব এচিভমেন্ট’, ইংরেজি পত্রিকা এশিয়াউইক থেকে পান ‘ম্যান অব এশিয়া’ এবং ওই বছরই স্বদেশে পান ‘একুশে পদক’। এসএম সুলতানের বাবা শেখ মেসের আলী ছিলেন পেশায় রাজমিস্ত্রী। রাজমিস্ত্রী হলেও তিনি কৃষিকাজ তথা বাংলার মাটির সাথে মিশেছিলেন। রাজমিস্ত্রীর পাশাপাশি তিনি কৃষিকাজও করতেন অত্যন্ত দরদ দিয়ে। সুলতান ছিলেন পরিবারের একমাত্র সন্তান। ছোটবেলায় তাঁকে লালমিয়া বলে ডাকা হতো। পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে লেখাপড়ার সুযোগ না থাকলেও ১৯২৮ সালে সুলতানকে নড়াইল ভিকটোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু পাঁচ বছর পর তিনি বাড়িতে ফিরে এসে পিতার সাথে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে থাকেন। ইমারত বানানোর কাজ মূলত সুলতানকে বেশ প্রভাবিত করছিল। ঠিক তখন থেকেই সুলতান কজের ফাঁকে-ফাঁকে ছবি আঁকতে থাকেন। পিতার সাথে রাজমিস্ত্রীর কাজ করার সময় তিনি ইমারত, মানুষ, পশুপাখিসহ বিভিন্ন বস্তুর স্কেচ করতে থাকেন। সুলতানের বাল্যকালে চরিত্রগঠন সম্পর্কে বিদগ্ধ আহমদ ছফা লেখেন :
‘কোনো-কোনো মানুষ জন্মায়, জন্মের সীমানা যাঁদের ধরে রাখতে পারে না। অথচ যাঁদের সবাইকে ক্ষণজন্মাও বলা যাবে না। এ রকম অদ্ভুত প্রকৃতির শিশু অনেক জন্মগ্রহণ করে জগতে, জন্মের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য যাঁদের রয়েছে এক স্বাভাবিক আকুতি। … শেখ মুহাম্মদ সুলতান সে সৌভাগ্যের বরে ভাগ্যবান, আবার সে দুর্ভাগ্যের অভিশাপে অভিশপ্ত।’
১০ বছর বয়সে, যখন তিনি বিদ্যালয়ে পড়েন তখন আশুতোষ মুখার্জির ছেলে ড. শাম্যাপ্রসাদ মুখার্জি নড়াইলে ভিকটোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শনে এলে সুলতান তাঁর একটি পেনসিল স্কেচ আঁকেন। শাম্যাপ্রসাদ তার আঁকা স্কেচ দেখে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন এবং এই পেনসিল স্কেচের মাধ্যমেই শিল্পী হিসেবে সুলতানের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে।
ছবি আঁকার প্রতিভার কারণে শৈশব থেকেই এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের স্নেহলাভ করেন সুলতান। ধীরেন্দ্রনাথের ভাইয়ের ছেলে অরুণ রায় তখন কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র। সেই অরুণ রায়ের কাছে সুলতান ছবি আঁকা শিখতে শুরু করেন।
গতানুগতিক পড়াশোনার প্রতি সুলতানের আগ্রহ ছিল না কখনই। ১৯৩৮ সালে ক্লাস এইটে ওঠে তিনি স্কুল ছেড়ে দেন। ছবি আঁকা শেখার জন্য কলকাতায় পাড়ি জমান। বয়স কম হবার কারণে তখন কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। কখনো ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়ি, কখনো তাঁর ভাই সত্যেন রায়ের বাড়ি, কখনো তাঁদের অন্যান্য ভাইদের বাড়িতে থেকে সুলতান তিন বছর ছবি আঁকার চর্চা করেন।
১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেন। পরীক্ষায় অংশ নেয়া চারশো ছেলেমেয়েকে পনেরো মিনিটে ভেনাস মিলোর ছবি আঁকতে দেয়া হয়। সুলতান প্রথম হন, কিন্তু এনট্রান্স পাস না থাকার কারণে তাঁর ভর্তি নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। তখন ধীরেন্দ্রনাথ রায় বিষয়টা অবগত করেন শাহেদ সোহরাওয়ার্দীকে। সোহরাওয়ার্দী তখন প্রখ্যাত শিল্পসমালোচক এবং কলকাতা আর্ট স্কুলের পরিচালনা পরিষদের সদস্য। তাঁর সাহায্যে সুলতান কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। তিনিই সুলতানকে পরামর্শ দেন ভর্তি হবার সময় কাগজপত্রে লাল মিয়া না লিখে শেখ মুহাম্মদ সুলতান লিখতে। সুলতানকে সোহরাওয়ার্দী সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকেন। তাঁর অসাধারণ সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার সুলতানের জন্য সব সময়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। কিছুকাল তাঁর ও তাঁর ভাই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাসায় থেকে সুলতান পড়াশোনা করেন।
কলকাতা আর্ট স্কুলের অন্যান্য ক্লাসে তখন জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, রাজেন তরফদার, আনওয়ারুল হকের মতো শিল্পীরা পড়াশোনা করতেন। ফলে তাঁদের সাথে সুলতানের যোগাযোগ ঘটে। ছাত্র হিসেবে সুলতান ভালো ছিলেন। এর পাশাপাশি মঞ্চনাটকে অভিনয় করেও প্রশংসা অর্জন করেন। পরবর্তীকালে অবশ্য এসএম সুলতান কলকাতা আর্ট স্কুলের তৃতীয়বর্ষ থেকে চলে আসেন। তবে ততদিনে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে বিদেশে।
পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলছিল। এ সময় অনেক গুণীশিল্পীই সেখানে তাঁদের নতুন-নতুন কাজ মিডিয়ার সামনে তুলে ধরছিলেন। কিন্তু এসএম সুলতান সে সময়ও নড়াইলে থেকে যান, অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে। এর কারণ গ্রামীণ জীবনের প্রতি তাঁর চিরন্তন আকর্ষণ। তাঁর শিল্পকর্মের স্বরূপটিও খুঁজে পাওয়া যায় এই গ্রামীণ জীবনযাত্রার প্রেক্ষাপটেই। তাঁর সেই সময়কার ছবিগুলোতে গ্রামীণ কৃষকদের দেখা যায় পেশিবহুল এবং বলশালী এবং সুখী মানুষ হিসেবে। এর কারণ হিসেবে এসএম সুলতান বলেন :
‘আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ণ, কৃষকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো- সেটাও রোগা …। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা মনের ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি যে আমাদের দেশের কৃষক সম্প্রদায়ই তো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিল। অর্থবিত্ত ওরাই তো যোগান দেয়। … আর এই যত জমিদার রাজা-মহারাজা আমাদের দেশের কম কেউ না। সবাই তো কৃষিনির্ভর একই জাতির ছেলে। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায়-অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রুগ্ণ কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়। ফসল ফলায়!’ মুলত এসএম সুলতান বাংলার কৃষক যারা আমাদের দেশের খাদ্যের যোগান দেয়ার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে, তাদের শরীর কেন রুগ্ণ হবে, বিষয়টা তিনি কখনও মেনে নিতে পারেননি আর তাই তিনি তাঁর মনের মাধুরী মিশিয়ে রং-তুলি দিয়ে তাদের এঁকেছেন বলশালী করে। এটিকে এসএম সুলতানের একটি প্রতিবাদও বলা চলে।
তাঁর ছবিতে গ্রামীণ রমণীদের দেখা যায় সুডৌল ও সুঠাম গড়নের। নারীর মধ্যে উপস্থিত চিরাচরিত রূপ-লাবণ্যের সাথে তিনি শক্তির সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। একই সাথে তাঁর এ ছবিগুলোতে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের শ্রেণিদ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির কিছু বাস্তবতাও ওঠে এসেছে। এসএম সুলতানের এ রকম দুটি বিখ্যাত শিল্পকর্ম হচ্ছে ‘হত্যাযজ্ঞ’ (১৯৮৭) এবং ‘চরদখল’ (১৯৮৮)।
প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ মেয়েরা নিয়তই প্রকৃতির প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকে। তারা কখনও ধানভানার কাজ, কখনও কৃষাণির কাজ, কখনওবা বাড়ির চারপাশে শাক-সবজির চারা রোপণ করে, যাতে করে বাড়ির সদস্যরা সারাবছর শাকসবজি খেতে পারে।
১৯৭৬ সালে তাঁর আঁকা শিল্পকর্ম নিয়ে শিল্পকলা একাডেমির প্রদর্শনীতে তাঁর ছবির মহিমা নতুন করে প্রস্ফুটিত হয়। এই ছবিগুলোর মধ্যে দেখা যায়, বিশ্বের কেন্দ্র হচ্ছে গ্রাম আর সেই কেন্দ্রের রূপকার কৃষককে আপন মহিমায় সেখানে অধিষ্ঠিত দেখা যায়। গ্রাম ও গ্রামের মানুষ ছিল তাঁর শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণা আর উপকরণ ছিল কৃষক এবং কৃষকের জীবনচেতনা। এসএম সুলতান তেলরঙ এবং জলরঙয়ে ছবি আঁকতেন। পাশাপাশি রেখাচিত্র অংকনেও ঝোঁক ছিল। আঁকার জন্য তিনি একেবারে সাধারণ কাগজ, রঙ এবং জটের ক্যানভাস ব্যবহার করেছেন। এজন্য তাঁর অনেক ছবিরই রঙ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, তবুও এসবের প্রতি তিনি তেমন ভ্রূক্ষেপ করতেন না। নড়াইলে থাকাকালে তিনি অনেক ছবি কয়লা দিয়েও এঁকেছিলেন। তবে সঠিকভাবে সংরক্ষণের অভাবে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
এসএম সুলতান আধুনিকতার একটি নিজস্ব সংজ্ঞা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর তেমন কোনো অনুসারী ছিলনা যাঁরা একই সংজ্ঞা মেনে শিল্পচর্চা করতেন। এ কারণেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত আধুনিকতার স্বরূপ নিয়ে নতুন কোনো ধারার সৃষ্টি হয়নি। কেউ তাঁর মতো করে আধুনিকতার ব্যাখ্যাও দেননি। এছাড়া তাঁর মতো মাটির জীবন তখনকার কোনো শিল্পী যাপন করেননি। তাঁর কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা কেমন ছিল তা বলতে গিয়ে তাঁর জীবনী লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন :
‘তাঁর কাছে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্তশিল্পের চর্চা করেননি; তাঁর আধুনিকতা ছিল জীবনের শাশ্বত বোধ ও শিকড়ের প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং ঔপনিবেশিক সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন। এটাই তাঁর কাছে ছিল ‘আধুনিকতা’, অর্থাৎ তিনি ইউরোকেন্দ্রিক, নগরনির্ভর, যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের কর্মবিশ্বকে।’
মুলত গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাস করতে এসএম সুলতান বেশ ভালোবাসতেন আর তাই তিনি তাঁর গ্রামের বাড়িকেই শিল্পসাধনার স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি গ্রামে তাঁর হাতে গড়া স্টুডিওতে কাজ করে গেছেন। শেষ জীবনে এসে সুলতান গ্রামীণ জীবন আঁকড়ে ধরে বসবাস করার জন্য নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করেছেন আর বলেছেন : ‘আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।’
সত্যিই সারাজীবন গ্রামীণ জীবনকে আঁকড়ে একটি শিল্পমাধ্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরা এমন শিল্পী খুব কমই দেখা যায়। এসএম সুলতান সেই বিরল শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। যাঁর তুলির প্রতিটি আঁচড়েই বাংলার কৃষকদের বিজয়গাথা আঁকা হয়। যাঁর প্রতিটি শিল্পকর্ম এখনও আমাদের কাছে বিশ্বসম্পদ। এসএম সুলতান মৃত্যুবরণ করলেও বেঁচে আছেন তাঁর অমূল্য সম্পদ চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে। যে চিত্রকর্মগুলো আমাদের যুগ-যুগ ধরে অনুপ্রেবণা যোগাবে।