জীবনের কাছে

রোকন রেজা

টিনের দেয়ালে টাঙানো হলুদ প্লাস্টিকের বেড় দেয়া বারো ইঞ্চির কাচের আয়না। খয়েরি রঙের শাড়িটা পরতে পরতে জোছনা একবার তাকায় আয়নায়। ঘরের হলুদ আলোয় কেমন যেন একটু ফ্যাকাসে লাগে নিজেকে।
শাড়ির কুঁচি আরও একবার ঠিক করে নেয় সে। বিছানায় শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মেয়ের দিকে একবার তাকায়। এই এপ্রিলে ওর বয়স হবে সতেরো মাস।
বিছানায় কাত হয়ে মেয়ের কপালে একটা চুমু দেয় জোছনা। তারপর ওঠে এসে আবার আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ভুরুতে কালি জড়ায় গাঢ় করে। ঠোঁটের লিপিস্টিক আরও একবার ঘষে নেয়। আর ঠিক তখনই, হ্যাঁ ঠিক তখনই লিপিস্টিকটাকে তার মনে হয় যেন নিকু মাজুই-এর গোলাপি শিশ্ন।
অজান্তেই হেসে ওঠে জোছনা। তারপর লিপিস্টিকটাকে একটানে ছুঁড়ে ফেলে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়।
এতক্ষণ কুদ্দুসের চলে আসার কথা। কিন্তু সে আসছে না। সে কি ধারে[-কাছে কোথাও নেই! কে জানে!
কুদ্দুস থাকলে সুবিধা হয়। ওর নিজস্ব রিকশা আছে। কাস্টমার ঠিক করে ও-ই নিয়ে যায় তাকে। সেদিন ইনকাম বেশি হয়। মালদার পার্টি ঠিক করে কুদ্দুস। সে কত নেয় কে জানে! তবুও পুষিয়ে যায় জোছনার।
সেদিন গিয়েছিল গুলশানে এক বিদেশির বাসায়। কুদ্দুসই নিয়ে গিয়েছিল।
কী সুন্দর পরিপাটি সাজানো ঘর! খাট, সোফা, সোনালি মখমলের নরম কার্পেট। দেয়ালের রংটাও কেমন অদ্ভুত মায়াময়। সন্ধ্যার আকাশের মতো কিংবা গ্রামের শ্যামলা মেয়ের মতো।
লোকটা ভাঙা ভাঙা বাংলা বলছিল। নামটাও জোছনার স্পষ্ট মনে আছে- নিকু মাজুই।
জোছনাকে কিছু ফল দিয়েছিল খেতে। আর মিষ্টি। শেষে দিয়েছিল সোনালি শরবত। কাচের পেয়ালায় সোনালি শরবত।
শরবতে জোছনা অভ্যস্ত নয়। তবুও পান করেছিল। তারপর আস্তে আস্তে কেমন এক অজানা উষ্ণতায় ভরে গিয়েছিল দেহ, মন। অতঃপর ফর্সা আলোয় লোকটা যখন উলঙ্গ হয়ে গেল … না, কিছুই মনে হয়নি তখন। শুধু মনে হয়েছিল এই তো জীবন, এভাবেই তো বেঁচে থাকা।
রাতের ফিকে অন্ধকারে হাঁটতে থাকে জোছনা। পাশ দিয়ে রিকশা বেরিয়ে যায় দুটো টুং টাং শব্দ করে। একটা রিকশা থেকে ভেসে আসে অশ¬ীল কণ্ঠ।
ওইখান কি এ্যাতো রাত্তিরে, কৈ যাস?
জোছনা তাকাতে তাকাতেই রিকশাটা চলে যায় আয়ত্তের বাইরে। তবুও খেঁকিয়ে ওঠে সে, ওই শুয়োরের বাইচ্চা, তোর মা খানকি, তোর বুন খানকি।
ঠিক তখনই হঠাৎ একটা সিএনজির আলো জোছনার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। জোছনা থেমে যায় পথের একপাশে। সিএনজিটা দাঁড়ায় জোছনার কোল ঘেঁষে। ড্রাইভারই কথা বলে ওঠে প্রথমে, যাবি?
কোথায়?
নাখালপাড়া।
কয়জন?
তিনজন।
ঘণ্টা না ফুল।
ফুল।
দুই হাজার লাগবে
ওহ, মাগির রেট কত! ভেতর থেকে কে যেন ফোড়ন কাটে।
পনের শ পাবি। ড্রাইভার বলে।
মুহূর্তেই কি যেন ভেবে নেয় জোছনা। তারপর সিএনজির কাছে গিয়ে বলে, সরে বসেন।
দুই
তিনটি পাঁচ শ টাকার ময়লা নোট হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরে ভোরবেলা জোছনা যখন ঘরে ফেরে তখন কচির কচিমুখ তার মনে পড়ে। সেও একদিন বড় হবে। না, সে নিশ্চয় বড় হবে না। সে দিনে দিনে হয়ে উঠবে তারই মতো একজন বেশ্যা। পৃথিবীর তাবৎ চিল-শকুনেরা ছিঁড়ে খাবে তার এই সন্তানটিকে। ওরও হয়ে উঠবে দিনে দিনে ক্ষয়ে যাওয়া অভিশপ্ত জীবন। কিন্তু কি করবে সে! কি করার আছে তার!
সন্ধ্যায় যখন বের হয়েছিল জোছনা, তখন মনে হয়েছিল কত কিছু কিনবে মেয়ের জন্য। অথচ এখন আর কিছুই কিনতে ইচ্ছে করে না। নিজের জীবনের প্রতি এক অসহনীয় তীব্র ঘৃণা জন্মায়। মরে যেতে ইচ্ছে করে।
জোছনা হাঁটতে হাঁটতে ভাবে এই গ্ল¬ানিময় জীবন, এই পুড়ে যাওয়া অভিশপ্ত জীবন কিভাবে সে মেয়েকে উপহার দিয়ে যাবে! নিজের জীবন নিজের কাছেই বড় বেশি ভারী মনে হয় তার।
জোছনা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় সে পালিয়ে যাবে। পালিয়ে যাবে তার মেয়েকে নিয়ে এই শহর ছেড়ে দূরে কোথাও। যেখানে চিল নেই। শকুন নেই। যেখানে শুধু মানুষ আছে মানুষের জন্য। জোছনা আরও ভাবতে থাকে, সে রকম কোনো পৃথিবী আসলেই কি এই পৃথিবীতে কোথাও আছে!