সিন্ডিকেট বাড়াচ্ছে মরিচের ঝাল

রাজীব শর্মা »

ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার নগরীর চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে বাড়তির দিকে রয়েছে শুকনা মরিচের দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে ভারতীয় ও দেশী মরিচের কেজিতে ১০০ টাকা দাম বেড়েছে। এ নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে অসন্তোষ। তবে বিক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে নানা গুঞ্জন। ডলার ও এলসি সংকটের কারণে এ মূল্যবৃদ্ধির কথা জানা গেলেও ব্যবসায়ীরা একটি সিন্ডেকেটের দিকেই আঙুল তুলছেন।

জানা যায়, গত তিনমাস ধরে কেজিপ্রতি ৩৭০-৪২০ টাকায় আমদানিকৃত ভারতীয় মরিচ বিক্রি হলেও গতকাল বুধবার খাতুনগঞ্জের পাইকারি দোকানগুলোতে ৫০০ এর উপরে বিক্রি হয়েছে ভারতীয় ও দেশীয় (হাটহাজারি) মরিচ। অন্যদিকে আমদানিকৃত ভারতীয় তেজা মরিচ দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা বেড়ে ৩৯৫ থেকে ৪০৫ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। মরিচের এমন অস্বাভাবিক দামের কারণে খাতুনগঞ্জের মরিচ আড়তদার ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা দুষছেন দেশের ডলার ও এলসি সংকট ও খাতুনগঞ্জের সিন্ডিকেট ও করপোরেট ব্যবসায়ীদেরকে। গতকাল বুধবার বিকালে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজার পরিদর্শন করে দেখা যায়, ভারত থেকে আমদানি করা তুলনামূলক চিকন ও ঝাল শুকনা মরিচ কেজিপ্রতি ৩৮০ থেকে ৩৯৫ টাকা, ভারতীয় মিষ্টি মরিচ ৪৯০ টাকা ও খুচরা বাজারে ৫২০ টাকার উপরে বিক্রয় হয়েছে। আর দেশীয় পঞ্চগড়ের চিকন মরিচ ৩৯০ টাকা, মোটা মরিচ ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকা এবং চট্টগ্রামের হাটহাজারির মরিচ ৫০০ ছাড়িয়েছে।

গতকাল চট্টগ্রামের হাটহাজারির মরিচ কেজিপ্রতি ৫২০ টাকার উপরে বিক্রি হয়েছে।খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান দেশে কোন মরিচ নেই। ভারতীয় মরিচের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অন্যদিকে দেশীয় ব্যবসায়ীরা ডলার সংকটের কারনে এলসি করতে পারছে না। যার ফলে শুকনা মরিচের দাম অনেক চড়া রয়েছে। এ কারণে দেশীয় ব্যবসায়ীরা পণ্যটির আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে সরবরাহ স্বল্পতায় আমদানি করা শুকনা মরিচের দাম বেড়েছে। বাড়তি চাহিদার কারণে দাম বেড়েছে দেশে উৎপাদিত শুকনা মরিচেরও। তবে এবার পর্যাপ্ত ফলন হয়েছে। আগামি ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে মরিচ উত্তোলন করা হবে। যার ফলে মরিচের দাম কমে যাওয়ার আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতিতে খাতুনগঞ্জে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মরিচ কিনতে আসা ক্রেতাদের রয়েছে অভিযোগও।

পটিয়ার মুন্সেফবাজার থেকে আসা মো. মুবিনুল নামের এক মুদি ব্যবসায়ী বলেন, ‘বিগত তিন মাস ধরে নানা ইস্যু তৈরি করে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা চড়া দামে মরিচ বিক্রি করছে। গত দুই সপ্তাহ আগে যে মরিচ ৩২০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল তা এখন ৪৫০ টাকা ছাড়িয়েছে। এক সপ্তাহের ভিতর তো আর এলসি করা মাল আসেনি। এলসি করে মাল আসতেও সময়ের প্রয়োজন আছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের পণ্যের দাম বাড়াতে সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে না। যখন মন চায় তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়তি নিচ্ছে।’

বোয়ালখালী থেকে আসা আরেক মুদি ব্যবসায়ী মো. হামিদ বলেন, ‘আমদানি সংকট, ভারত থেকে মরিচ আসেনা, বেনাপোল বর্ডারে মরিচের দাম বেশি এসব কথাগুলো রোজ শুনি। ভারতের মরিচের দাম বাড়তি হলে আমরা তা কিনবো না। কিন্তু আমাদের দেশীয় মরিচের দাম কেন বাড়তি নিচ্ছে তারা? প্রশাসনই বা কেন নীরব?’

খাতুনগঞ্জের বাজারে কোন ধরনের তদারকি নেই এবং প্রশাসনমহল ব্যবসায়ীদের কবলে জিম্মি দাবি করে এক খাতুনগঞ্জের এক পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, ‘ভোক্তা অধিকারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা মাসে কয়েকটি অভিযান দেখিয়ে নীরব থাকে। এই যে দিনদুপুরে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা তাদের মনগড়া দামে মরিচ বিক্রি করছে তারা কি দেখছে না? আমি বলবো দেখছে। কিন্তু তারা প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের কবলে জিম্মি। না হলে বাজার তদারকি করে না কেন?’

খাতুনগঞ্জের মরিচ আড়তদার ও ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দিন মঞ্জু সুপ্রভাতকে বলেন, ‘এখন এলসি হচ্ছে না। আমাদের দেশে এখন মরিচ নেই। আমরা এখন ভারতের মরিচের উপর নির্ভর করছি। আমরা কিছু মরিচ বেনাপোল বর্ডার থেকে নিয়ে এসেছি।’

মরিচের বাজার কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের দখলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘এখন মরিচ, হলুদ, ধনিয়ার বাজারও অনান্য নিত্যপণ্যের মতো করপোরেট কোম্পানিগুলোর দখলে। তারা ক্ষমতাশালী। নিজেরা এলসি করে পণ্য আমদানি করে নিজেরায় বাজারজাত করছে। যার ফলে সাধারণ ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনে সরাসরি বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না।’

আগামীর মরিচের বাজার সম্পর্কে জানতে চাইলে এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগামীর সম্ভাবনা ভালো। দেশে ব্যাপক মরিচ উৎপাদন হয়েছে। তবে এই দাম কমতে আরো তিনমাস লাগবে।’

মসলাজাত পণ্য পাইকার বিক্রেতা চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির যুগ্ম সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ আলম সওদাগর সুপ্রভাতকে বলেন, ‘আমার ব্যবসায়ীক অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বিগত করোনার পর থেকে এখানে বড় বড় ব্যবসায়ীরা যারা এলসি করে মসলাজাত পণ্য আমদানি করে তারা সিন্ডিকেট করে বানিজ্য করছে। যেমন গতকাল ধনিয়ার বাজার ছিল ১০০ টাকা কেজি তা আজ হয়ে গেছে ১২০ টাকা। তার মানে বড় বড় ব্যবসায়ীরা হঠাৎ করে কয়েকশ গাড়ি মাল কিনে সবাই সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে ফেলে। আর আমরা যারা সাধারণ ব্যবসায়ীরা আছে আমরা চাপের মুখে পড়ে যায়। এই চাপটি আবার সাধারণ জণগণের মধ্যে পড়ছে।’

এলসি জটিলতা ও মালের সংকট নিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা শুনছি এলসি জটিলতার কারণ এবং দেশে ও ভারতে পণ্যের সংকটে দাম বাড়ছে। ভারতে পণ্য সংকট বিষয়টি মিথ্যা। আমরা খবর নিয়েছি ভারতে পর্যাপ্ত পরিমাণ মরিচ রয়েছে। ডলার ও এলসি সমস্যার কারণে দেশে মাল আসছে না।’

রমজানের প্রস্ততি নিয়ে এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘বিশ্বে রমজানে মালামালের দাম কমে কিন্তু আমাদের দেশে তা ব্যতিক্রম। নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। রমজানে দেশে পর্যাপ্ত মসলাজাত পণ্য থাকবে। কারণ তখন নতুন দেশীয় মরিচ বাজারে আসবে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ না করলে হয়। এতে সরকারের খাতুনগঞ্জের বাজার মনিটরিং জরুরি।’