সাবেক নাকি প্রেরণা

বাসিংথুয়াই মার্মা

কী বলে সম্বোধন করবো আমি তাঁকে! সাবেক নাকি প্রেরণা? সাবেক বলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। কেননা সাবেক দাবি করার মতো অধিকার আমার নাই। আমি তাঁকে নিজের করতে পারিনি। তাঁকে আমি সাবেক বলবো কোন সাহসে? তবে হ্যাঁ, মনের কোণে কোমল চাঁদের আলো আর সূর্যের প্রখর তাপ দুটোরই অনুভুতি হয়েছিল আজ থেকে ২০ বছর আগে।
সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। পাহাড় ও নীল আকাশের লুকোচুরি করা ঘাসফড়িং আর ফিঙ্গেপাখির ডানামেলার খোলা আকাশ, প্রাণবন্ত খোল মাঠ, মনের ঢেউ খেলানোর প্রাণস্পন্দন শাটল ট্রেন, মনোমুগ্ধকর ক্যাম্পাসÑ সবকিছু মিলিয়ে গ্রাম থেকে আসা সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত যুবকের জীবন শহর থেকে ক্যাম্পাস করে সকাল-বিকাল পার হচ্ছিল। একদিন তার সহপাঠী তাকে বললো,
চল বন্ধু, একটা জায়গায় একটু ঘুরে আসি। তোর সাথে আমার বান্ধবীর পরিচয় করে দিই।
গেলাম, পরিচিত হলাম। প্রথম দিনে তাকে দেখে মনে হলো অনেক দিনের চেনা মানুষ। অনেক দিনের দেখা বুঝি। সে বুঝি সুদীর্ঘ দিন ধরে আমার জন্যই অপেক্ষায় ছিল। মনের ভিতর অসম্ভব শিহরনের ঢেউ অনুভব করলাম। কী দেখছি আমি! তাকে আমি জন্ম-জন্মান্তর ধরে চিনি। তার সাথে আমার হাজার বছরের রেলের সমান্তরালরেখায় বসবাস।
পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব থেকে মনের ভিতর মন তৈরি হওয়া। একদিন নয়, দুদিন নয়, গুনে-গুনে ৮টি বছর। মেট্রোপলিটন শহরের ধুলাবালি, গাড়ির ধোঁয়া কোনটাই আমাদের আটকিয়ে রাখতে পারেনি। বিকালে ক্যাম্পাস থেকে ফিরলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিকশা করে শহর বেড়ানো আমাদের অঘোষিত রুটিনের পরিণত হয়েছিল।
একদিন ভোরসকালে আমি কাম্পাসে যাচ্ছি। ২ নম্বর গেট পার হচ্ছি মাত্র, সে ফোন দিল। একরাশ হেসে বলল, আমি বাড়ি যাচ্ছি দুদিনের জন্য। তুমি চাইলে যেতে পারো আমার সাথে। আমি ১/২ না ভেবেই করেই তার সাথে তাদের বাড়িতে গিয়েছি। সারারাস্তা ধরে আমাদের দুজনের কী আলাপ। শেষই হতে চায় না যেন। বেরসিক হেলপার গাড়িতে একটা গান ছেড়েছিল। গানের একটা কলি ছিল : তুমি কেন কোমরের বিছা হইলো না …
সে আমাকে কী সুন্দর করে বুঝাচ্ছিল কোমরের বিছা জিনিসটা কি। তার মায়েরও বিছা আছে। ছোটোবেলা উৎসব-পার্বণে নিজেদের ড্রেসের সাথে তার মা তাকে বিছা পরিয়ে দিত, ইত্যাদি। সন্ধ্যা নাগাদ তাদের গ্রামে পৌঁছেছি। ওদের বাড়িতে পৌঁছা অবধি আমাদেন দুজনের কোনো হুঁশই ছিল না।
বাড়িতে গিয়ে কি পরিচয় দেবো। আমার মনে লজ্জা, সংকোচ হালকা ভয় চেপে বসেছিল। সে বলল, চিন্তা কর না তো। আমার মা-বাবারা গ্রামে থাকলেও মন অনেক বড়। বাড়িতে আমাকে সবাই ছেলে হিসেবেই জানে। মা-বাবার আমার ওপর অগাধ বিশ্বাস। আর তোমার-আমার সম্পর্ক তো কোনো খারাপ কিছু না। প্রেমও তো না। সুতরাং চিন্তা কিসের?
আমিও আমার চিবুক নিচু করে বুকে ফুঁ দিয়ে বলেছিলাম, ভয পাই নাকি আমি? যা হবার তাই হবে।
তারপর দিন সে আমাকে পুরো গ্রাম ঘুরে দেখিয়েছিল। কী অপরুপ সুন্দর। ঢেউ খেলানো সবুজ প্রান্তর। ধানের খেত। সাদা বকের দলের হেমন্তের নীল আকাশে ওড়ে বেড়ানোর দৃশ্য।
আজও তা চোখে ভাসে। দুদিন পর আমরা ফিরেছি। ফেরার সময় পাড়ার এক বুড়োদাদু বলেছিলেন মজা করে, তাহলে ফাইনাল?
আমরাও মজা করে বলেছিলাম, হ্যাঁ, ফাইনাল। সে বলা ফাইনাল কথাতেই থেকে গেছে। আমরা দুজনে কোনোটাই হইনি। না প্রথম রাউন্ড, না কোয়ার্টার, সেমি তো দুরের কথা। বুড়োদাদুর সেদিনের ফাইনাল শুধুমাত্র ঠোঁটের কোণেই রয়ে গেল।
জীবন-জীবিকার তাগিতে আমরা কেউই কোথাও থেমে থাকতে পারিনি। অনেক ‘সময়’ ও ‘ঘটনা’ আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমরা হারিয়ে ফেলেছি অনেক কিছু।
আমরা বলতে পারিনি একে অন্যকে ‘তোমাকে আমার পছন্দ, তোমাকে ভালোবাসি’।
ব্যস্ত শহরে আমাদের ছোটো প্রেম ধুলোবালিতে চাপা পড়ে গেছে। আমরা দুজনে হারিয়ে ফেলেি আমাদের মনের আঙিনা।
আজ কতদিন পর দেখা হলো। দীর্ঘ ১২টি বছর পর। এর মধ্যে আমাদের অনেক কিছুই বদলে গেছে। তার ঢেউ খেলানো হাঁটুসমান চুল আর নাই। আমারও মাথাভর্তি ক্যাম্পাসীয় চুল, দুপকেটওয়ালা গভাডিন শার্টও আর নেই।
আমরা দুজন ফিরে গিয়েছি দুজনার একক জগতে। বড় শহরে আমাদের প্রেম এভাবেই চাপা পড়ে গেছে। চাপা পড়ে আছে আজও।